Naya Diganta

ইমরান খানের ব্যর্থতা ও সফলতা

ইমরান খান

গভীর নাটকীয়তা ও সাংবিধানিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটে হেরে গিয়ে সাড়ে তিন বছরের মাথায় ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এরই মধ্যে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের সব সদস্য পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ। জাতীয় পরিষদের ৩৪২ সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। পাকিস্তানে বারবার তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সঙ্কট ও অচলাবস্থা। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে সামরিক স্টাবলিশমেন্টের উচ্চাভিলাষ, সুশাসনের অভাব, দারিদ্র্য, শিক্ষার হারের কমতি ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অভাব। রাজনীতিতে অবাঞ্ছিত সেনা হস্তক্ষেপে পাকিস্তানে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, নির্বাচিত দলের কাছে শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষ করে হরতাল, ধর্মঘট, আন্দোলন চলমান থাকায় সে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হতে পারেনি। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শিল্পায়নের জন্য পাকিস্তানের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানির অভাবে জনগণের অবস্থা চরমে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এখন বাংলাদেশী এক টাকায় পাকিস্তানি দুই রুপি পাওয়া যায়।

২০১৮ সালে ‘নয়া পাকিস্তান’, ‘রিয়াসতে মদিনা’ গড়ার, দুর্নীতি উচ্ছেদ ও সুশাসন সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইমরান খান ক্ষমতায় আসেন। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিদ্যুৎ সঙ্কট ও মুদ্রাস্ফীতি প্রাপ্ত হন। তিনি পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণাÑ যদিও দু’পক্ষই এমন দাবি অস্বীকার করে। সাম্প্রতিক সময়ে স্টাবলিশমেন্টের সাথে সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বেশির ভাগ সময় ধরেই দেশটির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সামরিক স্টাবলিশমেন্টের হাতে। বিবিসি জানায়, জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নতুন কারো কথা ভাবছিলেন এবং বিভিন্ন পদে পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ইমরান খান, যিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আইএসআই প্রধান স্বপদে থাকুন সেটি চাইছিলেন ইমরান খান। তিনি মনে করছিলেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ তাকে আরো একবার জয়ী হতে সাহায্য করতে পারবেন। তার পদ পরিবর্তন বিষয়ক প্রজ্ঞাপন সপ্তাহ তিনেক আটকেও রেখেছিলেন ইমরান খান, যদিও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয় তাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া ও গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি। ফায়েজ হামিদ পরবর্তী সেনাপ্রধান হওয়ার আশা পোষণ করতেন। তার প্রতি ইমরান খানের ছিল সফট কর্নার। ২০১৬ সালে নওয়াজ শরিফ দুই সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল বাজওয়াকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। ২০১৯ সালে ইমরান খান দ্বিতীয় মেয়াদে জেনারেল বাজওয়াকে এক্সটেনশন প্রদান করেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। জেনারেল বাজওয়ার তৃতীয় মেয়াদে আরো একবার সেনাপ্রধান হওয়ার ইচ্ছা বাধ সাধেন ইমরান খান। শাহবাজ শরিফ হয়তো তৃতীয় মেয়াদে জেনারেল বাজওয়াকে এক্সটেনশন দিতে পারেন। এসব কারণে সেনাবাহিনীর সাথে ইমরান খানের সরকারের সম্পর্কের ফাটল আরো প্রকাশ্য হয়। পররাষ্ট্রনীতিতেও ইমরান খানের সাথে সেনাবাহিনীর মতবিরোধ ছিল। রাশিয়ান সেনাবাহিনী যে দিন ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রম করেছিল সে দিন মস্কো সফর করেছিলেন ইমরান খান। পশ্চিমা কর্মকর্তারা তদবির করছিলেন ইমরান খান যেন ভøাদিমির পুতিনের নিন্দা জানান। কিন্তু তাতেও তিনি সাড়া দেননি। ওদিকে সেনাবাহিনীর ছিল একেবারে ভিন্ন সুর। জেনারেল বাজওয়া সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাশিয়ার এ হামলা অবশ্যই অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে’। এর আগে ‘নিজের রাজনৈতিক ক্ষতির’ কথা ভেবে ভারতের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আংশিকভাবে পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে জেনারেল বাজওয়ার উদ্যোগ প্রতিহত করেছিলেন ইমরান খান (সিকান্দার কিরমানি, বিবিসি নিউজ, ইসলামাবাদ, ১০ এপ্রিল ২০২২)।

এ ছাড়া পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারের মতো একজন রাজনৈতিক নবিসকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ বিদ্রƒপের শিকার হয়েছিলেন ইমরান। ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও উসমানকে সরিয়ে দিতে রাজি হননি। পাঞ্জাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে ইমরান খানের ব্যর্থতায় সেনাবাহিনীতে বিরক্তি বৃদ্ধি পায়। ইমরান খানের জন্য অন্য আরো চ্যালেঞ্জ ছিল। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ও ডলারের বিপরীতে রুপির দাম কমে যাওয়াকেও অনেকে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কারণ বলে মনে করেন। ইমরান খান নিজে ও তার মন্ত্রীরাও অনেকবার স্বীকার করেছেন, সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করা যায়নি। সম্প্রতি একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ইমরান খান বলেন, ‘আমি দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেশের সিস্টেম তথা আমলাতন্ত্র সেই অভিঘাত সইতে পারল না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- সরকার ও দেশের মানুষের স্বার্থের কোনো সংযোগ-সেতু নেই।’ শাহবাজ শরিফ অভিযোগ করেন, এই সরকারের আমলে কয়েক বিলিয়ন টাকার চিনি, গম, ওষুধ, গ্যাস কেলেঙ্কারি হয়েছে। কিন্তু কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

ইমরান খান দাবি করেছিলেন, ‘তিনি দেশের অর্থনীতিকে বদলে দেবেন। আইএমএফের কাছে যাবেন না, ঋণ হ্রাস করবেন, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনবেন।’ সেখানে তার আমলেই মুদ্রাস্ফীতি থেকে শুরু করে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, রেকর্ড পতনে পাকিস্তানি মুদ্রার মূল্য ধাক্কা খায়। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি ঋণ ৩৯৯ ট্রিলিয়ন এবং এর মধ্যে পিটিআইয়ের অধীনে তিন বছরে ১৪৯ ট্রিলিয়ন রুপি ঋণ বেড়েছে। পিটিআই সরকারের আমলের এই ঋণ পিপলস পার্টি এবং মুসলিম লিগ-নওয়াজ, তাদের ১০ বছরের শাসনের সময় গৃহীত ঋণের ৮০ শতাংশের সমান (ইকোনমিক টাইমস)। সরকার রাজস্ব বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অতিরিক্ত এক হাজার বিলিয়ন টাকা ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে জনগণের ওপর। মন্ত্রিসভায় যোগ্য মন্ত্রীর অভাব ছিল। মন্ত্রীদের বক্তব্য বৈদেশিক সম্পর্ককে আরো খারাপ করে। চীন ও সি-প্যাক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা রাজ্জাক দাউদের বিতর্কিত বক্তব্য এবং সৌদি আরব সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশির বক্তব্য সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।

তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকারের সময়কালে গণমাধ্যমের দিক থেকে ইমরান খান বিতর্কিত হয়ে পড়েন। কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় অবাঞ্ছিত সাংবাদিকদের তালিকা, আবার কখনো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনলাইনে ‘ট্রলিং’য়ের অভিযোগ উঠেছে। এমন আইন প্রবর্তনের চেষ্টাও করা হয়েছে যার জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে প্রতিবাদ করতে হয়। এসবের মধ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। করাচির সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজমের পরিচালক সাংবাদিক আম্বার শামসি বলেন, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের সময় গণমাধ্যমে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তা পারভেজ মোশাররফ যুগসহ আগের যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি ছিল। ফলে পাকিস্তানের জনপ্রিয় পত্রিকা ডন ও জিও টিভি চ্যানেল ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অবিরত প্রপাগান্ডা চালায়।

ইমরান খানের ব্যর্থতার পাশাপাশি সফলতার দিকও আছে। সমাজসেবা ব্যবস্থার বেশ চমৎকার কিছু সম্প্রসারণ করেছেন তিনি। দেশের বেশির ভাগ স্থানে স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা চালু করেছেন। পিটিআই সরকার দাবি করছে, তাদের শাসনামলে পুরো অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে সস্তায় পেট্রল বিক্রি করা হয়েছে; রেকর্ড ট্যাক্স সংগৃহীত হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে ও রেমিট্যান্স এসেছে। পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরোর লেবার ফোর্স সার্ভের দাবি, গত তিন বছরে ৫৫ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে অর্থাৎ প্রতি বছর ১৮ লাখ মানুষের খেয়ে পরে বাঁচার সংস্থান হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশে করোনাকালীন লকডাউনের ফলে রফতানির সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটে, তখন বিদেশে থাকা ক্রেতারা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। উচ্চ রফতানি আদেশের কারণে ২০০০ সালে পাকিস্তানের টেক্সটাইল রফতানি ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এতে দেশের মোট রফতানি বৃদ্ধি পায় এবং অন্য দিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করে। করোনা মোকাবেলায় সরকার সফল হয়েছে। সে কারণে পাকিস্তানে মহামারী ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিপজ্জনক হয়নি। ভারতের চেয়ে পাকিস্তানে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও কম ছিল। পাকিস্তানে যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ এবং মৃত্যু ৩০ হাজার, সেখানে ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা চার কোটি ছাড়িয়েছে আর মৃত্যু হয়েছে পাঁচ লাখ ২১ হাজার মানুষের। ২০১৬ সালে খাইবার পাখতুনখাওয়াতে স্বাস্থ্যকার্ড চালু করা হয়। আর্থিক পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে যেতে অক্ষম নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসুবিধা দিতে এ কার্ড চালু করা হয়। ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রকল্প আরো সম্প্রসারিত হয় এবং তিনি আট কোটি নাগরিকের জন্য এই কার্ড দেয়ার ঘোষণা দেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণ অনেক সুবিধা পাচ্ছেনÑ ১. কার্ডধারীদের বছরে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসাসুবিধা পাবেন; ২. দেড় কোটি পরিবারকে অর্থাৎ আট কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয়া হবে ও ৩. অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, ব্রেন সার্জারি ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়া হয়।

ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের ব্যবস্থা করেন। এ প্রকল্পের জন্য একটি পৃথক ‘নিউ পাকিস্তান হাউজিং অথরিটি’ গঠন করা হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সাতটি শহরে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। সরকার ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার জন্য উৎসাহিত করে, যার মধ্যে বিভিন্ন সময়ের জন্য ২০ লাখ থেকে এক কোটি পর্যন্ত ঋণ প্রদান অন্তর্ভুক্ত করা হলো। একই সাথে সরকার নির্মাণ খাতের উন্নয়নে এবং দেশে বাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নির্মাণ খাতের জন্য দু’টি আলাদা স্কিম চালু করে। ২০১৪ সালে খাইবার পাখতুনখাওয়া সরকার ১০০ কোটি গাছের চারা রোপণের প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইমরান খান প্রকল্পটিকে এক হাজার কোটিতে উন্নীত করেন, যা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তাও পায়। জাতিসঙ্ঘ ও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের এই পরিকল্পনার প্রশংসা করে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে পরবর্তীকালে একই ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। এ প্রকল্পটি দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে বেশ গুরুত্ব অর্জন করে (বিবিসি, ঢাকা পোস্ট ডটকম, ১০ এপ্রিল, ২০২২)।

নতুন সরকার কিভাবে দেশ চালায় তার জন্য পাকিস্তানের জনগণকে অপেক্ষা করতে হবে। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে গঠিত সরকার কত দিন টিকে থাকে তা দেখার বিষয়। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের ওপর ভরসা করা কঠিন। তবে নবগঠিত সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ থাকায় দেড় বছর পর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন পর্যন্ত সরকার বহাল থাকার সম্ভাবনা আছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, ভদ্র ও দূরদর্শী। সামরিক প্রতিষ্ঠানের সাথে অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্বে তিনি জড়াতে চান না। আলজাজিরার বিশ্লেষণ মতে, ৭০ বছর বয়সী শাহবাজ শরিফ তার নিজের যোগ্যতা বলে একজন হেভিওয়েট রাজনীতিক। এ ছাড়া তিনি তিনবারের পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী, পরিবারের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আবেগপ্রবণ ও উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যসহ তিনি একজন কঠোর প্রশাসক। তিনি বক্তৃতায় বিপ্লবী কবিতা উদ্ধৃত করতে পছন্দ করেন এবং তাকে একজন কর্মপাগল মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার বিরুদ্ধে ট্যাবলয়েড পত্রিকার নৈতিক ও আর্থিক নানা অভিযোগ তোলা সত্ত্বেও তিনি জনপ্রিয়। নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘পাকিস্তানের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু হচ্ছে চীন। সবসময়ই চীন আমাদের বন্ধু ছিল, চিরদিন থাকবে। কেউ চীনের সাথে পাকিস্তানের বন্ধুত্বে চিড় ধরাতে পারবে না।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক পরিচালিত হবে। ‘বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করার তো কোনো অর্থ নেই।’

আফগানিস্তানের তালেবানের প্রতি সমর্থন, মার্কিনবিরোধী ভূমিকা, পশ্চিমাদের ইসলামোফোবিয়া, মুসলিম জাতিসত্তার জাগরণ, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য, জাতিসঙ্ঘে প্রদত্ত ভাষণ, বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা তরুণ প্রজন্মের কাছে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে। সাংবিধানিক সঙ্কট চলাকালে ইসলামাবাদসহ বড় বড় শহরে তার দলের লাখ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ তার প্রমাণ। ইমরান খান ও তার সমর্থকরা মার্কিন ও পশ্চিমাবিরোধী মানসিকতা পোষণ করেন। নির্বাচনে এই ইস্যুকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করবেন তারা, এমন ধারণা বিশ্লেষকদের। সাম্প্রতিক সময়ে খাইবার পাখতুনখাওয়ার স্থানীয় নির্বাচনে তেহরিক-ই-ইনসাফের বিপুল বিজয় পুরো দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পাকিস্তানে যখনই কোনো প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে চেয়েছেন তারা হয়তো ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, নইলে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। লিয়াকত আলী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল জিয়াউল হক, বেনজির ভুট্টোর অস্বাভাবিক মৃত্যু তার দৃষ্টান্ত। ইমরান খানও প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘তাকে হত্যা করা হতে পারে’। এ কথাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানের ইতিহাসে যেসব রাজনীতিক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে শাহাদত বরণ করেন, তাদের কোনো ঘাতকের বিচার হয়নি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কেউ জানতে পারেনি। এটি কেবল রহস্যজনক নয়, রীতিমতো উদ্বেগজনকও বটে। স্টাবলিশমেন্টকে পাশ কাটিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতায় ইমরান খান ফিরে আসতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেনা হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে। জেনারেল জিয়াউল হক সংবিধানের ধারা সংশোধন করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পথ সুগম করেন। দ্য আর্টিক্যাল ৫৮(২)(বি)-তে বলা হয়েছে- ‘জাতীয় সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারবে।’

তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো- পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, স্টাবলিশমেন্টের হস্তক্ষেপ নানা অভিযোগ সত্ত্বেও সে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশে পার্লামেন্ট পুনর্বহাল হয়, অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা হারান, মিডিয়া ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করতে পারে এবং বিরোধী দল রাজপথে সমাবেশ করার অধিকার রাখে। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আদালতের স্বাধীনতা ও জনমত প্রকাশের মৌলিক অধিকার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রের নেই। এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com