Naya Diganta

দুখু মিয়ার ছেলেবেলা

দুখু মিয়ার ছেলেবেলা

আমাদের প্রিয় কবি, বিদ্রোহী কবি এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের পর বাবা-মা আদর করে দুখু মিয়া নামে ডাকতেন। ফুটফুটে এই দুখু মিয়ার ছেলেবেলা কেমন ছিল তাই নিয়ে আমার এই লেখা ।
দুখু মিয়া ছেলেবেলা থেকেই দুঃখে কষ্টে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আর প্রতিকূল পরিবেশেই বড় হয়েছেন। তিনি বাংলা ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ (২৪ মে ১৮৯৯ খ্রি: রোজ মঙ্গলবার) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কাজী ফকির আহমেদ, মাতা জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন দুখু মিয়া।
দুখু মিয়ার পিতা কাজী ফকির আহমেদ মসজিদের ইমামতি এবং মক্তবে শিক্ষকতা করতেন। দুখু মিয়ার বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন তাকে পড়াশোনার জন্য মক্তবে ভর্তি করালেন। দুখু মিয়ার চাচা বজলে করিমের কাছে পড়েছেন ফারসি আর উর্দু। পড়াশোনার শুরুতেই ১৩১৪ সালের ৭ই চৈত্র তার বাবা কাজী ফকির আহমেদের মৃত্যু হয়। অকালে বাবার মৃত্যুর পর থেকেই নেমে আসে দুখু মিয়ার জীবনে ঘোর অন্ধকার। নেমে আসে দুঃখ, কষ্ট, অভাব অনটন । সর্বোপরি সংসারের পুরো বুঝা এসে পড়ল দুখু মিয়ার কাঁধে। এই বয়সে কি করবে, কোথায় যাবে ভেবে অস্থির হয়ে পড়ল দুখু মিয়া। অবশেষে চাকরি নিলেন বাবার মক্তবেই। মেধাবী দুখু মিয়া ধৈর্যহারা না হয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে মক্তবে শিক্ষকতা ও মসজিদের ইমামতি এবং হাজী পালোয়ানের মাজারে খাদেম গিরির দায়িত্ব বুঝে নেন। ছোট এই বয়সেই শুরু হলো তার কষ্টের জীবন।
দুখু মিয়ার চাচা লেটো কবি সৈয়দ বজলে করিম লেটো কবি চকোর গোদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। দুখু মিয়া তখন মুখে মুখে গান ও ছড়া বানাত। এই প্রশংসায় রাতারাতি তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। লেটো দলের অনেকেই বলল গান লেখ আমাদের জন্য, পারলে পালাগানও লেখো। দুখু মিয়া শুরু করলেন গান, ছড়া, কবিতা, আর পালাগান লেখা। এতে তাঁর আয় বেড়ে গেল, অভাবও কিছুটা দূর হতে লাগল।
এই মক্তবের পর নিম্ন প্রাইমারি পরীক্ষায় পাস করে কিছু দিন বিরতির পর ১৯১০ খ্রি: শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে ভর্তি হন। অভাবের কারণে এর পরও পড়া হয়নি। শেষে মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। এবং বিনা বেতনে দুই বছর পড়াশোনা করেন।
আর্থিক অভাব অনটনের কারণে দুখু মিয়ার লেখাপড়া বার বার বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। তবে বন্ধ হয়নি লেটোদলের গান রচনা। দুখু মিয়ার গান শুনে মুগ্ধ হন ট্রেনের একজন গার্ড। গান শুনে দুখু মিয়াকে চাকরি দেন গার্ড সাহেবের ব্যক্তিগত কাজের জন্য । তবে খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি সে চাকরি। পরে একটি রুটির দোকানে চাকরি পায় দুখু মিয়া। খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে রুটির দোকানে চাকরি করলেও ঘুমাতে হতো সিঁড়ির নিচে। এই দোকানের পাশেই থাকতেন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজ উল্লাহ। তার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে কাজির শিমলা গ্রামে। ঘুমন্ত দুখুকে একদিন সিঁড়ির নিচে দেখেন রফিজ উল্লাহ। রফিজ উল্লাহ দুখুর মুখে শুনেন তার পারিবারিক কষ্টের কাহিনী। এই কাহিনী শুনে রফিজ উল্লাহর অনেক মায়া হয় এবং দুখু মিয়াকে ত্রিশালের নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ১৯১৪ সালে দুখুকে ভর্তি করে দেন। দুখু মিয়ার বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর, বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে দুখু মিয়া দ্বিতীয় হন। রেজাল্ট শেষে দুখু মিয়া মায়ের কাছে ফিরে যান কিন্তু বাড়ি থেকে আর ময়মনসিংহে ফিরে আসেননি। ময়মনসিংহে না ফিরে দুখু মিয়া পড়ালেখা চালিয়ে নিতে ভর্তি হন রানীগঞ্জ শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে ৯ম শ্রেণীতে । আর তার খরচের জন্য বৃত্তি পান রাজবাড়ী থেকে মাসে ৭ টাকা। ১৯১৭ সালে দুখু মিয়ার ম্যাট্রিক পরীক্ষা । বিশ্বে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এসময় দেখা গেল তার বয়সী ছেলেরা যুদ্ধবিদ্যা শিখতে যাচ্ছে। দুখু মিয়া ছুটলেন কলকাতায়। নাম লেখালেন সৈনিকে। দুখু মিয়া সৈনিক বেশে যোগ দিলেন ৩৯ নম্বর বাঙ্গালি পল্টনে। তাঁর কাজে দক্ষতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে হাবিলদার থেকে মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন।
১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে বাঙ্গালি পল্টন ভেঙে দেয়া হয়।
সৈনিকজীবন শেষে বাংলা সাংস্কৃতিক জগতে নান্দনিকতা ও স্বাধীনতার এক মুকুটবিহীন স্রাট হয়ে দুখু মিয়া থেকে বরেণ্য কবি, গীতিকার ও লেখক হয়ে ফিরে এলেন কাজী নজরুল ইসলাম হিসেবে। প্রবেশ করলেন বাংলা সাহিত্যে। লিখতে শুরু করলেন একের পর এক কালজয়ী গান, কবিতা ও গল্প। বিদ্রোহী কবিতা লিখে হলেন বিদ্রোহী কবি। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা “চল চল চল” কবিতাটি বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। কবি নজরুলকে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এনে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। ১৯৭৪ সালের ৯ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে কবি নজরুলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রি “ডিলিট” প্রদান করা হয়। ১৯৭৫ সালে ২২শে জুলাই কবি অসুস্থ হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের জন্য পিজি হাসপাতালে (১১৭ নং কেবিন) স্থানান্তর করা হয়। অসুস্থ কবি ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন এবং কবির একটি বিখ্যাত গানের বাণী “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই” অনুযায়ী মসজিদের পাশেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়।