Naya Diganta

প্রসঙ্গ : শক্তিশালী বিরোধী দল

১১ এপ্রিল ২০২২ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তিনি দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল খুঁজে পাচ্ছেন না। একটি রাষ্ট্রে সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়েই টেকসই অবাধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, এ কথাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলে আসছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর কথাই প্রমাণ করে যে, দেশে অবাধ গণতন্ত্র নেই। অথচ তিনি ও তার পর্ষদ বারংবারই বলে আসছেন যে, বাংলাদেশে অবাধ গণতন্ত্র রয়েছে যা শেখ হাসিনারই অবদান, যে কারণে সরকারি দলের পক্ষ থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ উপাধি দেয়া হয়। গণতন্ত্রের মানসকন্যার রাষ্ট্রে যদি ‘গণতন্ত্র’ অবরুদ্ধ থাকে বা পা পিছলে পড়ে যায় তবে তার সফলতা ও ব্যর্থতার দায় কার কাঁধে বর্তায়?

প্রকৃত কথা এই যে দেশে গণতন্ত্র থাকা তো দূরের কথা, সামান্য রাজনীতিও কি আছে? একটি হচ্ছে অবাধ স্বচ্ছ রাজনীতির চর্চা। আরেকটি হচ্ছে হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ারার অংশীদার হওয়া। দেশে চলছে হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ারা। রাজনীতি বলতে রাষ্ট্রীয় ও জনগণের সম্পর্কিত সব বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সমস্যা নিরূপণ করে তার সমাধানের জন্য আত্মনিয়োগ করা। কিন্তু সে সুযোগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আছে কি? বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে মোটা দাগে রাজনীতি বলতে বুঝায়, যে দল ক্ষমতায় আছে সে দলকে যেকোনো কৌশলে ক্ষমতায় থাকতে হবে। এর সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক আপাতত দেখা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে যারা ক্ষমতায় ছিল (এখন নাই) তাদের প্রচেষ্টা হলো যেকোনো প্রকারেই হোক ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা। গোটা বিশ্বে যেখানে সৌদি আরবের মতো রাজতন্ত্র আছে সেখানে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেন বা থাইল্যান্ডের মতো যেখানে রাজতন্ত্র আছে অথচ সেখানে অবাধ রাজনীতি করার সুযোগ থাকার টেকসই গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে। বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চার যে সুযোগ তা রাজতান্ত্রিক না হলেও একটি ‘নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক’ অবস্থা চলছে। অর্থাৎ গণতন্ত্র এখানে সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে, সরকার যতটুকু অনুমতি দেয় গণতন্ত্র ততটুকুই এগুতে পারে। স্বাধীনতার পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার সম্পাদিত ‘হক কথা’ পত্রিকায় তৎকালীন গণতন্ত্রকে ঈড়হঃৎড়ষষবফ উবসড়পৎধপু উল্লেখ করেছিলেন। অথচ স্বাধীনতার অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল অবাধ গণতন্ত্র।

গণতন্ত্র যখন নিজ গতিতে চলতে পারে না, তখন মুখ থুবড়ে পড়া গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার জন্য যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা-ও সুখকর নয় কারো জন্যই, তথাপি এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে যা দিন ক্ষণ নির্ধারণ করে আসে না। গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলে রাজনীতির চর্চা নেই বা ভিন্ন ভাবে বলা যেতে পারে যে, রাজনীতির চর্চা নেই বলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। বিষয়টি যাই হোক গণতন্ত্র বা রাজনীতি চর্চার আঁতুড়ঘর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা চর্চার প্ল্যাটফর্ম হলো একটি রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র আছে কি? ব্যতিক্রম বামপন্থী ও জামায়াতে ইসলামী। ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না।

একটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে মতাদর্শভিত্তিক এবং যেখানে পৃষ্ঠপোষক অর্থাৎ অর্থনৈতিক জোগানদাতা, নেতা, কর্মীর সমন্বয়ে। নেতার দায়িত্ব কর্মী সৃষ্টি করা ও নেতাকর্মীর সমন্বয়ে জনমত সৃষ্টি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে জনগণের সেবা করা। এছাড়া যারা পৃষ্ঠপোষক পর্দার আড়াল থেকে তারা অর্থনৈতিক জোগান দিতো। তারা কিন্তু রাজনীতিতে হাত দিত না। এখন যারা পৃষ্ঠপোষক অর্থাৎ ধনিক শ্রেণী তারাই এখন মন্ত্রী/এমপি হওয়ার নেশায় বিভোর। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘নমিনেশন বাণিজ্য’ বা ‘কমিটি বাণিজ্য’ কথাগুলো ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। মোটা দাগে অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া বড় দলগুলো ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের পকেটস্থ হয়ে পড়ায় রাজনীতি এখন একটি অলিখিত ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশুদ্ধ বা নিখাদ রাজনীতির সেই মজা এখন আর নেই।

সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানব সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের উল্লিখিত অনুচ্ছেদ এ ‘গণতন্ত্রকে’ যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা যুগে যুগে ‘গণতন্ত্রের’ চেহারা যেভাবে উন্মোচিত করেছেন সে কারণেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তনযোগ্য হয়ে পড়েছে।

দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর যে উপলব্ধি হয়েছে তা সঠিক কি না তা নির্ধারণের আগে যাচাই হওয়া বাঞ্ছনীয় যে, প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান, দলপ্রধান ও জোটপ্রধান হিসাবে গণতন্ত্র রক্ষায় কি ভ‚মিকা দায়িত্বের সাথে পালন করেছেন? সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, দেশের প্রশাসনিক কোন পর্যায়ের নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পেরেছে? জাতীয় স্থানীয় নির্বাচনে কোথায় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল? ব্রæনাইয়ের সুলতান (অর্থাৎ রাজা) নিজেই সে দেশের সেনাপ্রধান এবং নিজেই পুলিশপ্রধান। পুলিশ ও সেনা যার হাতের মুঠোয় বন্দী সেখানে কোনো প্রতিবাদ করে প্রতিকারের আশা করা যায় না। বাংলাদেশও কি এখন একই জায়গায় এসে যায়নি?

বাংলাদেশে মূলত তিনটি দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল এবং তিনটি দলই একে অপরের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র লঙ্ঘনের যে অভিযোগ তুলেছেন জনগণের মানদণ্ডে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ এখনো হয়নি। জনগণের হতাশা থেকেই রাজনীতিতে জনসম্পৃক্তরা এখন একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে।

ক্ষমতায় যিনি থাকেন তার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো সংবিধান মোতাবেক যে শপথ তিনি করেছেন তার প্রতি অনুগত থাকা। শপথের আনুগত্য ক্ষমতাসীনরা কতটুকু করেছেন তা তো নিজেরাই জানেন। মানিলন্ডারিং ও বিদেশে অর্থপাচারের যে মহামারী চলছে তা উপলব্ধি করে দেশের সচেতন মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। ফলে শ্রীলঙ্কার মতো ঘটনার আশঙ্কা অনেকে করলেও সরকারের দায়িত্বশীল মহল সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। এ সাফাই সরকারের দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়ার চেয়েও তারা যে আতঙ্কগ্রস্ত তার প্রমাণ মেলে। দুদক এ সম্পর্কে নির্বাক এ কারণে যে, তারা সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে দায়মুক্তি দিতে স্বস্তি বোধ করেন। এটি শুধু দুদকের সংস্কৃতি নয় বরং সব আমলার মজ্জাগত সংস্কৃতি।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com