Naya Diganta

রেহমান সোবহানের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের বীর মেজর জিয়া

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান

পর্ব-১
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ। স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনেও তার রয়েছে অনন্য ভূমিকা। তাকে প্রথম দেখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের (১৯৮১-৮৩) ছাত্র থাকাকালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে। বিশ্ববিদ্যালয় জিমিনেশিয়ামে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে তিনি ছিলেন মূল বক্তা। দৈনিক বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে ওই সম্মেলন কভার করেছিলাম। সে দিন রেহমান সোবহানের বক্তব্যের কিছু অংশ সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়ার জন্য সম্মেলনের চা-বিরতির সময় তার শরণাপন্ন হই। পরিচিত হয়ে বিষয়গুলো জানতে চাইলে তিনি বুঝিয়ে দেন। রিপোর্টের প্রয়োজনে কিছু প্রশ্ন করলে সেগুলোরও জবাব দেন। পরে সাংবাদিকতা পেশায় এসে বিভিন্ন সময়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও সংবাদ সম্মেলনে তার দেয়া বক্তব্য কভার করেছি। সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার ও লেখা পড়েছি। ১৯৯৫ সালে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় দেশের পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে কয়েক দফা আলোচনায় নিয়োজিত ছিলেন তারই নেতৃত্বে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত থাকার সুযোগে কাছ থেকে পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকের সেই উদ্যোগ দেখার সুযোগ হয়েছিল।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তার বই ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ কিনে পড়েছি। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) থেকে সদ্য প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনীমূলক বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড ‘আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশন্স : ফ্রম ডন টু ডার্কনেস’ বইটি। বইটি সংগ্রহ করে পড়তে গিয়ে বীর উত্তম জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গটি আমাকে কৌতূহলী করে তোলে।

রেহমান সোবহান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুরাগী ছিলেন তিনি। বইয়ে তিনি ১৯৭২ থেকে ’৭৫ এর সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। এতে বাংলাদেশের রাজনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া সম্পর্কে তার বেশ কিছু মূল্যায়ন স্থান পেয়েছে। বইয়ে তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন।

বইয়ের ২৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে প্রথমবারের মতো মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে কলকাতায় তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় সেক্টর কমান্ডার্স সামিটে। তখন পার্ক স্ট্রিটের স্কাইরুম রেস্তোরাঁয় জিয়ার সাথে কয়েক দফা আলোচনায় হয় তার।

একই উপলক্ষে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথেও তার সাক্ষাৎ হয়। রেহমান সোবহানের দৃষ্টিতে তখন চলনে বলনে খালেদ মোশাররফ ছিলেন ‘জৌলুশপূর্ণ’ (ফ্ল্যামবয়ান্ট) আর বিপরীতে জিয়াউর রহমান ছিলেন ‘স্বল্পভাষী’ ব্যক্তিত্ব (রেটিসেন্ট পারসোনালিটি)। তিনি লিখেছেন, এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হন। তখনো জিয়াউর রহমান তার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রেহমান সোবহানের সাথে দেখা করতে আসেন খালেদ মোশাররফ ও জিয়াউর রহমান। এ দু’জনকে ‘মুক্তিযুদ্ধের বীর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। লিখেছেন : ‘এটা ছিল আমার আত্মশ্লাঘার ব্যাপার যে মুক্তিযুদ্ধের এই দুই বীর সস্ত্রীক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমি তখনো এমন কোনো সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব নই যে মুক্তিযুদ্ধের এই দুই বীর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী হবেন। তবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত অনেকেই আমার বৈশ্বিক প্রচারণার খবর সম্পর্কে জানতেন।’

রেহমান সোবহান লিখেছেন, ‘এই দুই বীরের স্ত্রীরা সে সময় তার মনে তেমন রেখাপাত করতে পারেননি। খালেদা জিয়াকে খুবই লাজুক স্বভাবের মনে হয়েছে এবং তিনি পারতপক্ষে কোনো কথাই বলেননি।’

রেহমান সোবহান লিখেছেন, সে সময় বাংলাদেশের প্রতিটি সভায় মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশে বন্দী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুকে জিম্মি করতে পারে পাকিস্তান। পাকিস্তানি সেনাদের বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলোতে বন্দী করে রেখেছিল ভারতীয়রা।

রেহমান সোবহান লিখেছেন, তখন বেশির ভাগ বাংলাদেশীর মতোই জিয়া ও খালেদ উদ্বিগ্ন ছিলেন যে বাঙালির ওপর ৯ মাস ধরে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের বিচার দুরূহ হতে পারে। তারা মত দেন যে, আত্মসমর্পণের শর্তানুযায়ী পাকিস্তানি এসব যুদ্ধবন্দী ভারতীয়দের জিম্মায় রয়েছে। ভারতের ‘কৌশলগত স্বার্থ’ তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।

তিনি লিখেছেন, কথোপকথনের শেষ দিকে আমরা অনেক প্রশ্নের কোনো জবাব পাইনি। তবে জিয়া ও খালেদ দেশের অনিশ্চিত অবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। বিশেষ করে তখন মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বাইরে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র কিভাবে সামাল দেয়া হবে তা নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চিত্রকল্প এবং বাংলাদেশে ভারতের সশস্ত্র সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে তার মতামত শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পরে ভারতীয়দের ভূমিকা নিয়ে জিয়া অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় রেহমান সোবহান লিখেছেন, ‘এমনকি সেই সময়টাতেই স্পষ্টত আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা, আশঙ্কা করেন যে সদ্য স্বাধীন কিন্তু অপ্রতুল সম্পদের দেশটিতে ভারতীয়রা আধিপত্যমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। এ ধরনের মনোভাব তৈরি হওয়ার কারণ ছিল অনেক সেক্টর কমান্ডার দেখেছেন তাদের স্ব স্ব সেক্টরে তাদের ভারতীয় কাউন্টারপার্টরা কর্তৃত্ব প্রদর্শন করেছে।’ অবশ্য অনেক সেক্টরে বাংলাদেশ ও ভারতের সেনানায়করা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন।

তিনি লিখেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়। কট্টর বাম ও ডানরা রাজনৈতিক স্বার্থে প্রচার চালায় যে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ভারত কর্তৃত্ব দেখাবে।

এরপর বইয়ের ৩০৬ থেকে ৩১১ পৃষ্ঠায় রেহমান সোবহান জিয়াউর রহমানের সাথে একাধিকবার সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করেছেন। তখন রেহমান সোবহান ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। বইয়ে তিনি লিখেছেন, পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম বছরেই অফিসিয়াল আলোচনার জন্য এক দিন জিয়াউর রহমান তার সাথে সাক্ষাতের সময় চাইলে তিনি কিছুটা বিস্মিত হন। দু’জন চাপমুক্ত হয়ে কথা বলার জন্য জিয়াকে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত সময় দেন তিনি। জিয়া যখন সাক্ষাতে আসেন তখন সচিবালয়ের করিডর ছিল খালি। এ সময় জিয়া তাকে বলেন, তিনি যে এত পরিশ্রম করেছে তাতে কোনো সুফল মিলবে কি না।

পরে জিয়া উন্নয়ন বাজেট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দের জন্য রেহমান সোবহানের সাথে একটি একান্ত বৈঠকের অনুরোধ করেন। কারণ সে সময় রেহমান সোবহান ছিলেন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান। এরপর পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে জিয়ার সাথে তার আরো কয়েকবার দেখা হয়। পরে রেহমান সোবহানের অফিসে গিয়ে তিনি তাকে সস্ত্রীক তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে তার এবং খালেদা জিয়ার সাথে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। সে দাওয়াতে গিয়ে রেহমান সোবহান ও তার স্ত্রী সালমা সোবহান জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়াকে তাদের গুলশানের বাসায় আমন্ত্রণ জানান।

রেহমান সোবহান লিখেছেন, দু’টি দাওয়াতেই জিয়া দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি লিখেছেন, বেশির ভাগ বাংলাদেশী বেশি বলতে আর কম শুনতে আগ্রহী। তবে জিয়া ছিলেন বিপরীতধারার। তিনি অন্যের কথা শুনতে পছন্দ করতেন। পরে জিয়া প্রেসিডেন্ট হলে এ স্বভাবের পরিবর্তন হয় বলে তার দাবি।

সচিবালয়ে এক দিন রেহমান সোবহানের সাথে সাক্ষাৎ করে জিয়া তাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং সেখানে সড়ক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিজের চোখে দেখতে অনুরোধ করেন। জিয়া বলেন, সেখানে এ ধরনের অবকাঠামো জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। জিয়া বলেন, আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হলে তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের সড়ক হলে আদিবাসীরা মনে করবেন যে তারা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছেন। অন্য দিকে এ এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর বিচরণও সহজ হবে।

জিয়া যে কতটা দূরদর্শী ছিলেন তা পার্বত্য সঙ্কট সৃষ্টির আগেই তার অনুমান থেকে স্পষ্ট ধরা পড়ে। পরে জিয়া ক্ষমতায় এলে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। আর এতে সর্বাত্মক সহায়তা দেয় ভারত।

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর রেহমান সোবহান পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের খবর গণমাধ্যমে আসার পরপরই জিয়া তাকে ফোন করে তার সাথে সাক্ষাতের সময় চান। জিয়া তার গুলশানের বাসায় গিয়ে তার সাথে বৈঠক করেন। এটিই ছিল তাদের দু’জনের শেষ সাক্ষাৎ। এ সময় রেহমান সোবহান ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করলেও জিয়া এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বলে উল্লেখ করেছেন বইয়ে। পরে জিয়া তার কাছে বার্তা পাঠান যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও তার উৎকণ্ঠার কোনো কারণ নেই। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি রেহমান সোবহানকে আশ^স্ত করেন। এর মাধ্যমে দৃশ্যত জিয়া তাকে তার নিরাপত্তা সম্পর্কে অভয় দেন এবং তাকে দেশে থাকতে অনুরোধ করেন। তবে রেহমান সোবহান তার কথা শোনেননি। তিনি স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে যান।

বইয়ে খালেদা জিয়া সম্পর্কেও বেশ কিছু মূল্যায়ন করেছেন রেহমান সোবহান। তিনি লিখেছেন, জিয়ার সময় খালেদা জিয়া খুব সামান্যই কথা বলতেন। তিনি ছিলেন লাজুক স্বভাবের। তার ভাষায়, ‘সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাঙালি গৃহবধূর মূল্যবোধই তিনি ধারণ করতেন।’ ক্যান্টনমেন্টে জিয়ার বাসভবনে এবং ধানমন্ডিতে রেহমান সোবহানের বাড়িতে দাওয়াতে তিনি খালেদা জিয়াকে খুবই স্বল্পভাষী দেখেছেন। এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার প্রশংসা করেছেন রেহমান সোবহান। তিনি লিখেছেন, “পরবর্তী বছরগুলোতে খালেদা জিয়া দেশের ‘অন্যতম কুশলী রাজনীতিবিদ’ ওয়ান অব দ্য মোস্ট আর্টিকুরলেট অব আউয়ার পলিটিক্যাল লিডারস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তার নবজন্ম হয়।”

‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ বইটিতে ১৪০-১৪১ পৃষ্ঠায় রেহমান সোবহান লিখেন, ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ দিল্লিতে পৌঁছি। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ হয়। আমরা খবর পেতে শুরু করলাম যে, আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আসতে শুরু করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন খুবই উদ্বিগ্ন- কত দ্রুত সীমান্তে উড়ে যাবেন এবং তার দলীয় সহকর্মীদের সাথে মিলিত হবেন এ নিয়ে। তিনি আরো উদ্বিগ্ন ছিলেন এ নিয়েও- কতক্ষণে তাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন।

রেহমান সোবহান লিখেন, ‘এরকম একটি সরকারের ঘোষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই অনুভব করলাম, একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া তৈরি করা দরকার। অবশ্য এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথমে আওয়ামী লীগের আবদুল হান্নান এবং পরে মেজর জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা জনসাধারণ্যে প্রচার করা হয়েছে। এখন শুধু এ দুটোকে মিলিয়ে স্বাধীনতার একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া প্রয়োজন। স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া তৈরি করার জন্য ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আর ঘোষণাপত্রের প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে একটি পৃথক বিবৃতি তৈরি করার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ আমার ওপর দায়িত্ব দিলেন।’

রেহমান সোবহান এ বইয়ের ১৫৪-১৫৫ পৃষ্ঠায় আরো লিখেন, ‘বিদেশে আমি আমার প্রচার কাজের ফলাফলের রিপোর্ট মুজিবনগর সরকারের কাছে পেশ করার জন্য ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে সেখানে অবস্থান করছিলাম। মুজিবনগরে থাকার সময় আমি আবার মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার। এই সফরের সময়েই আমি প্রথমবারের মতো মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি ছিলেন অন্য একটি সেক্টরের কমান্ডার। জিয়ার কাছ থেকে আমি চট্টগ্রামের লড়াই সম্পর্কে বিস্তারিত শুনলাম। যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও তিনি তার বিশ্লেষণ করলেন। এ ছাড়া আমি মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানী এবং ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন খোন্দকারের সঙ্গে দেখা করলাম। মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা এবং মেজররা আমাকে এ-ও জানালেন যে, কী পদ্ধতিতে তারা গেরিলাযুদ্ধ সংঘটিত করছেন।’

‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় : একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য’ বইটিতে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী লাহোরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠক, ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন, একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো ও তাঁদের সহযোগীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের শাসনতান্ত্রিক আলোচনা এসবের বর্ণনা করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনে তার ভূমিকা, সেদিন কত বাধা ও অপপ্রচারের মোকাবেলা করতে হয়েছে তারও বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। (চলবে)

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : abdal62@gmail.com