Naya Diganta

বই পড়া

বইয়ের মাধ্যমে আপনি বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারবেন

বই পড়া অনেকেরই অভ্যাস। এই অভ্যাস গড়ে ওঠে ছাত্রজীবনেই। অভ্যাস গড়ার নিয়ম আছে। সিলেবাস-বহিভর্‚ত বই পড়তে হলে প্রথম দিকে হয়তো পড়তে হবে দস্যু মোহন সিরিজ, দস্যু বাহরাম সিরিজ, নীহার রঞ্জন গুপ্তের বইয়ের মতো বই। এরপর ‘আনোয়ারা’, ‘মনোয়ারা’, ‘আব্দুল্লাহর’ মতো গঠনমূলক বই। প্রথম দিকে যদি কেউ যাযাবরের (বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়) দৃষ্টিপাত বা অবধূতের (স্বামী কালিকানন্দ) ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’ বই পড়ে তাহলে তার বই পড়ার অভ্যাস গড়া তো দূরের কথা, বই পড়তে সে আর আগ্রহী হবে না।

নিঃসঙ্গতার একান্ত সঙ্গী হয়ে ওঠে বই। সমৃদ্ধ সঙ্গ দেয় একাকিত্বে। অবসর সময় কাটানোর জন্য বই পড়ার মতো নির্মল আনন্দ আর কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না। একটি ভালো বই একজন মানুষকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে।

আমার সংগ্রেহ 'ঞযব নড়ড়শং ঃযধঃ পযধহমব ঃযব ড়িৎষফ' নামে একটি বই ছিল। এই বইতে বিশ্বের ১৬টি বইয়ের সংক্ষিপ্ত সংকলন ছিল। বইগুলো হচ্ছেÑ প্ল্যাটোর রিপাবলিক (চষধঃড়-জবঢ়হনষরপ), অ্যাডলফ হিটলারের (ধফড়ষভ ঐরঃষবৎ-সবরহ শবসঢ়ভ), চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পেসিজ (ঈযধৎষবং উধৎরিহ-ঙৎরমরহ ড়ভ ঝঢ়বপরবং), সমারসেট মমের অব হিউম্যান বন্ডেজ (ঝড়সবৎংবঃ গধঁমযধহ-ঙভ ঐঁসধহ ইড়হফধমব), কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল (কধৎষফ গধৎী উধং কধঢ়রঃধষ), ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স (গধপযরধাবষষর ঞযব ঢ়ৎরহপব), টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস (ঞড়ষংঃড়ু ডধৎ ধহফ চবধপব), টমাস কার্লাইলের ফ্রেঞ্চ রিভল্যুশন (ঞযড়সধং ঈধৎষুষব-ঋৎপহপয জবাড়ষঁঃরড়হ), আলবার্ট আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি (অষনবৎঃ ঊরহবংঃরহব ঞযবড়ৎু ড়ভ জবষধঃরারঃু), অ্যারিস্টোটলের দি পলিটিক্স (অৎরংঃড়ঃষব ঞযব চড়ষরঃরপং). ইত্যাদি। অন্য বইগুলোর নাম এখন স্মরণ নেই। বইটির ভ‚মিকায় লেখা ছিল, ‘এই বইগুলো বিশ্বে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পরিবর্তন এনেছে।’ বইটি বাংলায় অনুবাদ করার জন্য কথা সাহিত্যিক ফকির আশরাফকে দিয়েছিলাম। তিনি মারা গেলে আমি বইটি তার কাছ থেকে আনতে পারিনি। তিনি বইটির অনুবাদ করেননি।’

বই জীবনের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। দুর্দিনে ঘনিষ্ঠরা দূরে সরে যায়; কিন্তু বই পাশে থাকার জন্য সব সময় তৈরি। কোনো কোনো বই হাসাতে পারে, আবার কোনো কোনোটি জ্ঞান দিতে পারে। কোনো বই অনেক আনন্দ ও নতুন ধ্যানধারণা দিয়ে পাঠককে মহৎ করতে পারে। মহৎ ব্যক্তির মৃত্যু এ পৃথিবীতে নেই। বইয়ে জীবন্ত প্রতীকরূপে তাদের আত্মা চলমান থাকে। বই একটি জীবন্ত কণ্ঠস্বর। বই সারা জীবনের বন্ধু।

এবারের বইমেলায় পাঠকদের অভিযোগ, মেলায় আসা নতুন বইয়ের মান বৃদ্ধি না পেলেও দাম বৃদ্ধি থেমে নেই। মৌসুমি প্রকাশকরা মেলার সুযোগ নিয়ে যেমন নবীন লেখকদের ঠকায়, তেমনি মানহীন বই বেশি দামে বিক্রি করে পাঠকদের সাথেও প্রতারণা করছে। প্রকাশকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপির সঙ্কট রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাধর্মী পাণ্ডুলিপির জন্য হাতেগোনা কয়েকজন গবেষকের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। নবীনদের মধ্যে ভালো লেখকও আছেন। কিন্তু কিছু পুরনো লেখকই পাঠকের আস্থায় স্থান করে নিয়েছেন। মেলায় পাঠকরা ঘুরেফিরে নামকরা লেখকের বই কিনছেন। নবীন লেখকদের বই বেশির ভাগই অবিক্রিত থাকছে।

সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা জামান আব্বাসী বলেছেন, ‘প্রকাশক আমার কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি নিয়ে বই প্রকাশ করেন। আমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেন না। কেউ কেউ বলে, আপনার বই খুব বেশি বিক্রি হয় না। তবু আমরা আপনার বই করব। তবে আপনাকে কিছু বই কিনে নিতে হবে।’ আবার কোনো স্টলে আমার সব বই পাঠকরা কিনে শেষ করে দেন। তবু আমি টাকা পাই না। পাঠকরা আমাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। সে জন্য প্রকাশক আমাকে কোনো টাকা না দিলেও আমি পাঠকদের জন্য লিখে যাবো।’ (নয়া দিগন্ত ২৪.০২.২০১৭) এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন আজ পর্যন্ত হয়েছে কি?

আজকাল পত্রিকার সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বই লেখা হয় দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। অভিযোগ রয়েছে কোনো কোনো পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপানোর জন্য নতুন লেখকদের সম্পাদকীয় বোর্ডে টাকা-পয়সা (‘ঘুষ’ শব্দটি খারাপ শোনায়) দিতে হয়, যা আগে কখনো ছিল না। এ অভিযোগ অকারণ নয়। আজকাল দুর্নীতি যেখানে সব সেক্টরে বিস্তার লাভ করেছে, সেখানে সম্পাদকীয় বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা এদিক থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে না। কারণ তারাও সমাজের একাংশ। টাকা খরচ করলে নিম্নমানের বইও বের করা যায়, যার ফলে মানহীন বই বের হচ্ছে। তা ছাড়া ঘটা করে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের বদৌলতে লেখার মূল্যায়ন করা যায় না। নতুন লেখকরা এই সুযোগটা নিচ্ছে, যার কারণে মানহীন বইও পাঠক সমাজে প্রচারিত হচ্ছে। মানসম্পন্ন বই মনের ক্ষুধা মেটায়।

আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেন, সংবাদ সাহিত্য কথাটাও এখন আর নতুন কিছু নয়। আগে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। এখন সাহিত্য ও সাংবাদিকতা দুই সহোদরার মতো। সাহিত্য এখন সাংবাদিকতাকে রস জোগায়। সাংবাদিকতা সাহিত্যকে বস্তুনিষ্ঠ করে তোলে। তাই সংবাদপত্রের খবর ও খবরভাষ্য এখন আর শুধু খবর নয়, তা এখন সাহিত্যের রসমিশ্রিত সংবাদ-সাহিত্য। আর সাহিত্যও সব সময় কেবল সাহিত্য নয়। তাতে পড়ে সমসাময়িকতা ও বস্তুনিষ্ঠার ছাপ। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫.৩.২২)
আমাদের কালে অবসর সময় কাটানোর জন্য ছিল বই পড়া আর বিনোদনের জন্য জীবনঘনিষ্ঠ, কল্যাণমুখী, কাহিনীনির্ভর ছবি। কোনো কোনো লেখক এমনিভাবে বই লিখেন যেন পাঠক বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়ার পর পরবর্তী পৃষ্ঠাটি পড়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং বইটি পাঠ শেষে একই লেখকের আর কোনো বই পড়ার জন্য আগ্রহ দেখায়। আমি বিমল মিত্রের লেখা, কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম, বেগম মেরী বিশ্বাস, একক দশক শতক বইগুলো রাত ২-৩টা পর্যন্ত পড়েছি। পড়তে পড়তে অনেকসময় ভোর হয়ে যেত। জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছায়াছবিটি কয়েকবার দেখেছি।

আজকাল অবসর সময় কাটানো এবং বিনোদনের জন্য কম্পিউটার, বিদেশী স্যাটেলাইট, টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, অনলাইন আরো অনেক কিছু হয়েছে। এখন পড়ার জন্য লাইব্রেরির হাজার পৃষ্ঠার বই উল্টানোর প্রয়োজন পড়ে না।

বই লেখাতে কখনো চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ থাকে, যা সাধারণ পাঠকরা সহজেই ধরতে পারে না। চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে এবারের মেলায় ‘মাতাল রাজ্জাক : গীতিমালা’ গ্রন্থটির প্রবেশ প্রদর্শন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ। বইটি সম্পাদনা করেছেন বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ড. তপন বাগচী। মরমী সাধক মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান ফাউন্ডেশনের অভিযোগ, ড. তপন বাগচী ও প্রকাশক জামাল নাসের মুকুলের যোগসাজশে ‘চৌর্যবৃত্তির’ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। (নয়া দিগন্ত ১৩.৩.২২)
ষাটের দশকে চৌর্যবৃত্তির এক মজার কাণ্ড ঘটেছিল। সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও বুদ্ধদেব বসু চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে একে অপরকে দোষারোপ করলে সে সময় জনৈক পাঠক একটি ইংরেজি বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, তারা কে কার লেখা চুরি করেছে জানি না; কিন্তু লেখাটি এই ইংরেজি বইটিতে আছে যেটি তাদের লেখার আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তারা দু’জনেই চুপ হয়ে যান। তারা দু’জনেই স্বনামখ্যাত লেখক।

শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ, প্রীতি জোর করে চাপানো যায় না। এগুলো কর্মের দ্বারা অর্জন করতে হয়। এগুলো অন্তরের বিষয়। বই পড়াও অভ্যাসের বিষয়। এর জন্য আগ্রহী হতে হবে। ভালো বই অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসতে পারে। বই বিনোদন ছাড়াও উত্তম চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে। বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা করুন। সবাই ভালো বই পড়–ন। ভালো বইয়ের বিকল্প নেই।