Naya Diganta

ঢাকার ঈদ : মোগল আমল থেকে বিবর্তনের ধারায়

ঢাকার ঈদ : মোগল আমল থেকে বিবর্তনের ধারায়

ঢাকার বর্ণিল ইতিহাসের মতো বিবর্তনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে এই মহানগরের ঈদ উৎসব পালনের নানা আয়োজন। সমাজ কাঠামো আর নগর বিন্যাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলেছে ঢাকার ঈদ উৎসবের বৈশিষ্ট্য ও আচার-অনুষ্ঠান। ইতিহাসের একেক পর্যায়ে ঢাকার ঈদ পালনের বিবর্তন স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

অর্ধ-সহস্র বছর ছুঁতে যাওয়া জনপদ ঢাকা শুধু বৃহৎ বঙ্গদেশেই নয়, তাবৎ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর, ঐতিহ্যের দিক দিয়েও যে শহর অগ্রগণ্য। ৪০০ বছর আগে মোগল রাজধানীর গৌরব অর্জনেরও শতবর্ষ আগে সোনারগাঁও কেন্দ্রিক সুলতানি শাসনে বুড়িগঙ্গার তীরের জনপদ ঢাকা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। তারও আগে সচল ও সজিব জনপদরূপে ঢাকার সপ্রতিভ অস্তিত্ব এদেশের নদী ও মানুষের মতোই শত শত বছর ধরে প্রবহমান সত্তায় বিকশিত হয়েছে।

তবে, সুরম্য হর্ম্য, প্রাসাদ, দূর্গ, অট্টালিকার নগরীরূপে ঢাকার পরিকল্পিত বিকাশ মোগলদের হাতে এবং ঢাকার সামাজিক বিন্যাস ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিস্তারও মোগল আমলেই সাধিত হয়। আধুনিক ঢাকার গোড়াপত্তনকাল ধরা হয় সেটাকেই।

বাংলায়, বিশেষত নিম্ন ও পূর্ববঙ্গে মসনদ-ই-আলা ঈসাখাঁ প্রমুখ বারো ভূঁইয়া পদাধিকারী স্থানীয় নৃপতিদের দমন করে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূচনা সম্রাট আকবরের আমলে। আকবরের রাজপুত সেনাপতি রাজা মানসিংহ প্রধানত নৌযুদ্ধ করতে করতে বৃহত্তর ঢাকা-ময়মনসিংহের সংযোগস্থল, বর্তমানে কিশোরগঞ্জের এগারসিন্ধু পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন এবং ঈসাখাঁকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে আগ্রার মোগল দরবারে নিয়েও গিয়েছিলেন।

বাংলায় মোগল অভিযানের এই ঐতিহাসিক ঘটনায় পূর্ববাংলায় মোগল শাসনের পথ উন্মুক্ত হলেও ঠিক তখনই তারা এদেশের পুরোটা দখল করে ঘাঁটি গেঁড়ে বসতে পারেননি। আকবর বিহার, রাজমহল, বাংলার পশ্চিমাংশের কর্তৃত্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হন। ততদিনে আকবরের মৃত্যু হয় এবং আকবর-ঈসাখাঁ মৈত্রীর ১০-১২ বছরের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে বদলে গিয়ে মোগলদের অনুকূলে চলে যায়। কারণ, প্রবল ও ক্রমবর্ধমান মোগল আধিপত্য ও আক্রমণের মুখে বাংলার বারো ভূঁইয়ারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের উত্তরসূরীদের মধ্যেও এমন কোনো সাহসী ও যোগ্য শাসক পাওয়া যায়নি, যিনি মোগলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম। ফলে বাংলার পশ্চিমাংশের মতো বাংলার পূর্বাঞ্চল তথা আজকের বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানাও শক্তিশালী মোগল শাসনভুক্ত হয়।

আকবরের পুত্র, আনারকলির প্রেমিকখ্যাত শাহজাদা সেলিম সম্রাট জাহাঙ্গীর নাম গ্রহণ করে মোগল অধিপতিরূপে মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তার প্রতিনিধি সুবেদার ইসলাম খাঁ ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন ১৬১০ সালে। তখন অবশ্য নতুন রাজধানীর নাম দেয়া হয় সম্রাটের নামে জাহাঙ্গীরনগর।

রোম যেমন একদিনে গড়েনি, তেমনি ঢাকাও হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। ইতিহাসবিদদের ভাষ্য মতে, গোড়ার দিকে ঢাকা ছিল নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর, অসুন্দর নোংরা এক শহর; নিরানন্দ তো বটেই। মোগলরা তাকে নির্মাণ করেন ধীরে ধীরে, যাতে বিভিন্ন সুরম্য স্থাপনার পাশাপাশি ছিল উদ্যান।

সে সময় প্রতিবছর বিশেষ বিশেষ সময়ে হঠাৎ দু’-একদিনের জন্য বদলে যেত ঢাকা শহরের চেহারা। মেলা, রঙিন নিশান, লোকজনের ব্যস্ত চলাফেরায় ঢাকা পড়ে যেত শহরের নোংরা চেহারাটা। নিরানন্দ শহর দু’-একদিনের জন্য হলেও ঝলমল করে উঠত, জমকালো সব মিছিল দেখতে সাড়া পড়ে যেত। এর মূলে ছিল কয়েকটি উৎসব– ঈদ, মুহররম ও জন্মাষ্টমী।

মোগলদের নগর নির্মাণের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। আগ্রা, দিল্লি, ফতেহপুর ইত্যাদি প্রতিটি মোগল নগরে সে ছাপ আছে, যেমন আছে ঢাকায়। মোগলরা দূর্গ গড়ে শহরের বিস্তার ঘটাতেন। তাতে সেনানিবাসের পাশাপাশি বসবাসের সব ধরনের আয়োজন থাকতো। স্বাভাবিক জীবন-যাপনের পাশাপশি পালিত হতো নানা উৎসব।

মোগলরা এসেছিলেন মধ্য এশিয়া থেকে আর তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল পারস্যের সাংস্কৃতিক সুষমা, যাতে বর্ণিল উৎসব উদযাপনের বাহার ভরপুর ছিল। মোগল দরবারে স্থান পেয়েছিলেন অনেক ইরানি ও শিয়া। ফলে নববর্ষ নওরোজের মতো অনুষ্ঠানের আবির্ভাব ঘটে। প্রচলন হয় মহররম ও তাজিয়া মিছিলের। ঈদও সে-সময় সাড়ম্বরে পালিত হতে থাকে।

ঈদের দিন নানা আয়োজনের মধ্যে মেলামেশা, ঘুড়ি উড়ানো, পায়রার খেলা, মোরগ লড়াই, মেলা ও মিনাবাজারের কথা জানা যায় মোগল ঢাকার ইতিহাসে। এ-সময় পুরনো ঢাকার মোগলরা শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকের ধানমণ্ডিতে প্রথম ঈদগাহ নির্মাণ করেন।

আদিতে ঈদগাহটি মাটি থেকে চার ফুট উঁচু একটি সমতলভূমি রূপে ছিল, যার দৈর্ঘ্য ২৪৫ ফুট, প্রস্থ ১৩৭ ফুট। বিস্তৃত তিনদিকে। পশ্চিমে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর, যেখানে রয়েছে মেহরাব বা মিম্বর। পাশ দিয়ে তখন বয়ে যেত পাণ্ডু নদীর একটি শাখা। এই শাখা নদী জাফরাবাদের সাতগম্বুজ মসজিদের কাছে মিলিত হত বুড়িগঙ্গার সঙ্গে। জানা যায়, মোগল রাজপুত্র শাহ সুজা যখন বাংলার সুবাদার তখন তার আমাত্য মীর আবুল কাসেম ১৬৪০ সালে নির্মাণ করেছিলেন ঈদগাহটি। সুবাদার, নাজিম ও অন্যান্য মোগল কর্মকর্তারা নামাজ পড়তেন এখানে। ইংরেজ আমলে জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় ছিল ঈদগাহটি। পরে উদ্ধার করা হয়।

পাকিস্তান আমলে ঈদ উৎসব পুরনো ঢাকার মোগল চৌহদ্দি ও মহল্লাগুলো ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়। কারণ ততদিনে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকা ক্রমবর্ধিত এবং পুরনো ঢাকার সাথে নতুন শহরের নবাগত মানুষদের সংস্কৃতিও মিশতে থাকে। পাকিস্তানের এ অংশে আগত উর্দুভাষী মানুষের গজল, কাওয়ালি যেমন ঢাকার ঈদে প্রাধান্য পায়, তেমনি বাংলাদেশের নানাস্থান থেকে বসবাসের জন্য আগত বাঙালিদের অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পায়। এ সময় আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, মীরপুর, ধানমণ্ডিতে মেলা ও মিনাবাজারের বিস্তৃতি ঘটে। সাথে যুক্ত হয় সার্কাস, পুতুল নাচের মতো বিনোদন।

স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা প্রতি দশকে বাড়তে বাড়তে কসমোপলিটান চেহারা ধারণ করে। ঢাকার ভূগোল আর জনসংস্কৃতিতের সংঘটিত হয় বিপুল রূপান্তর। এক মিশ্র সংস্কৃতির ঢাকায় মোগল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঈদের আমেজ পরিণত হয় প্রাচীন স্মৃতিতে। বদলে শ্রেণি, পেশার ভিত্তিতে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে ঈদ ভিন্ন ভিন্ন অবয়ব লাভ করে। উত্তরা, গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডির ঈদ কালচারের সঙ্গে শাহজাহানপুর, গোড়ান, বাসাবো, রামপুরা, বাড্ডার বিশাল প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়।

ঈদ উৎসবের আয়োজনগুলো আর্থিক সঙ্গতি ও সামাজিক মর্যাদার নিরিখে আলাদা রূপ ও চরিত্রে উপস্থাপিত হয় ঢাকাবাসীর বিভিন্ন এলাকায়। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সাধারণ মানের মার্কেটিং, সিনেমা দেখা, পার্ক-চিড়িয়াখানা-বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়ানোর বিপরীতে উচ্চবিত্তের লং ড্রাইভ, সুপারমলে ব্র্যান্ডের পোশাক কেনা, সিনেপ্লেক্সে যাওয়া বা পার্লারে রূপচর্চার চিত্রও দেখা যায়।

তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের কারণে অনেকের কাছে ঈদ এখন নামাজ আদায় শেষে ছুটির দিনগুলোতে ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকার মধ্যে আবর্তিত। বিকেলে পাড়ায় আড্ডা ও কুশল বিনিময় আর আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়াই প্রধান কাজ। বিশেষত মধ্যবয়সী ও পেশাজীবীদের কাছে ঈদের সময়টি উৎসবের চেয়ে জম্পেশ ঘুমে ছুটি কাটানোর আনন্দেই কাটে।

ঢাকার সঙ্গে কলকাতার তুলনা করলে দেখা যায়, কলকাতায় পূজা বা কোনো বড় ছুটিতে মানুষ দেশ-বিদেশের কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাবেই। ছুটিকে মানুষ ভ্রমণের আনন্দে উপভোগ করেন। বাংলাদেশে, প্রধানত ঢাকায় ঈদের ছুটিতে পরিকল্পিত ভ্রমণ বা বেড়ানোর আগ্রহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী কক্সবাজার, কুয়াকাটা বা অন্যান্য পর্যটন স্পট বা বিনোদন কেন্দ্রে ছুটে যান।

তবে ঈদ উৎসবের সময়কালে একটি বিশেষ দিক থেকে ঢাকা বিশ্বসেরা। পৃথিবীর আর কোন শহরে এমন চিত্র দেখা যায় না, যা দেখা যায় ঢাকায় ঈদের সময়। ঈদে ঢাকা শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষ নিজ নিজ মূল বা আদি বাড়ি চলে যায়। শহর খালি করে গ্রাম বা মফস্বল শহরের ‘বাড়ি যাওয়া’র জন্য ট্রেন, বাস, লঞ্চে প্রাণান্তকর ভিড়কে মানুষ পরোয়া করে না। করোনাভাইরাসের সামাজিক দূরত্বের সময়ও মানুষ অবলীলায় বাড়ির পথে দলে দলে ছুটে গেছে।

একটি আস্ত শহরকে ঈদ-উৎসবের আমেজে প্রায়-খালি করে চলে যাওয়ার ঘটনা সমগ্র বিশ্বেই বিরল। ঈদের সময় পৃথিবীর জনবহুল ঢাকা শহরের জনবিরল ছবিও তখন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গাড়িতে, এমনকি রিকশা করে নিমেষে পুরো ঢাকার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো এমন বিরল সুযোগ পাওয়া যায় ঈদে।

একদা ঢাকার সংক্ষিপ্ত পরিসরে মোগল পৃষ্ঠপোষকতায় যে নগর ও নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, ক্রমে ক্রমে তা নানাভাবে বিকশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বৃহত্তর ঢাকার পরিসরে। ঈদ উৎসবও পুরনো ঢাকার ক্ষুদ্র মহল্লার পরিধি পেরিয়ে সার্বজনীন-বহুমাত্রিকতায় উদ্ভাসিত।

দমবন্ধ ঢাকা মহানগরে ঈদ মানে অনাবিল আনন্দ, স্বস্তি ও খোলামেলা ঘুরে বেড়ানোর অন্তহীন স্বাধীনতা। ঈদ উৎসবের দিনগুলো ঢাকাবাসীর কাছে শব্দদূষণ ও যানজটে অতিষ্ঠ জীবনে মরূদ্যানে একপশলা বৃষ্টির মতো সুখের।

(ড. মাহফুজ পারভেজ-এর লেখা থেকে)