Naya Diganta

যারে দেখতে পারি না তার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই, কেন?

‘গ্লোবাল বাণিজ্য’ কথাটার মানে হলো মূলত আন্তঃরাষ্ট্রীয়ভাবে সব রাষ্ট্রের সাথে সবার এক ব্যাপক বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। দুনিয়াতে বাণিজ্য নতুন না অবশ্যই। অনেকের মনে হতে পারে এই গ্লোবাল বাণিজ্য তো দুনিয়াতে সব সময়ের মতো এখনো আছে। সরি, কথাটা সত্যি না। বাণিজ্য বলতে আসলে দুটো মেজর ভাগ আছে : এক. রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বাণিজ্য, অপরটা বা দুই. রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্য। কেন এই ভাগের কথা বলছি? বাণিজ্য বলতে প্রি-রিকুইজিট বা একটা আগাম দরকারি শর্ত হলো, বাণিজ্য ঘটতে হলে আগাম যার উপস্থিতি দরকার সেটা হলো মুদ্রা। তাই বাণিজ্য ও মুদ্রা কার্যত সমনামীয় শব্দ। এখন মুদ্রা যে প্রচলন করে সেই অথরিটি হলো সেকালের রাজা আর একালের ভাষায় রাষ্ট্র। আর কোনো দেশের মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা ওই রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটাকেই তাই প্রথম ধরনের বাণিজ্য বলছি।

এখন দ্বিতীয় ধরন মানে আন্তর্জাতিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য যেটাকে বলে, এটা পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়েছে মাত্র এই তো সেদিন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের গঠন ও ১৯৪৫ সালে এদের কার্যক্রম চালুর পর থেকে। মানে মাত্র ৭৭ বছর আগে থেকে। তাহলে কি এর আগে গ্লোবাল বাণিজ্য বলতে কিছু ছিল না? ‘ছিল না’ বলার মতোই। তবে খুবই সীমিত পর্যায়ে আর সেটাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া থেকেই এই সীমিত বাণিজ্য ব্যবস্থাটাও চিরদিনের মতো অকার্যকর হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া সেকালের অর্থনীতির মূল তৎপরতারও ছিল খুবই তুচ্ছ এক অংশ। মূল অর্থনীতি তা ছিল না। কেন এমন ছিল?

এর মূল কারণ, সেকালে মানে ১৬০৭-১৯৪৫ সাল এই প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর ধরে চালু দুনিয়াটা ছিল কলোনি দখলদারদের যুগ। মানে স্বাধীন রাষ্ট্র বলতে ছিল ইউরোপের চার-পাঁচটা কলোনি দখলদার দেশ আর বেশির ভাগই এদের কারো না কারো কলোনি দখল হয়ে থাকা দেশ। আর এর ব্যতিক্রম হিসাবে ছিল রাশিয়ান জার বা অটোমান সাম্রাজ্য ধরনের কিছু সাম্রাজ্য অথবা আমেরিকা (১৭৭৬ সালের পর থেকে)। ফলে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য বলতে বড় কিছুই ছিল না; মূল অর্থনীতিও তা ছিল না। তবে একটা বিশেষ ধরনের লেনদেন ছিল যে, দখল হয়ে থাকা কলোনি (যেমন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া) থেকে একপক্ষীয় সম্পদ পাচার মানে মূল ভূখণ্ড ইংল্যান্ডে সম্পদ লুটে নিয়ে যাওয়া ধরনের। এটাকে ঠিক বাণিজ্য বলা মুশকিল। আবার যেমন বরফ আবিষ্কারের পরে ব্রিটিশ আমলে আমেরিকা থেকে জাহাজ ভরে কলকাতার এলিটদের জন্য বরফের জাহাজ আসত। এটাকেই ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার মূল অর্থনীতির তৎপরতা মনে করা মুশকিল। কলোনি সম্পর্কের কারণেই বা স্বাধীন রাষ্ট্র না থাকার কারণেই মূলত সেকালে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বলতে কিছু গড়ে ওঠেনি।

তাই ১৯৪৫ সাল থেকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল নয়া স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো ও পুরানা রাষ্ট্র, সবার মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় চালু করার জন্য; একটা গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরও কিছু রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয়েছে ঠিকই কিন্তু তবু তারা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি বা তাদের করা হয়নি। অন্য ভাষায় বললে, মূলত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো, এরাই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি। তাই এই অপারগতার জন্য তারা গ্লোবাল বাণিজ্যের যোগ্য হয়নি। তবে আরেকটু বিস্তারে বলা দরকার।

স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন-এই মোড়ল কমিউনিস্ট দেশ, এর প্রতিনিধি আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্মের সময় উপস্থিত ছিলেন। বিখ্যাত ব্রেটনউড শহরের এক হোটেলে টানা ২২ দিনের সেই সম্মেলনে এক সোভিয়েত প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আলোচনা দলিলপত্র খসড়া তৈরি শেষে, পরে দলিল স্বাক্ষরের সময় এবং পরবর্তী সময়ে সদস্যপদের চাঁদা জমা দিয়ে সদস্য হওয়ার সময় সোভিয়েত প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিলেন। পরে স্টালিন বেঁচে ছিলেন ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন সোভিয়েত ইউনিয়ন আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি তা কাউকে জানানো হয়নি। অথবা এই নিয়ে স্টালিন কোনো লেখাও লিখেছেন বলে জানা যায় না। আবার পরে যদিও কমিউনিস্ট দেশগুলো আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হবে না, একজোট হয়ে পরে কোনো দিন এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাও সত্য নয়।

তবে কেবল পোল্যান্ডের কথা জানা যায়। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্মের পরে কার্যক্রম শুরু করলে পোল্যান্ড কমিউনিস্ট ব্লকের দেশ হওয়া সত্ত্বেও সে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকও রাজি ছিল, অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পক্ষে আমেরিকান সাড়া ও সমর্থন না পাওয়াতে ব্যাপারটা ওখানেই থেমে যায়। অর্থাৎ পরে সিদ্ধান্তটা আর একা সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোর সমস্যা থাকেনি। আমেরিকার না চাওয়াও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু অন্য দিক থেকে বললে, দেশের বাইরে কোনো আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য- এই আইডিয়াটা নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যেই অস্বস্তি ও অস্পষ্টতা ছিল এবং এখনো আছে- এ কথাও আরেক কড়া সত্য। এটা অনেকটা যেন ‘কমিউনিস্ট হারাম-হালাল’-এর সমস্যা। যেমন কমিউনিস্ট চোখে খোদ বাণিজ্য জিনিসটা কি হালাল? উৎপাদন একমাত্র সরকারি মালিকানায় হতে হবে এই ছিল সেকালের কমিউনিস্ট রাস্তা। ফলে এর সাথে আবার বাণিজ্যের দরকারটা কী? এমনই ছিল মনোভাবটা। তবে এসব অস্পষ্ট কথা হয়তো সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়নে অনেক বড় দেশ বলে চিন্তা করা যেত যে, প্রয়োজনীয় সব ভোগ্যপণ্যই সে নিজেই দেশে উৎপাদন করে নেবে। কিন্তু তুলনায় ছোট কোনো কমিউনিস্ট দেশের বেলায় তার ব্যাপক প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের সমস্যায় যে থাকবে এটাও স্বাভাবিক; তার পক্ষে আমদানি বাণিজ্য ছাড়া গতি কী? অথচ পুরা কমিউনিজমেই বাণিজ্য করা যাবে কি না, সহি বা তা সঙ্গত কি না এই অস্পষ্টতা কখনো কাটেনি। এ ছাড়া আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য ছিল না বলে কমিউনিস্ট দেশগুলো বাণিজ্যে জড়িত হতে সুযোগ না পেয়ে ধুঁকে মরত যদিও আধাখেঁচড়াভাবে কথিত বার্টার সিস্টেমের কথা বলে বছরে একবার হয়তো কোনো পণ্য ‘আমদানি’ করতে দেখা যেত।

গ্লোবাল বাণিজ্যের পণ্য কেনাবেচায় অংশ নিতে গেলে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়ে থাকা একটা আবশ্যিক পূর্বশর্ত। তা মূলত এজন্য যে, প্রত্যেক দেশের নিজ মুদ্রার বিনিময় হার না জানলে বিদেশের কোনো পণ্য কেনাবেচায় অংশ নেয়া সম্ভব নয়। কারণ নিজ মুদ্রার বিনিময় হার না জানলে বিদেশী পণ্যের মূল্য নিজ মুদ্রায় কত, তা জানা সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের মুদ্রার নাম এসডিআর যার মান প্রতিদিন এই প্রতিষ্ঠান, এক মার্কিন ডলার সমান কত এসডিআর তা প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত তা, এক ডলার মানে ০.৭৪৩ এসডিআর-এর ‘আশপাশে’ হয়ে থাকে। আর এখান থেকেই প্রত্যেক সদস্য দেশ তার মুদ্রার মান বা তুল্য বিনিময় হার সম্পর্কে জেনে নিতে পারে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায়। ভেঙে রাশিয়াসহ মোট ১৫টা আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে। আর এরপর এসব রাষ্ট্র সবাই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করেছিল। ১৯৯২ সালের মধ্যে তারা সবাই সদস্যপদ লাভ করে, গ্লোবাল বাণিজ্যে অংশ নেবার যোগ্য হয়ে যায়।

ফলে বলতে গেলে, সেই প্রথম সারা দুনিয়ার সব রাষ্ট্রই একই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়ে যায় মানে, গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থার সদস্য হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের চালু করার কার্যক্রমও যা পারে নাই তা এই প্রথম সম্ভব হলো। এর ফলে, দুনিয়াতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের অধীনস্থ গ্লোবাল অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর বাইরে ‘সোভিয়েত অর্থনৈতিক ব্লক’ বলে আর কোনো দেশ থাকার অবসান ঘটেছিল।

আগের এই ব্লক রাজনীতিতে দুই ব্লকে ভাগ হয়ে থাকা রাজনীতির আরেক প্রকাশ ছিল কোল্ড ওয়ার। মানে হলো আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এ দুই পরাশক্তির রেষারেষি থেকে তারা যেন সবসময় কোনো যুদ্ধাবস্থায়, এমন টেনশন দেখা যেত; অথচ বাস্তবে তারা কোনো যুদ্ধে জড়িত নয় এমন থাকলেও এই টেনশন কাজ করত। পরে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ায় এই কোল্ড ওয়ারের অবসান ঘটেছে।

কিন্তু একালে আমেরিকার নয়া প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, যার অর্থনীতি ২০২৮ সালের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে স্বাধীন পরিসংখ্যানগত অনুমান বলছে। যেহেতু এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে তাও অভ্যাসবশত অনেককেই প্রায়ই মন্তব্য প্রকাশ করতে দেখা যায় যে, আবার কি কোল্ড ওয়ার তাহলে ফিরে আসবে? ফ্যাক্টস হলো, কোল্ড ওয়ার দুনিয়াতে সত্যিকারার্থে আর ফিরে আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এর একেবারেই মৌলিক কারণটা হলো, এখন দুনিয়ার প্রায় সব দেশ একই গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছে যে ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক। আর পুরনো কোল্ড ওয়ার যুগের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল- ‘সোভিয়েত ব্লক’ বলে কিছু রাষ্ট্র ছিল যারা গ্লোবাল বাণিজ্যে অংশ নেয়নি বা সম্পর্কিত ছিল না। এটাই এখন আর নেই। আর কোল্ড ওয়ার রেষারেষি বাস্তবে দেখতে পাবার একটা বড় কারণ ছিল এমন ‘সোভিয়েত ব্লক’ বলে আলাদা অর্থনৈতিক ব্লক হিসাবে কিছু দেশের অস্তিত্ব থাকার সুযোগ তখন ছিল, তাই। এ কালে এই বাস্তবতাটাই আর নেই, লোপ পেয়ে গেছে। এখন সব রাষ্ট্রই একই গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ। তাই চাইলেও কোল্ড ওয়ার রেষারেষির আবহ আবার তৈরি করা সম্ভব নয়।

তাহলে একালে এই ব্যাপারটা আমরা এখন কী বা কেমন হবে-থাকবে, দেখতে পাবো?

এশিয়া টাইমস হংকং থেকে প্রকাশিত এক প্রভাবশালী পলিটিক্যাল ও ফাইন্যান্সিয়াল ওয়েব পত্রিকা। এর গত ২৮ এপ্রিল এক রিপোর্টের শিরোনাম হলো, ‘চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আমেরিকান অর্থনীতি প্রথম কোয়ার্টারে জিডিপি নেমে গেছে।’ এর ভেতরের রিপোর্ট বলতে চাইছে, আমেরিকান অর্থনীতি চীনা পণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে এর জিডিপি চীনের সাথেই ওঠানামা করা শুরু করেছে। এ কারণে রিপোর্টারের মন্তব্য : দুনিয়াতে আগের কোনো রেকর্ড নেই এমন এক ঘটনা এটা- দুনিয়ার প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বা রাইভাল অর্থনীতি তারা এমনই আজব রাইভাল যে, তারা একটা অপর দেশটা থেকে আমদানিতে পণ্য আনাতে নির্ভরশীল হয়ে গেছে, অথচ তারা স্ট্র্যাটেজিকভাবে রাইভ্যাল দুই দেশ! এতে চীন-আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি আমেরিকার বিরুদ্ধে, চীনের পক্ষে গেছে। চীনের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি এখন প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার আর এটাই আমেরিকার জিডিপি নামিয়ে দিয়েছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে ক্রমশ এই ঘটনাটা ঘটে গেছে। ট্রাম্প আমলের সাথে তুলনায় চীনাপণ্য আমদানি এখন ৬০% বেড়ে গেছে।

তাহলে, এখানে প্রাসঙ্গিক মূল কথাটা হলো, একালে কোল্ড ওয়ার উত্তর যুগে, কেউ কারো প্রধান স্ট্র্যাটেজিক বা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ বলে তার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই বা করা যাবে না এমন দেখা যাবে না। একালে বরং রাইভালের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক হতে দেখা যাবে; তা অবশ্যই হবে এমনকি সবচেয়ে গভীর নির্ভরশীলতার সম্পর্কে ডুবে থাকছে। এখানেই একাল পুরোপুরি আলাদা! অতএব কোল্ড ওয়ারের যুগ দুনিয়াতে ফিরে আসবে বলে কেউ যেন গল্প না ফাঁদে।

কমবেশি একই অবস্থা ভারত-চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যেও। প্রথমত তারা উভয় দেশ এখন ঘোরতর এক বাণিজ্য সম্পর্কে লেপটে জড়িয়ে আছে। অথচ তারা প্রবল ও প্রধান স্ট্র্যাটেজিক রাইভ্যাল দুই দেশ। ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখছে, ‘২০২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে গত এক বছরে ভারতের চীনা পণ্য আমদানি বেড়েছে ৪৩%।’ অথচ চীন-ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক এখন শীতলতম, ঠাণ্ডা। সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে নরেন্দ্র মোদি গত কয়েক বছর ধরে চীনা আমদানি কমাবেন বলে প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন- জাগরণ মঞ্চ নামে এক সংগঠন গড়েছেন। কিন্তু ফলাফল উল্টা এবং নিজের এই দুরবস্থা দেখে মোদিও নিশ্চুপ!

এটাই কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী যুগের ফেনোমেনো। কারো সাথে যুদ্ধের সম্পর্ক থাকলেও সে দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক, আমদানি নির্ভরশীলতার সম্পর্ক আরো জোরদার হতে পারে, একালে। সোজা কথায় জাতিবাদী অর্থনীতি বলে কোনো ধারণা এখানে ব্যর্থ শুধু নয়; বরং প্রায় উল্টারূপে হাজির! তাই মোদি এ নিয়ে এখন একেবারেই চুপ!
কিন্তু ব্রহ্ম চেলানি ততই ভোকাল!

ব্রহ্ম চেলানি- ছোট হলেও দিল্লিতে তার একটা থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান আছে; নাম সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ। প্রো-আমেরিকান থিংকট্যাংক বলা যায়। কিন্তু এই বাইডেনের আমলে তিনি বারে বারে বাইডেনের ওপর ক্ষেপে উঠছেন। আবার প্রচণ্ড চীনবিরোধী। সময়ে মোদির চেয়েও বেশি ন্যাশনালিস্ট হয়ে উঠতে দেখা যায় তাকে! চীনকে তিনি ‘আগ্রাসনবাদী চীন’- সবসময় তিনি এভাবে লিখেন। তাকে প্রথম ক্ষেপে উঠতে দেখা গিয়েছিল গত বছর বাইডেন যখন আফগানিস্তান ফেলে পালিয়ে আসেন। তিনি পরাশক্তির এই শিয়াল ভূমিকা দেখে এটা মেনে নিতে পারেননি। বাইডেনেরই কঠোর সমালোচনা করেছিলেন আর সেটা প্রায় ফিরে যেন আবার বুশের কোলে গিয়ে ওঠেন দশা!

সেই তিনি ইদানীং আবার ক্ষুব্ধ! প্রধানত কোয়াডকে নিয়ে। কোয়াড দেশের প্রধানদের এবার সাক্ষাতে সম্মেলন হচ্ছে আগামী ২৪ মে। আর চেলানির হইচই শুনে মনে হচ্ছে যেন এবার ভারতের বদলে দক্ষিণ কোরিয়া নতুন অন্তর্ভুক্ত হবার কথা উঠেছে, তা হয়েই যাবে। তার এবারের কলামের (যার প্রথম আলো অনুবাদ ছেপেছে) শিরোনাম, ‘কোয়াড কি চীনকে ঠেকানোর লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে?’ বুঝা যাচ্ছে খুবই অ্যাগ্রেসিভ তিনি! যেমন- আনুষ্ঠানিকভাবে চীনকে ঠেকানোর কোয়াডের লক্ষ্য, এটা বোধহয় কোথাও পাওয়া যাবে না।

যা হোক, তিনি কোয়াডের চার দেশের ওপরই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। কেন? তিনি দেখতে চান যে, এ চার দেশের কারো সাথে চীন থেকে চীনা পণ্য-আমদানির বা বাণিজ্য সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ মনে মনে তিনি যেন একটা কোল্ড ওয়ার আমলের সোভিয়েত-আমেরিকা সম্পর্ক দেখতে চাইছেন। এ কারণে তিনি মোদির উপরেও প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত!

কিন্তু তাকে কে বুঝাবে, একালের গ্লোবাল পরিস্থিতিতে তিনি যেমনই একে দেখতে চান না কেন সেটা আর দেখার সুযোগই নেই; সব বদলে গেছে। ফলে কোল্ড ওয়ার যুগের মতো চেহারা-বৈশিষ্ট্য একালে আর দেখা যাবে না বা তা আর ফিরবে না। জাতিবাদী অর্থনীতিই তো লোপ পেয়ে গেছে- সেই ১৯৮০ সালের শুরু থেকেই; অর্থাৎ কোল্ড ওয়ার এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জীবিত থাকতেই। তবে সোভিয়েত ভেঙে পড়ার পর থেকে বাণিজ্য গ্লোবাল হয়ে ওঠা আর এর প্রভাব টের পাওয়া প্রবলভাবে শুরু হয়েছে। তাই একালের বৈশিষ্ট্য হলো, যেকোনো দেশের স্ট্র্যাটেজিক রাইভালের সাথেও তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক একালে অবশ্যই থাকবে। সেটা চীন হলেও তাতেও ব্যত্যয় ঘটবে না; আরো ভালোভাবে থাকবে। কারণ যেসব চীনাপণ্য সবচেয়ে সস্তা তা আপনি না কিনে তো আপনার রেহাই নেই। বরং চীনাপণ্য কিনতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে করবেন।

যেমন উদাহরণটা ভালো করে লক্ষ করুন; এটা চীনের প্রশংসার ইস্যু নয়। বাস্তবতাটা খেয়াল করতে ও বুঝতে হবে। ভারতে জাপানি গাড়ির জয়েন্ট ভেঞ্চারে গড়ে ওঠা কারখানা আছে। কিন্তু সেই জাপানই মোদি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে যেন চীনা স্পেয়ার্সের (যন্ত্রাংশ) ওপর বাড়তি ট্যাক্স বসানো না হয়। মানে, প্রত্যাহার করা হয়। কেন? কারণ, গাড়ির অরিজিন জাপানি আর এসেম্বল ভারত হলেও এর স্পেয়ার্সগুলো ভারতে বসে এই চীনাপণ্য আমদানি করে লাগানো। কারণ চীনা স্পেয়ার্স-এর দাম আকাশপাতাল কম। সে কারণেই জাপান সরকারের নিজেরই অনুরোধ এটা মোদির কাছে।

অর্থাৎ ব্রহ্ম চেলানির চিন্তাটা পুরনো যা ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত কোনোমতে চলতে পারা জাতিবাদী অর্থনীতির বুঝ দিয়ে তৈরি। অথচ এই বুঝ নিয়ে তিনি এখন দুনিয়াকে এবং কোয়াড-দেশের অর্থনীতিকেও ব্যাখ্যা করতে গেছেন। এর মানে, তিনি খোয়াবে আছেন যে, তিনি যেন ১৯৮০ সালের আগেই এখনো আছেন।

এমনকি তিনি চীনা আরসিইপি জোট মানে যেটা ‘ভ্যালু অ্যাডিশন শেয়ার্ড প্রোডাক্ট’ উৎপাদনের এক নয়া জোট যেটা আসলেই এক বিরাট আগামী সম্ভাবনার জোট- এর প্রবল বিরোধিতাও করেছেন। বহু আগে থেকেই বলে আসছি যে, স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বা ফরেন রিলেশনবিষয়ক গ্রাজুয়েট-বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল থেকেই সিলেবাসে অর্থনীতিকেও অন্তত একটা সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসাবে রাখতে। কারণ যে কেউ অর্থনীতির কিছু না পড়লেও নিজেকে জাতিবাদী অর্থনীতির ওস্তাদ বলে হাজির করতে পারে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এখন জাতিবাদী অর্থনীতির বুঝ থেকে বহু দূরে চলে গেছে। কাজেই নতুন বাস্তবতা বুঝতে কিছু নতুন ধারণা লাগবে। অনেক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বা ফরেন রিলেশনবিষয়ক প্রফেসরের মধ্যেও এই (জাতিবাদী অর্থনীতির বুঝ দিয়ে সব ব্যাখ্যার) ঝোঁক দেখা দিতে পারে।

তাই অন্তত জাতিবাদী অর্থনীতির বাস্তবতা যে আর নেই এটুকু রিয়ালাইজ করাই হবে তাদের প্রথম পাঠ! মোদির ‘জাগরণ মঞ্চ’ তাই এখন চীনের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। আবার সাবধান, ব্যাপারটা চীন বলে নয়; যেকোনো দেশের সাথে হতে পারে। বিদেশী পণ্য আমদানি এখন সাধারণ ব্যাপার যখন আপনিও রফতানিকারক। এটা গ্লোবাল বাণিজ্যের যুগ!

তাই যাকে পছন্দ করেন না তার সাথেই সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক; ফলে ঘনিষ্ঠতা এখানে খুবই স্বাভাবিক!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com