Naya Diganta

খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে উদ্ভাবনক্ষম প্রজনন

১. খাদ্য উৎপাদনে অনিশ্চয়তা
পৃথিবীতে এক দিকে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্য দিকে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কৃষি উৎপাদনশীলতা কমছে। তাতে খাদ্য সঙ্কট দিন দিন বাড়বে। ক্রমবর্ধিত এ সমস্যা গোটা বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তার জন্যই হুমকিস্বরূপ। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাত কোটি। বর্তমানে ১৭ কোটি। মাত্র এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে প্রতি বছর ২০ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। এ হারে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২৫ কোটিতে দাঁড়াবে। বাংলাদেশেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিনিয়ত আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। এতে কমে যাবে ফসলের উৎপাদন। কৃষিমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর আবাদকৃত জমি ০.৪ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যা, আবাদকৃত জমি হ্রাস, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব, আবিষ্কৃত প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যর্থতা, নিচুমানের গবেষণা ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে ধীরগতির কারণে কৃষি উৎপাদনশীলতায় স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। এসবের একত্র সমাবেশ ও মিথস্ক্রিয়ায় দেশে প্রয়োজনমাফিক খাদ্যের জোগান বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। সুতরাং ভবিষ্যতে কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, প্রজননবিদ ও নীতিনির্ধারকদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো।

বৃহৎ এই জনসমষ্টির জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবিষ্যতে উৎপাদন বহুগুণে বাড়াতে হবে। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে বিরল সম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। একই সাথে ব্যবহার করতে হবে পরিমিত পরিমাণে। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে যেসব উপাদান ও উপকরণের ওপর বেশি নির্ভরতা তৈরি হয়েছে, পরিবেশগত কারণে সেগুলোর ব্যবহার কমাতে হবে। প্রজননের উদ্ভাবন শক্তিকে কাজে লাগিয়েই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। অমিত এ সম্পদ ও শক্তিকে সর্বোত্তম ও কার্যকরভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে; অতিরিক্ত তাপ, খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহনশীল অধিক ফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এসব নতুন জাতের ফসল এক দিকে কীট-পতঙ্গ ও রোগবালাই প্রতিরোধী হবে। অন্য দিকে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে নতুন নতুন জৈব-অজৈব পীড়নের চাপ মোকাবেলায় সক্ষম হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি উৎপাদনে দেশে দেশে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- অধিক ফলন যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি ব্যবহারযোগ্য বিরল সম্পদের সুষম ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হতে হবে। যেমন ভূমি, পানি, সার ও কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার বর্তমানের তুলনায় কম করতে হবে। একই সাথে নতুন উদ্ভাবিত জাতের জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট যেকোনো প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করার বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে।

২. সম্ভাব্য সমস্যা
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে প্রকট করে তুলেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে কীটপতঙ্গ, পঙ্গপালের আক্রমণ, বিভিন্ন রোগবালাই, জৈব-অজৈব পীড়ন, লবণাক্ততা, মরুকরণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে বিশ্বব্যাপী কৃষি উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ইউএন কনভেনশন টু কমব্যাট ডিসারটিফিকেশন (ইউএনসিসিডি) জোর দিয়ে বলেছে, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের খাদ্য চাহিদা মেটাতে হলে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো অত্যাবশ্যক।

গত ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ বিশ্বব্যাংক এবং মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়- ক. ২১০০ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বা ৩.২১ ফুট বেড়ে যেতে পারে; খ. জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব ও অন্যান্য কারণে ২০৩০ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের ৬ শতাংশ ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ২ শতাংশ; ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ১২ শতাংশ ও ৪ শতাংশ; ২০৪০ সাল পর্যন্ত ১৮ শতাংশ ও ৭ শতাংশ এবং ২০৪৫ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে ২৪ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ৯ শতাংশ পর্যন্ত আবাদি জমি কমে যাবে। এ ছাড়া ২০৪৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৮.৩ শতাংশ জমি লবণাক্ত পানিতে নিমজ্জিত হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

মানবজাতি ইতিহাসের এক সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা বর্তমান ৭৬০ কোটি (মতান্তরে) থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৮০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। আবাদি জমির প্রাপ্যতা মাথাপিছু ০.২০ হেক্টর থেকে কমে ০.১৫ হেক্টরে নেমে আসবে। গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বর্তমান ১৪.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে পানির চাহিদা বর্তমান তিন হাজার ৫০০ ঘনকিমি থেকে চার হাজার ৫০০ ঘনকিমি পর্যন্ত বেড়ে যাবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও অন্যান্য নেতিবাচক প্রভাবে অনুমান করা হয়, ন্যূনতম ২৫-৩০ শতাংশ ফসলহানি হবে। বর্তমানে এ হার ১০ শতাংশের কম।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ন, শিল্পায়নের সাথে সাথে আবাদি জমি কমে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত বিপদ ডেকে আনছে। অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সার ব্যবহারে পাল্লা দিয়ে কমছে ভূমির উর্বরতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে জলবাযু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনে আর্কটিক অঞ্চলে ও পর্বতগুলোর হিমবাহ দ্রুত গলে যাবে। তাতে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে তলিয়ে যাবে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের সব নদী হিমালয় পর্বতের হিমবাহ গলিত পানিনির্ভর বিধায় ভবিষ্যতে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাবে। এসব কারণে খাদ্য উৎপাদন নানা ঝঞ্ঝা ও পরিবেশগত বৈরিতার মুখোমুখি হতে হবে।

এ ছাড়াও পৃথিবীব্যাপী বাস্তুতন্ত্রের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এসব নতুন নতুন বাস্তবতা কৃষি উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা অবিশ্বাস্য রকমে অনিশ্চিয়তার মুখে ঠেলে দেবে। জলবাযু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অঞ্চলভেদে নানা রূপে দেখা দেবে। কোথাও পানির উচ্চতা বেড়ে আবাদি জমি নিমজ্জিত হবে, কোথাও উচ্চ তাপমাত্রায় অতি-মরুকরণ, কোথাও অতিবৃষ্টির কারণে সময়-অসময়ে শোনা যাবে বন্যার পদধ্বনি, কোথাও অতিমাত্রায় তুষারপাত আবার কোথাও বরফ গলে যাবে, কোথাও ঋতুর সময়সীমা ছোট হয়ে অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজ করবে। আরো ভয়ের কারণ হচ্ছে- যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এর মধ্যে বাংলাদেশ একেবারে উপরের কাতারে। সুতরাং প্রজননের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উদ্ভিদের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা আছে বলে আপাতত আমাদের জানা নেই। জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি কমিয়ে আনতে এবং লাখ লাখ দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা দূরীকরণে এটাই একমাত্র উপায়।

৩. ফসলের উন্নয়ন-প্রজননের পদ্ধতি
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন ও উন্নয়ন নতুন কোনো বিষয় নয়। হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন উপায়, প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অবলম্বন করে মানুষ ফসলের উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আসছে। ফাদার অব জেনেটিক্স নামে খ্যাত ধর্মযাজক জোহান গ্রেগর মেন্ডেলের ১৮৬৬ সালে ‘উদ্ভব সম্বন্ধীয় তত্ত্ব’ প্রবর্তনের পর ফসলের উন্নয়ন ও কৃষি উৎপাদনশীলতায় গতিশীলতা বেড়ে যায়। উদ্ভিদ প্রজননে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়। ১৯০০-এর দশকে ফসলের শঙ্করায়ন পদ্ধতি এবং ১৯৩০-এর দশকে পরিব্যক্তি প্রজনন প্রবর্তনে ফসলের নতুন জাতের উদ্ভাবন আরো গতি পায়। ২০০০ সালের প্রথম দশকে জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিনের ধারাবিন্যাস) ও জিনের ক্রিয়াকলাপের বিশদিকরণে বর্তমানে নিত্যনতুন প্রজনন পদ্ধতি প্রবর্তন বা অনুবৃত্তি করা সম্ভব হচ্ছে। এসব নতুন প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রজননবিদরা সহজে উদ্ভিদের চরিত্রের গুণগত প্রলক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো বর্তমানে দক্ষতার সাথে চিহ্নিত করতে পারেন। এরপর প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য আরেকটি প্রজাতির উদ্ভিদের সাথে শঙ্করায়নের মাধ্যমে দোআঁশলা (হাইব্রিড) জাতের উন্নতমানের উদ্ভিদ উদ্ভাবন করতে পারেন। এ দোআঁশলা উদ্ভিদের কোনোটি উচ্চ ফলনশীল, কোনোটি স্বাদে-গন্ধে ভালো, কোনোটি কীট-প্রতঙ্গ প্রতিরোধ করতে পারে, কোনোটি আবার রোগবালাই প্রতিরোধক।

৪. উন্নয়ন সাধনের সময় রেখা
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, প্রজননের মাধ্যমে ফসলের উন্নয়নের ইতিহাস দীর্ঘ। তবে অতীতে উদ্ভিদের প্রাকৃতিকসম্মত শারীরিক প্রলক্ষণ বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফসলের মান বাড়ানো হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০০ অব্দে মানুষ গমের উন্নয়ন সাধন করতে শুরু করে। ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বে তিসি, ফ্লাক গম, বার্লি; ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বে ভুট্টা; ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বে আলু; ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বে তেলজাতীয় ফসল এবং তরমুজ; ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বে রাই এবং ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সুগার বিটসহ অন্যান্য অনেক ফসলের উন্নয়ন সাধন করে।

মেন্ডেল তত্ত্বের মূলনীতি অনুসরণ করে ১৯০০ সালে উদ্ভিদের শঙ্করায়ন প্রজনন, ১৯২০ সালে দোআঁশলা (হাইব্রিড) প্রজনন; ১৯৩০ সালে পরিব্যক্তির মাধ্যমে জিনের (জন্মগত প্রলক্ষণ) পরিবর্তন করে প্রজনন শুরু হয়। কৃষি বিজ্ঞানীরা ১৯৬০ সালে টিস্যু কালচার, ১৯৯৬ সালে এক জীব থেকে অন্য জীবে জিন স্থানান্তর করে নতুন বৈশিষ্ট্যের জাত উদ্ভাবন, ২০০০ সালে জিনের গুণগতমান চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট জিন বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রজনন এবং ২০১০ সালে জিনোম সিকোয়িন্সিংয়ের (জিনের ধারাবিন্যাস) ও জিনের বিশদিকরণ, ইত্যাদি নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে জিন সম্পাদনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ প্রজননে নতুন মাত্রা যোগ করে। তবে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত ফসল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। এই ফসল জিএমও বা জন্মগত প্রলক্ষণের দিক থেকে রূপান্তরিত কি না তা নিয়ে অনেকের মনে এখনো সংশয় আছে। এ নিয়ে বাদানুবাদেরও কমতি নেই।

বিকিরণ বা রশ্মি বিচ্ছুরণ দিয়ে প্ররোচনার মাধ্যমে উদ্ভিদের জিনে পরিব্যাপ্তি (পরিবর্তন) ঘটাতে শুরু করা হয় ১৯৩০ সাল থেকে। পরিব্যাপ্তির ফলে জীবের জিনোমের অভ্যন্তরে (দৈহিক তন্ত্রে) বিভিন্ন সারবস্তুর (জিনের প্রলক্ষণে) পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে জীবের ভেতর কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়। প্রজননবিদরা এসব প্রলক্ষণের মধ্য থেকে মূল্যবান বৈশিষ্ট্যগুলো বাছাই করে প্রজননের মাধ্যমে একই প্রজাতির অন্য উদ্ভিদে স্থানান্তর করে এবং নতুন জাতের উদ্ভিদ উদ্ভাবন করে। বিকিরণ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে বিভিন্ন ফসলের জিনে পরিব্যাপ্তি ঘটানো হয়। সম্প্রতি কেনিয়ার কৃষিবিজ্ঞানীরা গামা বিকিরণ ব্যবহার করে একটি খরা-সহনশীল গম উদ্ভাবিত করেছেন। নতুন এ জাতের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। নতুন উদ্ভাবিত ফসলে মূলত স্ত্রী ফুল ফোটে এবং পরাগায়ণ ছাড়াই ফলন হয়।

উদ্ভিদ প্রজননের প্রধান লক্ষ্য হলো- উদ্ভিদের জিনগত (জন্মগত) বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও উৎকৃষ্ট প্রলক্ষণগুলো ক্রমাগতভাবে ব্যবহার করে চাহিদা মাফিক নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন করা এবং উদ্ভিদের বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি করা। উদ্ভাবনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া পর্যালোচনায় বোঝা যায়, কৃষি সভ্যতার আবির্ভাব থেকেই মানুষ ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টায় আছে। মেন্ডেলের তত্ত্ব প্রবর্তনের পর থেকে উদ্ভিদ প্রজননবিদরা নতুন নতুন প্রজনন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এসব পদ্ধতি বৃদ্ধি করেছে ফসলের জিনগত বৈচিত্র্য। প্রজননবিদরা ফসলের সর্বোত্তম ও সর্ব উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো বাছাই করে স্বাদে-গন্ধে ও ফলনে কার্যকরী উদ্ভিদের নতুন জাত উদ্ভাবন করে কৃষকের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন।

৫. মনোসিয়াস থেকে গাইনোসিয়াস
বাংলাদেশের একটি অন্যতম সবজি শসা। দক্ষিণ এশিয়া শসার উৎপত্তি স্থান। এ অঞ্চলে এর চাষ তিন হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীনকালেই এটি পশ্চিম এশিয়া হয়ে ইউরোপ ও আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করে। শসার অধিকাংশ জাত একবাসী। অর্থাৎ একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা উৎপন্ন হয়। এই যৌনরূপ সব প্রজাতিতে বিদ্যমান। তবে তিন জোড়া জিন উদ্ভিদের যৌনরূপের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। মাঝে মাঝে পরিবেশের প্রভাবে আলগায়নের সময় উদ্ভিদের যৌনরূপ অস্থায়ীভাবে স্ত্রী লিঙ্গত্ব এবং দ্বিলিঙ্গত্বেরও সৃষ্টি করে। বর্ধিত জনসংখার খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য অধিক ফসল ফলানোর প্রয়াসে যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ দিন পরিশ্রম করে শসার অস্থায়ী যৌনরূপকে স্থায়ীকরণের মাধ্যমে ফলন বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান উন্নত বিশ্বে শসার শঙ্কর জাতগুলো স্ত্রীলিঙ্গিক। এই গাছের প্রধান এবং শাখা ও প্রশাখার প্রতিটি অঙ্গ স্ত্রী ফুল ও ফল উৎপন্ন করে। এই জাত একবাসী জাতের চেয়ে অধিক ফলনশীল হয়। এ ছাড়া স্ত্রীলিঙ্গিক শঙ্ককর জাতগুলো প্রচলিত জাতের চেয়ে আগাম ফলন পাওয়ায় চাষিদের কাছে এর সমাদর বেশি।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানীরা এই বর্ধিত চাহিদা মেটাতে শসার স্ত্রীলিঙ্গিক শঙ্কর জাত উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা এ ফসলের যৌন অভিব্যক্তি তথা ফুলের ধরন, আগামত্ব, ফুলের প্রকার, যৌন অনুপাতসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় এনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষত তারা বিশ্বের অগ্রসরমান উদ্ভিদ প্রজনন কৌশল ব্যবহার করে স্ত্রীলিঙ্গিক শসার জাত উদ্ভাবনে চেষ্টা করছেন। কার্যত উদ্ভিদ শারীরবিদ্যায় দেখা যায়, ফুল ধরার ব্যাপারে উদ্ভিদে বিভিন্ন হরমোনের ভূমিকা অপরিসীম। গবেষণায় দেখা গেছে, হরমোন ও বিভিন্ন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক দ্রব্যগুলো, উদ্ভিদের যৌন অভিব্যক্তিকে প্রভাবিত করে। এ রকম দু’টি হরমোন হলো অক্সিন ও ইথিলিন। উদ্ভিদে উচ্চমাত্রার অক্সিনের উপস্থিতিতে ইথিলিনের সংশ্লেষ ঘটালে স্ত্রী ফুল ধারণে ওই উদ্ভিদ বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সুতরাং উদ্ভিদে ইথিলিন সংশ্লেষকে বাধা দেয়া হলে শসার অস্থায়ী যৌনরূপ যেমন- স্ত্রীলিঙ্গিক গাছে পুরুষ ফুল আনয়ন করা যায়। তেমনি উৎপন্ন পুরুষ ফুলের সাথে পরাগায়নের ফলে শসার ওই অস্থায়ী যৌনরূপ, স্ত্রীলিঙ্গতাকে স্থায়ী রূপে রক্ষণাবেক্ষণ করে ইনব্রিড লাইন তৈরি করা সম্ভব। এ রকম দু’টি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন লাইনের শঙ্করায়নের ফলে সম্পূর্ণ স্ত্রীলিঙ্গিক শঙ্কর জাত উদ্ভাবন করা যায়।

উপরোক্ত পদ্ধতিতে স্ত্রীলিঙ্গিক শসার জাত উদ্ভাবনে নানা সমস্যা দেখা যায়। বিশেষত আলগায়নের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত যৌন অভিব্যক্তিসম্পন্ন তথা স্ত্রীলিঙ্গিক গাছ পেতে বহু বছর সময় লেগে যায়। এ ছাড়া উদ্ভিদে শরীরবৃত্তিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আধুনিক পরিব্যক্তীয় প্রজনন কৌশল ও জৈব প্রযুক্তির সহায়তায় অল্প সময়ে এ জাতীয় শসার জাত উন্নয়নের সহজ দরজা উন্মোচিত করে দিয়েছে। পরিব্যক্তিকারক হিসেবে ইথাইল মিথেন সালফোনেট বহুলভাবে ব্যবহৃত একটি রাসায়নিক উপাদান। এ পদ্ধতিতে ইএমএস ব্যবহার করে উদ্ভিদের জিনোমকে পরিবর্তন করতে প্রণোদিত করা যায়। পরে নতুন বৈশষ্ট্যগুলোকে লক্ষ্যবস্তু ধরে এগিয়ে যাওয়া হয়। একে বলা হয় টিলিং পদ্ধতি। এ উপাদান ব্যবহার করে জিনোমোতে যৌন অভিব্যক্তির জন্য দায়ী জিনে যখন পরিবর্তন আনা হয়, তখন উদ্ভিবকে এক যৌনরূপ থেকে অন্য যৌনরূপে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। যেমন- শসার একবাসী যৌন অভিব্যক্তির জন্য দায়ী জিন CsACS2 যদি পরিব্যক্তির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় তা হলে স্ত্রীলিঙ্গিক শসা গাছে রূপ নেয়। পরে বিপরীত পরিব্যক্তীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে শসার অস্থায়ী যৌনরূপকে স্থায়ী যৌনরূপ যেমন, স্ত্রীলিঙ্গিক করা যায়, তেমনিভাবে পরিবর্তিত এই জিন প্রজননের মাধ্যমে অন্য জাতে স্থানান্তরিত করে প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাত উদ্ভাবনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।

৬. ফসলের উন্নয়ন-অতীত বনাম বর্তমান
প্ররোচিত করে পরিব্যপ্তির মাধ্যমে উদ্ভিদের প্রলক্ষণে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও অদলবদল অতীতে প্রজননবিদরা বহুভাবে করে আসছেন। নিকটাতীতে উদ্ভিদের প্রলক্ষণে পরিবর্তন বা অদলবদল কৃষি বিপ্লব সাধনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। যেমন ফলন বাড়াতে উদ্ভিদের অভ্যন্তরে যে সাঙ্কেতিক চিহ্ন ফুল ফোটায় ও বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই চিহ্নকে আবর্তিত (ঘুরিয়ে) করে দিয়ে হাইব্রিড জাতের উন্নতিকরণ। এসব হাইব্রিড জাতের উদ্ভিদ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা ও রোগবালাই প্রতিরোধ করে ফলন বাড়াতে পারে।

কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির একেবারে প্রথম দিকে উদ্ভিদের এসব প্রলক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তন হতো প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে। এসব বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার সুযোগ সৃষ্টি হতো অনেকটা অদৃষ্টক্রমে (ভাগ্যক্রমে)। তবে উদ্ভব সম্বন্ধীয় আধুনিক তত্ত্ব ও চিন্তাধারা এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও পদ্ধতি উদঘাটনের ফলে বর্তমানে প্রজননবিদরা এসব বৈশিষ্ট্য সহজেই চিহ্নিত করতে সক্ষম।

অতীতের ধারাবাহিকতায় হলেও আজকালকার অনেক উদ্ভাবন, অতীতের অনেক চিন্তাধারা ও উদ্ভাবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে নতুন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উদ্ভাবন ও চিন্তাধারার জন্ম দিচ্ছে। অতীতে নিরাপত্তাহীনতা, অভাব-অনটন, খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষ এবং জীবন রক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে আকুলতা, সদা-সর্বদা মানুষকে তার মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে প্রেরণা জুগিয়েছে। যেমন বলা হয়- অপরিহার্যতাই সব উদ্ভাবনের মাতা। অতএব ধারণা করা যায় যে, ভবিষ্যৎ খাদ্য সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ফসলের উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন করে খাদ্য সমস্যার সমাধান করবে। তাই আমাদের বর্তমান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হওয়া উচিত ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। সীমিত জমি এবং অবিরত কমে যাওয়া, জমিতে উর্বরতার অধঃপতন, কীট-পতঙ্গ ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করাই এখন মানব জাতির অন্যতম দায়িত্ব। নিত্যনতুন আবিষ্কৃৃত প্রযুক্তির ব্যবহারে নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন করে এ সঙ্কট মোকাবেলা সম্ভব। ভবিষ্যৎ খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলায় অবিলম্বে উৎপাদন বাড়ানোর নতুন নীতি-কৌশল নির্ধারণ করা বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য অতি আবশ্যক।

৭. প্রাকৃতিক বিবর্তন বনাম প্ররোচনার প্রবর্তন
১০ হাজার বছর আগে অর্থাৎ কৃষি যুগের আবির্ভাব থেকেই প্রাকৃতিক বিবর্তনে ফসলের উন্নতি হয়ে আসছে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব (১৮০৯-১৮৮২) অনুযায়ী সময়ের ব্যবধানে জীবের চরিত্রের প্রলক্ষণে প্রাকৃতিক নিয়মেই পরিবর্তন ঘটে। এ তত্ত্বের প্রধান যুক্তিতর্ক হলো- ক. জীবের প্রত্যেক প্রজাতিতে অবস্থান্তর বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলো সময়ের সাথে সাথে ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে; খ. কোনো কোনো জিন (প্রলক্ষণ) আবার অন্য জিনকে অভিযোজনে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে; গ. যেসব জিন তার ধারককে পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে অভিযোজনে সাহায্য করতে পারে, সেগুলো প্রাকৃতিক নিয়মে অনেক বেশিমাত্রায় পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তর হয়। অতএব প্রাকৃতিক নিয়মেই সময়ের ব্যবধানে জীবের জন্মগত প্রলক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে বদলে যায়। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বানুযায়ী জিনের পরিবর্তন কেবল জন্মগত নয় বরং প্রাকৃতিক ও পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়ায় জিনের পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ জীবের প্রলক্ষণে পরিবর্তন কেবল বংশগত বা উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, বরং প্রাকৃতিক নিয়মে বিবর্তিত হয়।

বিবর্তন তত্ত্ব যাই হোক, প্রজনন বিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, ‘জীবের প্রলক্ষণ জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অতএব জীবের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি জিন দ্বারা নির্ধারিত ও নিরূপিত’। কেউ মনে করেন, জীবের বৈশিষ্ট্যের ৮০ শতাংশ জিন দ্বারা নিরূপিত, বাকি ২০ শতাংশ পরিবেশ দ্বারা পরিবর্তিত। সে যাই হোক, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সব জীবসত্তা বা প্রাণী; হোক মানুষ, জন্তু বা উদ্ভিদ, সব প্রাণীর দৈহিক গঠনতন্ত্রে ও শরীর তত্ত্বে জিনের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রচণ্ড শক্তিশালী।

মেন্ডেল তত্ত্বের সূত্রপাতের পর থেকেই ফসলের শঙ্করায়ন এবং দোআঁশলা (হাইব্রিড) জাত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিকিরণ ও রাসায়নিক ব্যবহার করে জিন পরিব্যাপ্তির কৌশল প্রবর্তনের পর উন্নত জাতের উদ্ভিদের উদ্ভাবন প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এসব প্রযুক্তি, পদ্ধতি, প্রক্রিয়ার সাথে যোগ হয়েছে জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিনের ধারাবিন্যাস), জিনের নির্দিষ্ট ক্রিয়া-প্রক্রিয়া চিহ্নিতকরণ (বিশদিকরণ), এবং কলা কষ্টন ইত্যাদি কারিগরি কলাকৌশল ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ কৌশল। এসব প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করে বর্তমানে উদ্ভিদ প্রজননবিদরা ফসলের উন্নত বৈশিষ্ট্য বা প্রলক্ষণগুলো অতি দ্রুতগতিতে তাদের পছন্দানুযায়ী বাছাই করতে পারে। এ ছাড়াও ডিএনএর আঙুলের চাপ মুদ্রণের মাধ্যমে সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রলক্ষণগুলো প্রয়োজনমাফিক বাছাই করে নিতে পারেন। এরপর ক্রস ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে সংমিশ্রিত করে এসব উন্নতমানের বৈশিষ্ট্যগুলোকে একই ফসলে সংযোজন করতে পারে; যা ভোক্তা ও চাষি, উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এর কারণ নতুন জাতের এই ফসল স্বাদে-গন্ধে ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্য ও ফলন বৃদ্ধির ফলে চাষির কাছে সমাদৃত।

সময়ের ব্যবধানে জিনের পরিব্যাপ্তি (মিউটেশন) ও পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয় এক প্রাকৃতিক বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে বিকিরণ এবং রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারাও জিনের পরিব্যাপ্তিকে প্ররোচিত করা যায়। এটি প্রাকৃতিক নয়। তবে জীবের অভ্যন্তরে বিবর্তন, প্রাকৃতিক নিয়মে হোক বা প্ররোচনার মাধ্যমে প্রবর্তন হোক, দু’টিই উদ্ভিদের মূল দৈহিক প্রক্রিয়াকে একইভাবে প্রভাবিত করে। আগেই বলা হয়েছে যে, উদ্ভিদের দৈহিকতন্ত্রে অবস্থিত হরমোন যেমন গিব্বেরেলিন ও ফ্লোরিজেনে বিবর্তন বা প্রবর্তন, যে নিয়মেই হোক (প্রাকৃতিক নিয়মে বা প্ররোচনায় হোক); এই বিবর্তনে উদ্ভিদের মধ্যে সব সময় না হলেও মাঝে মধ্যে কিছু উন্নত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হতে পারে। এসব উন্নত বৈশিষ্ট্য উন্নতমানের ফসল উদ্ভাবনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ভালো বৈশিষ্ট্যের বিকলাঙ্গ জিনগুলো শনাক্ত করতে পারেন প্রজননবিদরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুলোর উন্নত বৈশিষ্ট্যের প্রলক্ষণ প্রজননে ব্যবহার করা হয়। এভাবে বহু বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারণ করা হয় প্রলক্ষণের সক্রিয় কার্যকারিতা।
ভবিষ্যতে জিন সম্পাদনার মতো নতুন নতুন কলাকৌশল প্রয়োগ করে, বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের দৈহিকতন্ত্র ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত উপরোল্লিখিত দু’টি হরমোনে আরো অনেক বেশি অভিনব বৈচিত্র্য আনতে পারবেন। এ বৈচিত্র্য শস্য উৎপাদন ও কৃষি উৎপাদনশীলতায় নতুন বিপ্লব নিয়ে আসতে পারে। কৃষি উৎপাদনশীলতার ইতিহাসে অন্যতম একটি মুহূর্ত সবুজ বিপ্লব। ভবিষ্যৎ খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলায় আরো একটি কৃষিবিপ্লব আবশ্যকীয়। উপরোক্ত নতুন প্রযুক্তি প্রক্রিয়া সম্ভবত এই নতুন বিপ্লবের সূচনা। এই নতুন বিপ্লব কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। (চলবে)

লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন, সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই