Naya Diganta

অর্থনীতির ভঙ্গুরতা ও দুর্বহ জীবনযাত্রা

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার নানা ক্ষেত্রে ভঙ্গুর অবস্থার সঙ্কেত দেখা দিতে শুরু করেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রফতানি আয়ের পরও আমদানি ব্যয় রেকর্ড হারে বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। অর্থনীতির বিপর্যয় ঠেকানো খাত হিসেবে পরিচিত রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত। এর প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক বিনিময় হার ও রিজার্ভের ওপর। ডলারের মূল্য অচিরেই ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এতে এক দিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছতে পারে। অন্য দিকে বিশ্বব্যাংক এডিবির মতো বহুজাতিক সংস্থার বেয়াতি ঋণ অব্যবহৃত রেখে চীন রাশিয়া ভারতের মতো দেশ থেকে কঠিন শর্তের বাণিজ্যিক শর্তের ঋণ গ্রহণের ফলে বিদেশী দায় ও ঋণের উল্লম্ফন ঘটছে। এটি পরবর্তী তিন বছরে দুঃসহ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে বলে বেসরকারি নীতি গবেষণা সংস্থা সিপিডি সতর্ক করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে কয়েকটি খাতে বিশেষভাবে বিপর্যয়কর অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে এক দিকে সামষ্টিক অর্থনীতির স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ব্যবস্থাপনায় সঙ্কট দেখা দিচ্ছে অন্য দিকে নতুন বছরের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এমনকি স্থূল দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দেয়া হচ্ছে তার সাথে অর্থনীতির অন্য অনেক সূচকের মিল পাওয়া যাচ্ছে না।

দুঃসহ জীবনযাত্রা ও ডলার নিয়ে অস্থিরতা
সরকারিভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি তথা মূল্যস্ফীতির যে হিসাব প্রকাশ করা হয়, তার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির প্রায়শ মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন সেটি আরো অবনতি ঘটেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে মার্চ নাগাদ বারো মাসের আবর্তক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬.২২ শতাংশের মতো। কিন্তু গত বছরের তুলনায় খাদ্যশস্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ শতাংশের উপরে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভোজ্যতেল, গম, আটাসহ অধিকাংশ আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি আসলে কত হচ্ছে সেটি পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের বাইরে কেবল অনুমান করা যায়। সিপিডির অনুমান অনুসারে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি সরকারের ঘোষিত হারের দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা। শিগগিরই তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বেশ কিছু কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। প্রথমত ডলারের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মূল্য নির্ধারণের পর ডলারের দাম ৮৭ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ব্যাংক থেকে এলসির জন্য বিকল্প উৎস থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে ৯৭ টাকা পর্যন্ত দরে। বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন ব্যাংকগুলোকে তাদের প্রয়োজন অনুসারে ডলার সরবরাহ করে আসছিল; কিন্তু রিজার্ভে টান পড়ায় এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এতে ডলারের প্রাপ্তিমূল্য বেড়ে যাচ্ছে।
আইএমএফ টাকা ও ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বের করে প্রতিযোগী মুদ্রাগুলোর মূল্যমান বিবেচনা করে। এ সম্পর্কে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করে। আইএমএফ-এর একটি সূত্র জানিয়েছে, এখন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার (রিয়ার) দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকার মতো। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিয়ার দেখে বিনিময় হার নির্ধারণ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতদিন ডলারের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এর দাম নিম্ন পর্যায়ে রাখতে সক্ষম হয়। প্রধানত করোনা পরিস্থিতির কারণে আমদানির চাহিদা কম থাকা এবং বিগত অর্থবছরে উচ্চহারে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং রফতানি মোটামুটি একটি পর্যায়ে থাকায় এটি সম্ভব হয়েছিল।

লেনদেনের ভারসাম্যে শঙ্কা
চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে এসে চিত্র বিপরীত দিকে যেতে শুরু করেছে। আগের অর্থবছরে রেমিট্যান্স যেখানে ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবার সেখানে অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে সোয়া ১৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গত বছর আমদানি বেড়েছিল পৌনে ২০ শতাংশ, এবার ৯ মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে পৌনে ৪৭ শতাংশ। আর গত বছর রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৫ শতাংশ আর এবার ৯ মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৩ শতাংশ। পণ্য ও সেবা খাতের আমদানি রফতানির ব্যবধানে বিগত অর্থবছর জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে সাড়ে ৫৫ কোটি ডলার চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪০৭ কোটি মার্কিন ডলার।
আমদানি চিত্রের গভীরে গেলে স্পষ্ট হবে- আগামীতে এই ঘাটতি আরো বাড়বে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বর্ধিত বিল এখনো পরিশোধ করা হয়নি। ফলে মার্চ নাগাদ আমদানি বিলে পেট্রলিয়াম খাতের আমদানি ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম দেখা যাচ্ছে। যদিও ভোজ্যতেল খাতে ব্যয় ৭০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ সময়ে গমের জন্য ব্যয় ২৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। ভারত রফতানি বন্ধ করায় বিশ্ববাজারে গমের দাম আরো বেড়েছে। ফলে এ খাতের খরচও বাড়বে। বিবেচ্য সময়ে চাল আমদানি ২১ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু বন্যা ও অন্যান্য কারণে ফসলহানির ফলে এবার চাল আমদানি বেড়ে যাবার আভাস দেয়া হচ্ছে। এটি হলে চালের জন্যও ডলার খরচ করতে হবে। আরেকটি প্রবণতা হলো তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট কাঁচামালের আমদানি বেড়ে যাওয়া। উচ্চ হারের রফতানি আয়ের সাথে সাথে এই খাতের আমদানি ব্যয় ৯ মাসে ৭৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, পরিমাণগতভাবে আমদানি না বাড়লেও ডলারের অঙ্কে আমদানি অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ, রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বছরের শেষ অবধি চলবে বলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ হলো, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যশষ্যসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির যে ধারা এখন চলছে তার অবসানের সম্ভাবনা স্বল্প মেয়াদে থাকছে না। আর এতে চলতি হিসাবের ঘাটতি বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে রিজার্ভের ওপর। রিজার্ভে চাপ কমানোর জন্য সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু আমদানি বৃদ্ধির পেছনে মূল অবদান হলো জ্বালানি তেল ও খাদ্যশস্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। এসব পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য আমদানি এলসি মার্জিন কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদের বিদেশ ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংককে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে; কিন্তু এত কিছুর পরও রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করা কঠিন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রদর্শিত রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। প্রতি মাসেই দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত সেটি নিয়ে রয়েছে বিতর্ক।
আইএমএফ-এর এক সূত্র মতে, যে পরিমাণ রিজার্ভ দেখানো হচ্ছে তা থেকে ব্যবহার অযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগকৃত রিজার্ভ রয়েছে ২০০ মিলিয়ন ডলার, চুরি যাওয়া রয়েছে ১০ কোটি ডলার। এ ছাড়া রিজার্ভ হিসেবে রক্ষিত স্বর্ণ তাৎক্ষণিক দায় মেটানোতে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এতে করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো দাঁড়ায় বলে ধারণা করা হয়, যা দিয়ে আমদানি বিল বর্তমান পর্যায়ে থাকলেও আড়াই মাসের মতো মেটানো যাবে। তিন মাসের কম আমদানি বিল মিটানোর রিজার্ভকে বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অবস্থা সামনে রেখে কাতার থেকে এলএনজি কেনার বিল পরিশোধ না করে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও এভাবে সভরেন গ্যারান্টিকৃত আমদানি বিল পরিশোধ পিছিয়ে দেয়ার অবস্থায় বাংলাদেশ নিকট অতীতে পড়েনি। আর এতে দেশের দায় পরিশোধে সক্ষমতার রেটিং নিচে নেমে যায়।

ইউক্রেন যুদ্ধের ঘনীভূত বিপদ
ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকার অর্থ হলো জ্বালানি তেলের মূল্য কমার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। আর এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট আরো বাড়বে। ডলারের দাম শিগগিরই ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আর সঙ্কট মধ্যমেয়াদে চললে তা ১২০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।
ডলারের সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধি এড়ানোর জন্য এর সরবরাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চলতি হিসাবের লেনদেনের বাইরে বিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণ নিয়ে এতদিন পর্যন্ত ডলারের সঙ্কট মোকাবেলা করা হতো। বিদেশী দায়দেনা একসময় জিডিপির তুলনায় নিরাপদ মাত্রা তথা ৪০ শতাংশের অনেক নিচে থাকার কারণে এটি সম্ভব হচ্ছিল। অর্থমন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশী দায়ের স্থিতি ছিল জিডিপির ১২.১ শতাংশ আর রফতানি আয়ের ৯০.৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুসারে ডিসেম্বর ২০২১ নাগাদ বিদেশী দেনা ৯১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। এই বিদেশী দায় জিডিপির ৪৫ শতাংশ এবং রফতানি আয়ের ২০০ শতাংশের মতো। জিডিপির ৪০ শতাংশ এবং রফতানি আয়ের ১৫০ শতাংশের বেশি বিদেশী দায়কে অনিরাপদ মনে করা হয়। ২০২১ সালের শেষ ৬ মাসে ৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বস্তিকর মাত্রা অতিক্রম করার পর প্রধানমন্ত্রী বিদেশী দায়দেনা যাতে আর না বাড়ে তার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন; কিন্তু আমদানি দায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে সেই নির্দেশনা অনুসরণ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অনিশ্চিত গন্তব্য, ত্রিমুখী শঙ্কা
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে চীনের সাথে ছয় বিলিয়ন ডলার বিশেষ ঋণসহায়তার ব্যাপারে নেপথ্য আলোচনার কথা জানা যাচ্ছে। এই সহায়তার ব্যাপারে যেসব শর্ত দানের কথা জানা যাচ্ছে তা অন্য কূটনৈতিক অংশীদাররা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। অন্য দিকে চীনের ব্যয়বহুল ঋণসহায়তার বিকল্প রয়েছে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ গ্রুপের সাথে কার্যকর সমঝোতায় পৌঁছানো। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ একটি আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় সংস্থা হলেও এই প্রতিষ্ঠান কার্যত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অবাধ মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আর মানবাধিকার বজায় রাখার শর্ত দেয়া হয়েছে বর্তমান সরকারকে। শাসকদলের অনেকে এই শর্ত মেনে নেয়ার অর্থ ক্ষমতা হারানো হিসেবে বিবেচনা করে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক আইএমএফ-এর সাথে বোঝাপড়ায় যাওয়ার পদক্ষেপ সরকার কতটা নেবে নিশ্চিত নয়। আর বলয় পরিবর্তনের যে চাপ ইউক্রেন যুদ্ধের পর প্রবল হয়ে উঠেছে তা করার আরেকটি অর্থ হলো শ্রীলঙ্কার মতো চীনা অক্ষের সহায়তা শুকিয়ে যাওয়া। এই অবস্থায় সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের নীতি বিকল্প একবারেই সীমিত হয়ে আসছে।
এখন অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থায় বাংলাদেশ পড়ে যাচ্ছে তাতে তিনটি দিকে সঙ্কট ঘনীভূত হতে পারে। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে, যার কারণে আমদানি বিল মেটানো অথবা বিদেশী দায় পরিশোধে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি হলে বৈদেশিক বিনিময় হারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
দ্বিতীয় সঙ্কট দেখা দিতে পারে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় গ্যাস বিদ্যুৎ সারের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব খাতে যে ভর্তুকি সরকারকে দিতে হচ্ছে সেটি চালিয়ে যাওয়ার অবস্থা থাকছে না। বাজেটের আগে বা পরে গ্যাস বিদ্যুৎ পানি সার প্রভৃতি পরিষেবার মূল্য বাড়ানো হতে পারে। এটি ঘটলে এর গুণিতক প্রভাবে সব পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে।
সাধারণভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় যখন বাড়ে তখন সরকার চাকরীজীবীদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতনভাতা কমে গেছে। বেকার ও আধা বেকার হয়ে পড়েছে অনেকে। এই অবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির দুষ্টচক্র জনজীবনের দুর্ভোগ বাড়াবে। শ্রীলঙ্কায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
তৃতীয় যে দৃশ্যপট দেখা দিতে পারে সেটি হলো দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্কট। আগামী মাসের প্রথম দিকে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। চলতি বছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় বাস্তবে আয় তার চেয়ে অনেক পিছিয়ে। ৪২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানো গেছে ১০ মাসে। শেষ দুই মাসেও নাটকীয় কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই। ফলে নতুন অর্থবছরের বাজেটকে ন্যূনতম বাস্তবভিত্তিক করতে হলেও রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হবে তা প্রকৃত মূল্য তথা জিডিপির সাথে তুলনা করা হলে নিম্নমুখী হবে। আর রাজস্ব আয় কমলে ব্যয়ের খাতগুলোরও রাশ টেনে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যয় হয়তো খুব একটা কমানো যাবে না; কিন্তু উন্নয়ন ব্যয়ের বরাদ্দ কমাতে হবে। সার্বিকভাবে জিডিপির সাথে তুলনা করা হলে বাজেটের আয় ও ব্যয় সবকিছুই কমবে।
আর কোনো কারণে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা দেখা দিলে তার প্রথম ধাক্কা লাগবে বাজেট বাস্তবায়নে। সব দিক মিলিয়ে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঙ্গনে একধরনের অনিশ্চিত অবস্থা ঘনিয়ে উঠছে। যার প্রভাব সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পড়তে পারে।
mrkmmb@gmail.com