Naya Diganta

পুতিনের কৌশলে রাশিয়ার মুদ্রার নাটকীয় উত্থান

পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল বেশ নাটকীয়ভাবে শক্তি ফিরে পেয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রুবল যে অবস্থায় ছিল, এখন তার চেয়েও শক্তিশালী হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবসা ও অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ বলেছে, রুবল গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে।

ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর করার পরপরই ইউরোপ এবং আমেরিকা মিলে রাশিয়ার উপর নানা ধরণের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এর ফলে রুবলের মান বেশ দ্রুত নিচের দিকে পড়তে থাকে।

পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অনেকে ভেবেছিল রাশিয়ার মুদ্রা রুবল হয়তো দ্রুত মূল্যহীন হয়ে যাবে।

সঙ্কট সামাল দিতে টানা দুই সপ্তাহ মস্কোর শেয়ার বাজার বন্ধ রাখা হয়েছিল। কারণ শেয়ার বাজার খুললেই রুবলের দাম নিচের দিকে নামতো। কিন্তু মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে রুবল আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

রুবল ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে অনেকে নানা কারণ বিশ্লেষণ করছেন। মুদ্রাটি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেটি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়ে হয়েছে।

কারণ, ধারণা ছিল যে ইউরোপ আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি হয়তো ধসে যাবে।

তেল গ্যাসের মূল্য রুবলে পরিশোধ
রুবল ঘুরে দাঁড়ানোর মূল কারণ হচ্ছে, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানী। অর্থাৎ গ্যাস ও তেল রফতানি।

রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপের দেশগুলো যে গ্যাস ও তেল ক্রয় করে সেটির মূল্য পরিশোধ করা হতো ইউরোতে। রাশিয়ার সাথে এটাই ছিল তাদের চুক্তি। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে রাশিয়া বলেছে যে তাদের কাছ থেকে যারা তেল গ্যাস ক্রয় করবে, সেটির মূল্য পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে। এর ফলে ইউরোকে রুবলে পরিবর্তন করা হয়।

ব্লুমবার্গ বলেছে, এ কারণে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল শক্তিশালী হয়েছে।

তাছাড়া চীন এবং ভারতের কাছে জ্বালানী বিক্রির মাধ্যমে রাশিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে।

রাশিয়ার রফতানি করা পণ্যের মধ্যে ৬০ শতাংশই হচ্ছে গ্যাস এবং তেল।

দেশটির রফতানি আয়ের ৪০ শতাংশ আসে তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে।

ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাস এবং তেলের উপর উপর নির্ভরশীল।

গ্যাস এবং তেল আমদানি বাবদ রাশিয়াকে প্রতিদিন ৪০ কোটি ইউরো পরিশোধ করে ইউরোপের দেশগুলো।

রাশিয়ার সেন্ট পিটাসবার্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাতিয়ানা রোমানোভা বিবিসি বাংলাকে বলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেল-গ্যাস রফতানির পরিমাণ কমেছে এ কথা ঠিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়া সেটি পুষিয়ে নিচ্ছে।

অধ্যাপক তাতিয়ানা রোমানোভার বিশ্লেষণ হচ্ছে- পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে রুবলের চাহিদা ও যোগানের উপর।

তিনি বলেন, রাশিয়ার উপর নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে দেশটি অনেক জিনিস আমদানি করতে পারছে না এবং রাশিয়ার মানুষ আগের মতো বিদেশে যেতে পারছে না। ফলে তাদের ডলার ও ইউরোর চাহিদা কমে গেছে।

অন্যদিকে তেল-গ্যাস বিক্রি বাবদ অর্থ রুবলে কনভার্ট করে নেয়ায় রাশিয়ার মুদ্রার চাহিদা বেড়েছে।

ফলে আমেরিকান ডলারের বিপরীতে রুবল শক্তি ফিরে পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক তাতিয়ানা রোমানোভা।

যেহেতু ইউরোকে রুবলে কনভার্ট করে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানী ক্রয় করতে হয়, সেজন্য রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে।

সেজন্য রুবলের চাহিদা বেড়েছে। এর ফলে রুবলের দামও বেড়েছে।

রাশিয়ার ভেতরে নানা পদক্ষেপ
এছাড়া রুবলের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে রাশিয়ার সরকার দেশের ভেতরে আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী রাশিয়ায় কর্পোরেট শেয়ার এবং সরকারি বন্ড ক্রয় করেছে।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরে তারা সেগুলো বিক্রি করে দিতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা যাতে সেটি করতে না পারে সে পদক্ষেপ নিয়েছে পুতিন সরকার।

এর ফলে একদিকে যেমন রাশিয়ার স্টক ও বন্ড মার্কেটের পতন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে, অন্যদিকে মুদ্রা দেশের বাইরে যেতে পারেনি।

এসব কিছু রুবলের পতন ঠেকিয়ে রেখেছে।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার দ্বিগুণ বাড়িয়েছে।

যারা রুবল বিক্রি করে ডলার বা ইউরো কিনবেন না, অর্থাৎ রুবল সঞ্চয় করবেন, তাদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে।

রাশিয়ার অনেক কোম্পানি বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যবসা করে ডলার, ইউরো এবং ইয়েন আয় করছে। কিন্তু এখন রাশিয়ার কোম্পানিগুলো বিদেশে ব্যবসা করে যে আয় করবে তার ৮০ শতাংশ রুবলে কনভার্ট করে নিতে হবে। এর ফলে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের একটি বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে।

রাশিয়ার কোনো নাগরিক যাতে দেশের বাইরে অর্থ নিতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিয়েছে পুতিন সরকার।

কারণ দেশের বাইরে অর্থ পাঠাতে হলে সেটি ডলার বা ইউরোতে পাঠাতে হতো।

যেহেতু সেটি বন্ধ করা হয়েছে, সেজন্য ডলার বা ইউরোর চাহিদা কমেছে। ফলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ভেতরে রয়ে গেছে।

এটি রুবলের দরপতন ঠেকাতে সাহায্য করেছে।

তবে এ নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।

অধ্যাপক তাতিয়ানা রোমানোভা বলছেন, কোনো ব্যক্তি এখন চাইলে নগদ ১০ হাজার মার্কিন ডলার ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারবেন। কিন্তু এর বেশি পারবেন না।

রুবল কতদিন শক্তিশালী থাকবে?
বর্তমানে এক মার্কিন ডলার সমান ৬২ রুবল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রুবল যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে তাতে এক ডলার সমান ৫০ রুবল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য চায় না যে রুবল বেশি শক্তিশালী হোক।

কারণ, রুবল বেশি শক্তিশালী হলে তেল-গ্যাস রফতানি বাবদ রাশিয়ার আয় কমে যাবে।

কারণ রাশিয়ার বাজেটের একটি বড় অংশ আসে রফতানি আয় থেকে।

এজন্য রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব বিধি-নিষেধ জারি করেছিল সেগুলো কিছুটা শিথিল করেছে। কিন্তু তারপরেও রুবল শক্তিশালী হওয়া ঠেকাতে পারছে না।

তবে রুবল শক্তিশালী হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয় এবং এটি কতটা দীর্ঘমেয়াদি হবে তা নিয়ে সংশয় আছে।

অধ্যাপক তাতিয়ানা রোমানোভা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ডলারের বিপরীতে রুবলের যে বিনিময়মূল্য সেটি বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, বাজারের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতির মাধ্যমে এটি নির্ধারিত হয়নি।

বাজারে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এটি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক তাতিয়ানা রোমানোভা।

সূত্র : বিবিসি