Naya Diganta

ইইউ চায় গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন

গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ২৭টি দেশের এই জোট বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশনকে স্বাগত জানানোর বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। একই সাথে সক্রিয় নাগরিক সমাজকে গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সংস্থাটি।
ব্রাসেলসে গত শুক্রবার বাংলাদেশের সাথে যৌথ কমিশনের বৈঠক শেষে ইইউ এই মনোভাব পোষণ করেছে। এতে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও ইইউয়ের এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাওলা পাম্পালোনি। যৌথ কমিশনের বৈঠকে আগে মানবাধিকার ও সুশাসন, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন সহায়তাÑ এই তিনটি সাব-গ্রুপ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব যৌথ কমিশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। আর মানবাধিকার ও সুশাসন বিষয়ক সাব গ্রুপে আইন বিভাগের সচিব, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক সাব গ্রুপে বাণিজ্য সচিব এবং উন্নয়ন সহায়তা বিষয়ক সাব গ্রুপে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নেতৃত্ব দেন।
যৌথ কমিশন বৈঠকে সুশাসন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, রোহিঙ্গা সঙ্কট, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা, অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী মাসে ঢাকায় প্রথম ইইউ-বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।
বৈঠকে ইইউ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইইউ বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। জোটটি বাংলাদেশে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হওয়ার ব্যাপারেও উদ্বেগ জানিয়েছে। ইইউ বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে (ডিএসএ) কেবল ডিজিটাল অপরাধ মোকাবেলায় সীমাবদ্ধ রাখা এবং আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে।
যেকোনো ডিজিটাল অপরাধের লাগাম টানার ক্ষেত্রেও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা থাকার বিষয়টি স্মরণ করে ইইউ মন্তব্য করে, চূড়ান্ত পদক্ষেপ ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা তথা সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ জরুরি।
ইইউ মনে করে জাতি, বয়স, লিঙ্গ পরিচয়, যৌন অভিমুখিতা, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সম্বন্ধ, অক্ষমতা বা আর্থসামাজিক পটভূমি নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে মানুষের মানবাধিকারের সুরক্ষা, স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ক্রমাগত উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও ইইউ সংখ্যালঘুদের অধিকারের অগ্রগতি, নারী ও শিশুদের অধিকার এবং বহুপক্ষীয় ফোরামে মানবাধিকারের বিষয়ে সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে।
বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বলেছে, সরকার সংবিধানে অনুযায়ী সবার জন্য মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি রয়েছে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সফলতা রয়েছে।
যৌথ কমিশন বৈঠকে বলা হয়েছে, ইইউর বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধার (জিএসপি) আওতায় ইবিএ স্কিমে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। তবে একই সাথে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, এই বাজার সুবিধার সাথে শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার শর্ত জড়িত। ইইউ বলেছে, বাংলাদেশে শ্রম অধিকারের টেকসই সংস্কারের পাশাপাশি আইন ও বিধানগুলো আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে ইইউ শ্রম খাতে বাংলাদেশের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত ও তা প্রকাশ করাকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী বাস্তবায়ন, এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির বিষয়ে নির্দিষ্ট সময় পর পর তথ্য জানানো এবং রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) প্রযোজ্য শ্রম আইন সংশোধন করার সময়সীমা এগিয়ে আনার ওপর ইইউ জোর দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিরাপদ ও সবুজ কারখানায় বিনিয়োগের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে উভয় পক্ষ একটি পূর্বাভাসযোগ্য ও টেকসই ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এই পরিবেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে সহজ করবে, বাজারে প্রবেশের বাধা দূর করবে এবং অর্থনীতির টেকসই বহুমুখীকরণ উৎসাহিত করবে। এই লক্ষ্যে ইইউ ও বাংলাদেশ ব্যবসা পরিবেশ নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।
যৌথ কমিশন ইউরোপে অনিয়মিত হয়ে পড়া বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠাতে ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে সই হওয়া স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) অনুযায়ী কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছে। ইউরোপে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশীদের এসওপি অনুযায়ী ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশকে উৎসাহিত করেছে ইইউ।
চার বছরের বেশি সময় ধরে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে ইইউ। এর পাশাপাশি তারা রোহিঙ্গাদের, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। উভয় পক্ষ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তন এবং বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রয়োজনীয় সাহায্য, সহযোগিতা ও পরিষেবা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছে।
বৈঠকে উভয় পক্ষ আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন ও জাতিসঙ্ঘসহ বহুপক্ষীয় ফোরামে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছে। এ ছাড়া ইইউর ‘দক্ষতা ও প্রতিভা’ প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইইউ বলেছে, এই প্যাকেজ আইনসম্মত অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ অংশীদার দেশগুলোর সাথে একটি নতুন এবং আরো কৌশলগত সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করবে।