Naya Diganta

‘উন্নয়নের’ প্রত্যাশা নাকি প্রবঞ্চনা?

বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু বার্ষিক আয় ২৫৪৯ ডলারে উন্নীত হয়েছে বলে সরকারিভাবে দাবি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রীর একটি বক্তব্য মনে পড়ে যায়। গত বছর নভেম্বর মাসে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, যা আমরা টের পাচ্ছি না। আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।’ মন্ত্রীর এই কথা কি আবেগের, নাকি আত্মপ্রবঞ্চনার? ভেবে পাচ্ছি না। এক অর্থে, তার কথা ঠিকই আছে।

একশ্রেণীর মানুষ টেরই পাচ্ছেন না, তারা কত ধনী হয়ে যাচ্ছেন। তাদের অর্থ প্রতিপত্তি সত্যিই রাত পোহানোর আগেই বেড়ে যাচ্ছে। এ দিকে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, হতদরিদ্র মানুষগুলো যে রাত পোহানোর আগেই দারিদ্র্যসীমার আরো নিচে নেমে যাচ্ছেন সেই তথ্য-উপাত্ত কি পরিকল্পনামন্ত্রী বা সরকারের কাছে আছে? সাফল্যের বাহাদুরি দেখানো যাদের উদ্দেশ্য, তাদের চোখে বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘রোলমডেল’। দেশের অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলো কি তাহলে ‘দারিদ্র্যের রোলমডেল’? দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না। তবে ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান অনুপাতে উন্নয়নের ফসল তো প্রায় সবই চলে যাচ্ছে ধনীদের গোলায়; আর দারিদ্র্যের অসহায়ত্ব সেই গতিতে অধিগ্রহণ করছে গরিবের উঠান-আঙিনা-বস্তির গলিপথ।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ সংস্থার মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়ে গেছে।’ পাচার হয়ে যাওয়া এই বিপুল অর্থের সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কারণ, লর্ড অ্যাকটন যেমন বহু যুগ আগেই বলে গেছেন ‘চড়বিৎ ঈড়ৎৎঁঢ়ঃং; ধনংড়ষঁঃব ঢ়ড়বিৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃং ধনংড়ষঁঃবষুৃ কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে? উন্নয়ন কেবল গুটিকয়েক মানুষের কাছেই শুধু কুক্ষিগত হচ্ছে না, উন্নয়নের সেই ফায়দা গুটিকতকের নিরাপদ ভোগের জন্য দেশের বাইরেও পাচার হয়ে যাচ্ছে। যে দেশে ধনী-গরিবের ব্যবধান যত বেশি, সে দেশের উন্নয়ন সুফল থেকে গরিবের বঞ্চিত হওয়ার প্রবণতাও তত বেশি। ক্ষমতা ও ক্ষমতার সুবিধাভোগীরাই উন্নয়নের সুফলগুলো গ্রাস করছে। অর্থাৎ প্রকারান্তরে ঔপনিবেশিক যুগের বিদেশী শাসক-শোষক কিংবা সামন্ত যুগের ভ‚স্বামীদের শোষণ-নিপীড়নের মতো একই কায়দায় বর্তমান শাসক ও ধনিক শ্রেণী সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে।

জনগণ যে গোলাম, সেই গোলামই থেকে যাচ্ছে। শাসক বদলাচ্ছে; শোষক বদলাচ্ছে; শোষণ-লুণ্ঠনের ব্যবস্থা বদলাচ্ছে না। কাজেই ধনী-গরিবের ফারাক অব্যাহত রেখে উন্নয়ন ও অগ্রগতির নহর ছুটিয়ে গরিবের কোনো লাভ হবে না। এর কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে কার্ল মার্কস সঠিক বলেছিলেন, ডব ধৎব ঢ়ড়ড়ৎ নবপধঁংব বি ধৎব ঢ়ড়ড়ৎ. ঞযবু ধৎব ৎরপয নবপধঁংব ঃযবু ধৎব ৎরপয. (দারিদ্র্যের কারণেই আমরা দরিদ্র এবং ধনী হওয়ার কারণেই ধনীরা এত ধনী)। একটি সমাজে সম্পদের অসম বাটোয়ারা ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে ওঠে এবং বলবৎ থাকে।

বড় ধরনের সমাজ বিপ্লব বা যুদ্ধ ছাড়া সমাজব্যবস্থা বদলানো যায় না। আমাদের দেশে সমাজ পরিবর্তনের একটা সুযোগ হাজার বছরের মধ্যে একবারই এসেছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়; কিন্তু সমাজের অন্তর্কাঠামো ও উপরি কাঠামো কোনো স্তরেই কোনো পরিবর্তন আসেনি এ জন্য যে, স্বাধীনতাযুদ্ধ শোষিত-বঞ্চিত-সর্বস্বহারা সাধারণ কৃষক-জনতার নেতৃত্বে হয়নি। হয়েছে বাঙালি সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উ” শ্রেণীর নেতৃত্বে। ফলে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বদল হয়েছে। বদল ঘটেছে জাতীয় আত্মপরিচিতির। রাষ্ট্র দর্শনে এসেছে রূপান্তর। তবে ধনী-নির্ধনের ব্যবধান কমানোর দর্শন সেখানে ছিল না। কারণ শোষণব্যবস্থা বা উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন যারা করতে পারতেন বা তা করা যাদের দর্শন ও অঙ্গীকার ছিল, সেই সাম্যবাদীরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মূল কর্মপ্রবাহ, কর্মকাঠামোর বাইরে।

তারা যে ঘরে বসেছিলেন বা পাক-বাহিনী ও দখলদার শাসকদের পক্ষ নিয়েছিলেন, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়; বরং বাস্তবতা ছিল ঠিক এর বিপরীতটা। যুদ্ধ তারাও করেছেন। তবে বিশৃঙ্খলভাবে, বিক্ষিপ্তভাবে। তারা ভারতের সাম্যবাদীদের নৈতিক সমর্থন পেয়েছেন; কিন্তু ভারতের সাম্যবাদীরাই ছিলেন ভারতের ধনিক-বণিক ও শাসক শ্রেণীর প্রধান টার্গেট। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তারা তাদের দেশের বামপন্থীদের খতম করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বাংলাদেশের সাম্যবাদী ধারার নেতা ও কর্মীদের অত্যন্ত সুকৌশলে বাদ দেয়া হয়, যার ফলে সাম্যবাদীরা পাক-বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রসফায়ারের খোরাক হন। বহু স্থানে সাম্যবাদীরাই ছিলেন পাক-বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের প্রধান টার্গেট। ফলে এত নিষ্ঠাবান, মেধাবী, দেশপ্রেমিক হওয়া সত্তেও তারা বেঘোরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। পৃথিবীর কোনো দেশে ১৯৬০ বা ১৯৭০ দশকে বামপন্থীরা এমন পাইকারি নিধনের শিকার হননি।

তা ছাড়া যুদ্ধের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের সুযোগ হারিয়ে বাংলাদেশ আবার সেই একই ধনবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্রনীতির ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে। সময়ে সময়ে তাই শাসক বা শাসন বদলালেও উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো বদলানোর বড় কাজটি কখনোই এ দেশে হয়ে ওঠেনি। সত্যি বলতে কী, কোথাও তা হয়নি। রাশিয়া বা চীনা বিপ্লবের আন্তর্জাতিকতার কর্মসূচি বেশিদূর এগোতে পারেনি। তা ছাড়া ‘বিপ্লব’ কোনো আমদানি-রফতানির বিষয় নয়। বিপ্লব হয়ে থাকে নির্দিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় এবং সে দেশের জনগণের দ্বারা। এ দেশের সর্বস্বহারা মানুষের কাছেই ‘বিপ্লব’ চিরকাল অচেনা ও ‘বেগানা’ হয়ে থেকেছে। এটা বিপ্লবীদের দোষ বা ব্যর্থতা নয়। সেই ব্যর্থতারই প্রতিফলন আজকের এই উৎকট ধনী-গরিবের ব্যবধান।

অন্যান্য ধনবাদী ‘বুর্জোয়া’ দেশে বিপ্লব না করেও ধনী-গরিবের ফারাক বেশ কিছুদূর পর্যন্ত কমানো সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রের কল্যাণধর্মী কর্মসূচি এবং দরদি সমাজ গঠনে সচ্ছলদের আগ্রহ ও আন্তরিকতার ফলে। ধনীর ওপর ধার্যকৃত কর-রাজস্বের ফায়দা পেয়েছে গরিব। জীবনের মৌলিক চাহিদা, যেমন অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-আশ্রয়-শিক্ষার মতো মৌলিক কর্মসূচিতে রাষ্ট্র নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছে। এ দেশে তো রাষ্ট্র নিজেই জুলুমবাজ, শোষক এবং নিপীড়ক। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের বদলে এখন রাষ্ট্র হয়েছে দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমনে সিদ্ধহস্ত। রাষ্ট্র এখানে দায় গ্রহণ করেনি; নিয়ন্ত্রণ করেছে। কল্যাণ করেনি; শোষণ নিপীড়নের দুর্গ হিসেবে অসহায় মানুষের ওপর জেঁকে বসেছে। অন্যান্য জায়গায় রাষ্ট্র ধনী-নির্ধন সবার জন্য সমান হয়; এখানে রাষ্ট্র ক্ষমতাবান ও ধনবানদের সুরক্ষাতেই অষ্টপ্রহর মশগুল। রাষ্ট্র যেখানে দরদি না হয়ে নিষ্ঠুর এবং নিবর্তক হয়, সেখানে সমানাধিকার, সুবিচার, ইনসাফ এগুলোর অস্তিত্ব থাকে কী করে? আজকে তাই সবারই একটি অভিন্ন অভীষ্ট হওয়া উচিত, কী করে রাষ্ট্রকে সাধারণ, দরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে খেটেখাওয়া সর্বস্বহারা মানুষের প্রতি দরদি এবং কল্যাণী করে গড়ে তোলা যায়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

সমাজ যখন বিভক্ত, দর্শন যখন অনুপস্থিত, কল্যাণ যখন নিখোঁজ, সচ্ছল যখন নিদরদি, ধনী যখন পিশাচ এবং ক্ষমতাবান যখন লোভী, বণিক যখন অবিবেচক এবং লুটেরা, শাসক যখন স্বার্থপর, প্রশাসন যখন নীরব অথবা শাসকের প্রতি অনুগত-তখন রাষ্ট্রকেই তো এগিয়ে আসতে হবে কল্যাণ এবং শুভ উদ্যোগের আলোকবর্তিতা নিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘বিপ্লব’ ছাড়াই কল্যাণ হচ্ছে এবং মোটামুটি সামাজিক সুবিচার বা ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। কারণ রাষ্ট্র সেখানে নিরপেক্ষ এবং দরদি ও কল্যাণী। আসুন না, আমরা সেই শেষ চেষ্টাটা করে দেখি।