Naya Diganta

কুতুবমিনার নিয়েও বিতর্ক

কুতুবমিনার

ভারত ঐতিহ্যগতভাবে বহুধর্ম, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির দেশ। ভারতের সমাজ বিনির্মাণ, রাষ্ট্রগঠন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভারতে বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠীর ত্যাগ ও কোরবানি রয়েছে। কিন্তু দলীয় স্বার্থ ও রাজনৈতিক অভিলাষচরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ ধ্বংস করে দেয়ার খেলায় মেতে উঠেছে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। দিল্লির ঐতিহাসিক স্থাপনা কুতুবমিনারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। উগ্রবাদীদের দাবি, মুসলিম সম্প্রদায় গায়ের জোরে মন্দির ভেঙে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ ও মিনার তৈরি করেছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়। দিল্লির কুতুবমিনার চত্বরে পূজা করার অনুমতি দিতে আবেদন করা হয়েছিল দিল্লির আদালতে। আইনজীবীর দাবি, ওই অঞ্চলে হিন্দু ও জৈনদের মোট ২৭টি মন্দির ছিল। সেই মন্দিরগুলোতে দেব-দেবীদের পূজা হতো এবং কুতুবমিনার আসলে ছিল বিষ্ণুস্তম্ভ। তবে আদালত আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। হিন্দু মহাসভার আলিগড় ইউনিট তাদের প্রকাশিত হিন্দু নববর্ষ ক্যালেন্ডারে কুতুবমিনারের ছবির পাশে বিষ্ণুস্তম্ভ লেখা নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছে। শুধু কুতুবমিনার নয়, মুঘল আমলের সাতটি মসজিদ ও স্মৃতিস্তম্ভকে হিন্দুমন্দির বলে দাবি করা হয়েছে এই ক্যালেন্ডারে। যে তালিকায় রয়েছে তাজমহলও। তাজমহলের নামের পাশে লেখা ‘তেজো মহালয়া মন্দির।’ মধ্যপ্রদেশের কমল মৌলা মসজিদ আসলে ভোজশালা বলে দাবি করা হয়েছে। কাশির জ্ঞানব্যাপী মসজিদের ছবির পাশে লেখা বিশ্বনাথ মন্দির, জৌনপুরের আটালা মসজিদের ছবির পাশে লেখা অটলা দেবী মন্দির এবং অযোধ্যায় করসেবকদের হাতে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের ছবির পাশে লেখা রয়েছে রাম জন্মভূমি। হিন্দু মহাসভার ন্যাশনাল সেক্রেটারি জানিয়েছেন, ‘এই পবিত্র হিন্দু ক্যালেন্ডার প্রকাশ উপলক্ষে আমরা যাগ-যজ্ঞের আয়োজন করি এবং এ দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার শপথ নিই।’

উগ্রবাদীরা কুতুবমিনার কমপ্লেক্সে দু’টি গণেশ মূর্তি রেখে আসে। এগুলো অযত্নে পড়ে আছে। ন্যাশনাল মন্যুমেন্ট অথরিটি সম্প্রতি ওই দুই মূর্তি উদ্ধার করে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগকে নির্দেশ দেয়। মন্যুমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিমা দু’টি এভাবে রাখা অসম্মানজনক। কুতুবমিনার কমপ্লেক্সে দ’ুটি গণেশ মূর্তি যাতে সরানো না হয় তার জন্য দিল্লির একটি আদালত ভারতের প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগকে ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। জনৈক রিশাভা দেব মামলাটি করেন। মামলায় বলা হয়েছে যে, এটি একটি জাতীয় লজ্জার বিষয় যে ভগবান গণপতি, যিনি কোটি কোটি হিন্দুর দ্বারা পূজিত হন, তাকে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় বিতর্কিত সম্পত্তির মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। এটি ভগবান গণেশের কোটি ভক্তের অনুভূতিকে আহত করে। মন্যুমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যানের পরামর্শ অনুসারে, প্রশ্নবিদ্ধ এলাকার বাইরে ভগবান গণেশের মূর্তি পাঠানোর কোনো ক্ষমতা বা এখতিয়ার প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের নেই (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নয়াদিল্লি, ১৮ এপ্রিল, ২০২২)। ক’দিন পর কুতুবমিনারের পাশে যদি সুদৃশ্য গণেশ মন্দির গড়ে ওঠে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিগত ১৪ নভেম্বর ২০০০ সালে বিবিসি পরিবেশিত খবরে প্রকাশ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরংদল ও দিল্লি সন্ত মহামণ্ডল একসাথে রাজধানীর বিখ্যাত পর্যটক আকর্ষণ কুতুবমিনার ও কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের সামনে যজ্ঞের আয়োজন করে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আচার্য গিরিরাজ কিশোর বলেন, এ যজ্ঞের মাধ্যমে হৃদয় পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে মন্দির তৈরি করা ও মিনারের জায়গাটি যজ্ঞের মাধ্যমে পবিত্র করাই তাদের উদ্দেশ্য। দিল্লির মুসলিম শাসকদের আমলে তৈরি করা মিনারটির সামনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ওই যজ্ঞের প্রভাব দূরপ্রসারী হতে পারে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তারা ভারতবর্ষের বুক থেকে ইসলামী ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার চিহ্ন মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। মসজিদ, মিনার ও মাদরাসা ইসলামের দেড় হাজার বছরের উত্তরাধিকার- ঐতিহ্যের স্মারক। উগ্রবাদীরা পরধর্মে সহিষ্ণু নয় এবং ভারতের মতো বহুমাত্রিক সমাজে তারা মনুবাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মনুসংহিতার সমাজে অপরাপর ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অবকাশ নেই। মাদরাসার প্রাসাদ, মসজিদের গম্বুজ ও সুউচ্চ মিনার হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার পথে বড় অন্তরায় মনে করে নানা অজুহাতে এগুলোকে তারা ধুলোয় গুঁড়িয়ে দিতে চায়। মনে করে, পুরনো মুসলিম স্থাপত্য ও ইমারতগুলোকে ক্রমেই ধ্বংস করে দিতে পারলে ইতিহাসকে বদলে ফেলা সম্ভব হবে। ভারতের উত্তর প্রদেশ ও গুজরাট সরকার ‘ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন অ্যাক্ট’ নামে রাজ্যসভায় নতুন যে আইন পাস করেছে তাতে সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো মসজিদ, মাদরাসা ও মিনার স্থাপন করা যাবে না; এমনকি নিজের জমির ওপর হলেও। গোয়েন্দা সুপারিশের ভিত্তিতে উত্তর প্রদেশ ও গুজরাট সরকার নতুন মসজিদ, মাদরাসা ও মিনার নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কুতুবমিনারের পাশে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের সামনে যজ্ঞ করার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা বলেন, যজ্ঞ করা হচ্ছে জায়গাটি পবিত্র করার জন্য। সঙ্গতকারণে প্রশ্ন উঠে- মসজিদ ও মিনারসংলগ্ন এলাকা কি অপবিত্র? যজ্ঞ ও পূজা করে তাকে পবিত্র করতে হবে কেন? নিছক জিঘাংসা ও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি ছাড়া এ যজ্ঞের পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই। বিশিষ্ট গবেষক ড. এ কে এম আইয়ুব আলী বলেন, ‘কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদটি দিল্লির একটি নির্বাচিত স্থানে নির্মিত হয়। ইতিহাসবিদরা এ সম্পর্কে নিশ্চিত যে, আগে ওই স্থানে কোনো ইমারত অথবা হিন্দু মন্দির ছিল না। উপমহাদেশের বহু প্রখ্যাত আলেম ও সুফি সাধকের পুণ্যস্মৃতি ওই ঐতিহাসিক মসজিদটির সাথে বিজড়িত।’ (ইসলামী বিশ্বকোষ, অষ্টম খণ্ড, ইফাবা-১৯৯০, ঢাকা, পৃষ্ঠা-২৭০)

যজ্ঞ ও পূজা-পার্বণের এ অনুষ্ঠান প্রতিবাদহীনভাবে অব্যাহত থাকলে মসজিদ ও মিনারের স্থান স্থায়ী পূজার স্থানে পরিণত হবে, এতে মোটেই সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ বর্তমানে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনিতে ভগ্নদশায় পতিত হয়েছে। দক্ষিণ দিল্লিতে অবস্থিত কুতুবমিনার ১১৯৯-১২২০ সালের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল। ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পাওয়া কুতুবমিনার কেবল ভারতীয় উপমহাদেশেরই নয়, দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপনা হিসেবে গণ্য। কুতুবমিনারের নির্মাণকাজ শুরু করেন দিল্লির শাসক কুতুবউদ্দিন আইবেক। কিন্তু তার আমলে কেবল এর নিচতলাটিই নির্মিত হয়। তার উত্তরাধিকারী ইলতুৎমিস আরো কয়েকতলা নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক তৈরি করেন এর পঞ্চম ও সর্বশেষ তলাটি। কুতুবউদ্দিন আইবেক থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলক পর্যন্ত এর স্থাপত্যরীতিতে ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের যথাযথ ছাপ অঙ্কিত হয়েছে। তা ছাড়া এর নির্মাণপদ্ধতি ও নির্মাণকর্মে ব্যবহৃত মাল-মসলাও ভিন্ন। মধ্য এশিয়া থেকে আগত ক্যালিগ্রাফারদের হাতে তৈরি হওয়া সর্পিল বক্ররেখা ও পরিশীলিত জ্যামিতিক নিদর্শন কুতুবমিনারকে অনন্য করে তোলে। ১৩৬৮ সালে বজ্রাঘাতে কুতুবমিনারটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফিরোজ শাহ তুঘলক মিনারের পঞ্চম তলাটি মেরামত করেন, কিন্তু এর পরও মিনারটির অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। পাঁচতলাবিশিষ্ট কুতুবমিনারের দরজা পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। মিনার গাত্রে বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কেন এক হাজার বছরের পুরনো এ মিনারটির প্রতি হাত বাড়াল, এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। ১১৯৩ সালে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করার অব্যবহিত পর এ মিনার নির্মাণকাজে হাত দেন। বিখ্যাত সুফি-দরবেশ হজরত কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির নামে এ মিনারের নামকরণ করা হয়। ২৩৮ ফুট (৭২.৫ মিটার) উচ্চ এ মিনারের শীর্ষদেশ থেকে মুয়াজ্জিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আজান দিতেন। সুলতান ইলতুৎমিস ১২২৫ সালে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের দক্ষিণ পাশের আঙ্গিনার সাথে এ মিনারটিকে সংযুক্ত করে দেন। কুতুবমিনারের বহিরাবরণের ওপর পবিত্র কুরআনের আয়াত উৎকীর্ণ রয়েছে। কুতুবমিনার মুসলমানদের দিল্লি বিজয়ের স্মারকস্তম্ভ, অন্য দিকে হিন্দুদের কাছে এ মিনার পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের তিলকরেখা। সুতরাং ভারতমাতার কপাল থেকে কলঙ্কের এ তিলক মুছে ফেলতে মাঠে নেমেছে সংঘ পরিবার। পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এক হাজার বছর পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরংদল মিনারের পাশে যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করছে। কুতুবমিনার ভারতের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন। পৃথিবীর হাজার হাজার পর্যটক প্রতি বছর কুতুবমিনার, লালকেল্লা, আগ্রার দুর্গ, শাহী মসজিদ, খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া ও খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি আজমিরির মাজার জিয়ারত ছাড়া ও সাহারানপুরের দারুল উলুম দেওবন্দ, লক্ষৌর নদওয়াতুল উলামা, মুরাদাবাদের শাহী মাদরাসা পরিদর্শনের জন্য ভারত সফর করেন। এতে ভারত সরকারের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এসব ঐতিহাসিক ইমারত ও মধ্যযুগের স্থাপত্য নিদর্শন বিধ্বস্ত করে দিলে পর্যটকদের কাছে ভারতের আকর্ষণ যে হ্রাস পাবে হিন্দু মৌলবাদীরা তা বিলক্ষণ জানে। তার পরও তারা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে পারঙ্গম। কুতুবমিনারের স্থাপত্য কৌশল পর্যটকদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

এটি গঠনের দিক দিয়ে আয়তাকার হলেও সরলাকার নয়। পাঁচটি পৃথক তলায় বিভক্ত এ মিনারটি উপরের দিকে ক্রমেই সরু। এসব তলায় সর্বোচ্চতমটি ছাড়া অন্যান্য তলায় ঝুলন্ত বারান্দা রয়েছে; যার নিম্নাংশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ খোদাইকৃত শিলালিপি দিয়ে সুশোভিত। পাশ্চাত্যের গবেষক ফারগুসন বলেন, এ-জাতীয় মিনার পৃথিবীর সুন্দরতম সৌধরাজির অন্যতম। কুতুবমিনারের নির্মাণশৈলীতে আফগানিস্তানের স্থাপত্যরীতি ও ইরানি নকশা-নমুনার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

মৌলবাদী হিন্দুদের হাতে ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়ার পর গোটা মুসলিম দুনিয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। সাধারণ মুসলমানরা প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দাঙ্গায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী তৎকালীন কংগ্রেস নেতা নরসীমা রাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিধ্বস্ত মসজিদের স্থানে নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করে দেবে সরকার। এ প্রতিশ্রুতি ছিল মূলত চাণক্যসুলভ কূটনীতি ও ম্যাকিয়াভেলিয়ান রাজনীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। আরব বিশ্বে ভারত সরকার বিশেষ দূত পাঠিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে এবং নতুনভাবে মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। অথচ নরসীমা রাও তার মেয়াদকালে বাবরি মসজিদের স্থলে নতুন মসজিদ নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা বা উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এমনকি তিনি যদি পূর্বাহ্ণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, তা হলে ধর্মান্ধ হিন্দুরা এ মসজিদ ভাঙতে পারত না। কারণ এটি আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। বহুদিন ধরে আরএসএস, বজরংদল, বিজেপির করসেবক, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এ মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের হুঙ্কার দিয়ে আসছিল এবং ব্যাপক রণপ্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়ার পর মুসলিম দুনিয়া বিশেষ করে আরব বিশ্বের সরকারগুলো যদি ভারতের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করত তা হলে ভারত সরকার উচিত শিক্ষা পেত এবং সংঘ পরিবারভুক্ত উগ্রবাদীরা অন্তত কুতুবমিনার ও কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের পবিত্র অঙ্গনে পূজা ও যজ্ঞ করার দুঃসাহস দেখাত না।

ভারতের হাজার হাজার হিন্দু আরব দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে চাকরি ও ব্যবসার সাথে জড়িত। কোটি কোটি ডলারের শাকসবজি, মাছ-শুঁটকি থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল পর্যন্ত আরব বিশ্বে রফতানি হয় ভারত থেকে। মুসলিম বিশ্বকে এড়িয়ে ভারত আধুনিক যুগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। সৌদি আরব, আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, মিসর প্রভৃতি আরব দেশের ইসলামের ব্যাপারে নির্বীর্য মানসিকতা ও ঢিলেঢালা মনোভাবের ফলে ভারতের উগ্রবাদীরা আসকারা পাচ্ছে। ঈমানের এ দুর্বলতা ও আমলের এ অধঃপতনের ফলে আরবরা প্রতিবাদী ভূমিকা ছেড়ে দিয়ে বিলাসব্যাসনে মত্ত হয়ে নিজেদের গৌরবদীপ্ত অতীত হারিয়ে ফেলেছে।

ভারতের ৬৭ জন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ, কূটনীতিক ও পুলিশ অফিসার যারা কর্মজীবনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন নরেন্দ্র মোদি সরকারের উদ্দেশে লেখা এক খোলা চিঠিতে বলেন, ‘আসলে গত দু-চার বছরে যেসব কাণ্ডকারখানা চলছে তাতে আর চুপ থাকা যাচ্ছে না। আমরা আমাদের কাজ করছি- যদিও সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি। ‘ভারতে মুসলিম-খ্রিষ্টানদের মতো সংখ্যালঘুরা যেভাবে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছেন, সেটিই যে এই চিঠিতে সই করতে তাকে প্রণোদিত করছে, বিবিসি বাংলাকে স্পষ্টভাবেই তা বলছিলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক পুলিশ-প্রধান মিরন বোরওয়ানকার।’ ইদানীং আমি অনুভব করছি সংবিধান যে সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলে, এ দেশে তা মানা হচ্ছে না। সংখ্যালঘু সমাজ যে অস্বস্তিতে আছে সেটি তো দেখাই যাচ্ছে, তাদের ওপর হামলা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সাহায্য করছে না।

আমি এমন একটা দেশ দেখতে চাই, যেখানে সব ধর্ম, সব জাতির সমান অধিকার নিশ্চিত হবে- কিন্তু সেটা আজকাল আর হচ্ছে না বলেই আমাদের এখানে সই করতে হলো। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আগেও ঘটেছে, কিন্তু এখন যেভাবে দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, এখন মানুষে-মানুষে যেভাবে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, এ জিনিস আমরা ভারতে আগে কখনো দেখিনি। একের পর এক উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে। তবে ঘটনাগুলো যত না, আমরা তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন ওই সব ঘটনায় সরকারের প্রতিক্রিয়ায়। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এসব ঘটনায় হয় নীরব থাকছেন, নয়তো দায়সারা জবাব দিচ্ছেন।’ কিন্তু রাষ্ট্র যে এই সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের আবেগ বা উদ্বেগের দাম দিতে প্রস্তুত, এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে তেমন কোনো আভাস নেই (বিবিসি বাংলা, দিল্লি)।

ভারতে ১৯৯১ সালে প্রণীত প্লেসেস অব ওয়ারশিপ (স্পেশাল প্রভিশন) আইনের মাধ্যমে-১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর যেকোনো উপাসনালয়ের ধর্মীয় চরিত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, ধর্মীয় স্থাপনা বদলানো যাবে না বা দখল করা যাবে না। তার পরও কয়েকটি হিন্দু সংগঠন ও বিজেপি নেতারা মুসলিমদের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের সুশীলসমাজকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক সৌহার্দ্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com