Naya Diganta

সংশয়

বেশ কিছু দিন ধরেই আলিয়া লক্ষ্য করছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে প্রতিনিয়ত তাকে দেখছে। বেশ কিছু দিন ধরে এমন ঘটনা। অফিসের স্টপেজে নামা না পর্যন্ত ছেলেটির চোখ সবসময় তার দিকে। ছেলেটি প্রায়ই মুখোমুখি সিটগুলোতে বসে, পাশের সিট খালি থাকলেও কখনোই আলিয়ার পাশে বসে না। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। আজকালের পরিবেশ দেখে সতর্ক থাকা ভালো।
বাস থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাল আলিয়া। ছেলেটি তাকে অনুসরণ করছে কি না। প্রতিদিনই নতুন নতুন খবর আসে, এখন ঘর থেকে বের হতেও ভয় লাগে। ব্যাপারটি কয়েক দিন অবহেলা করেছে; কিন্তু আজ যখন মনোযোগ দিলো তখন মনে হলো ছেলেটির চোখ শুধু তার দিকে বা জানালার বাইরে।
আলিয়ার বয়স ৩৭ বছর। দুই সন্তানের মা হয়েছে। ছেলেটির বয়স অনুভব করল ২২-২৩। চেহারায় নিষ্পাপতা এবং চোখে বিনয়। তার পরও ছেলেটির এভাবে তাকানো দেখলে অদ্ভুত লাগে। কিন্তু তাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকল আরও কয়েক দিন। হঠাৎ ছেলেটি আসা বন্ধ করে দিলো। ছয় দিন ছেলেটির দেখা মিলল না।
আজ রোববার। অফিস ছুটির পর ছেলেটিকে দেখতে পেল। একইভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ তার নিষ্পাপ চোখ লাল, মুখটাও নেমে এসেছে, যেন সে খুব অসুস্থ। আজ তার পাশের সিট খালি। নিজেকে সংযত করতে না পেরে আলিয়া ছেলেটির পাশের সিটে বসল। প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগল। তারপর মুখে হালকা হাসি এনে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে এই ক’দিন দেখিনি, তুমি কি অসুস্থ ছিলে?
ছেলেটি জবাব দিলো না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। আলিয়া আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? তুমি ঠিক আছো?
ছেলেটির থেকে কোনো সাড়া নেই। এবার আলিয়া রেগে বলল, তোমার লজ্জা হয় না আমার সামনে বসে রোজ আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে?
ছেলেটি ঘুরে আলিয়ার দিকে তাকাল। তার নোট বইয়ে কিছু লিখে বাড়িয়ে দিলো। কাগজে লেখাÑ আমি শুনতে বা বলতে পারছি না, যা বলতে চান তাই লিখুন।
আলিয়া নিজের আচরণের জন্য আঘাত পেল। সে নোটবুকে লিখলÑ অসুস্থ ছিল?
ছেলেটি লিখলÑ জি, ভাইরাস জ্বর, এখন আমি ভালো আছি।
পরের প্রশ্ন দিয়ে লেখার প্রক্রিয়া শুরু হলো। তারপর স্টপেজে পৌঁছানোর পরেই থেমে গেল। ছেলেটি তার পুরো জীবন আলিয়ার সাথে শেয়ার করল। বাড়িতে সে আর তার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। তিন বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় তার মা এবং তার বাকশক্তি চিরতরে হারিয়ে যায়। ওই দুর্ঘটনার পর কথা শোনা বা বলা বন্ধ হয়ে যায়।
ছেলেটির ঘটনা জেনে আলিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সারাদিন অফিসে মনটা নিভে গেল। রাতেও ছেলেটির কথা ভাবল। আরো ভাবল, পরের দিন জিজ্ঞেস করবে কেন সে শুধু তার দিকেই তাকায়।
পরের দিন ছেলেটি এলে আলিয়া ইশারায় তার পাশের সিটে বসতে বলল। ছেলেটি আনন্দিত হয়ে বসল। আলিয়া খাতা চাইল। কলম আর খাতা পেয়ে তাকিয়ে দেখল ছেলেটি বারবার তাকে দেখছে। আলিয়া লিখলÑ এতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে কেন? আশপাশে আরো অনেকেই তো আছে। শুধু আমার দিকেই তাকাও কেন?
জবাবে ছেলেটি কিছু লিখল না। পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে আলিয়াকে দিলো, তাতে একটা ছবি। ছেলেটা আর ওর মা। মনোযোগসহকারে তাকাল, তার মায়ের চেহারা আলিয়ার সাথে অনেক মিল! চুল বাঁধার পদ্ধতি, মুখের গড়ন, সবই প্রায় তার মতো। ভাবল, ছেলেটিকে এখন কী বলবে?
ছেলেটি তার খাতাটা আলিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো। তাতে লেখাÑ মা চলে গেছে, দেখতে পাচ্ছি না; কিন্তু প্রতিদিন কিছুক্ষণ আপনার দিকে তাকালে মনে হয় আমি আমার মাকে দেখেছি।
তারপর নিচে লিখলÑ আপনার যদি কোনো সমস্যা হয়, আমি আর কখনো আপনার বাসে উঠব না।
আলিয়া ছেলেটির সরলতা দেখে হাসল। ‘সমস্যা নেই, কাল থেকে আমার সাথে বসো’ লিখে তার খাতা ফেরত দিলো।