Naya Diganta

রোজার তাৎপর্য, রমজান মাসের গুরুত্ব ও আমাদের করণীয়

আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করার জন্যই মানুষ সৃষ্টি করে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ইবাদত দু’ধরনের। এর একটি হলো- হাক্কুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর হক। আর অপরটি হলো হাক্কুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হক। আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত অধিকার বা কর্তব্যকে হাক্কুল্লাহ বলে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য অনেক ধরনের ইবাদত করি। সেগুলোর মধ্যে কিছু ইবাদত শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট। যেমন- সালাত (নামাজ), সাওম (রোজা), হজ ইত্যাদি। আল্লাহর হক আদায়ের আগে প্রত্যেক মানুষকে অন্তর থেকে যা বিশ্বাস করতে হবে তা হলো- আল্লাহ আছেন, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। তাঁর আদেশেই পৃথিবীর সবকিছু আবার ধ্বংস হবে। আমাদের জীবন-মৃত্যু সবই তাঁর হাতে। পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। তাঁর হাতেই সব সৃষ্টির রিজিক। আমরা তাঁরই ইবাদতকারী। তিনি ব্যতীত উপাসনার উপযুক্ত আর কেউ নেই। এ সব কিছু মনে প্রাণে বিশ্বাস করা ও স্বীকার করাই হলো বান্দার ওপর আল্লাহর হক।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়েই মানুষকে বসবাস করতে হয়। আমরা পিতামাতা ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী নিয়ে সামাজিকভাবে একসাথে বসবাস করি। একজনের দুঃখে অন্যজন সাড়া দিই। আপদে বিপদে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করি। পরস্পরের প্রতি এ সহানুভূতি দায়িত্বই হলো হাক্কুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হক বা অধিকার। মানুষের প্রতি মানুষের হক বা অধিকারকে আটটি ভাগে ভাগ করা যায় যেমন (১) নিকটাত্মীয়ের হক, (২) দূরাত্মীয়ের হক, (৩) প্রতিবেশীর হক, (৪) দেশবাসীর হক, (৫) শাসক-শাসিতের হক, (৬) সাধারণ মানুষের হক, (৭) অভাবী লোকের হক এবং (৮) অমুসলিমদের হক। প্রতিটি মুসলমানের আল্লাহর হক পালন করার সাথে সাথে মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে।

সাওম আরবি শব্দ। এর ফারসি প্রতিশব্দ হলো রোজা। এর আভিধানিক অর্থ হলো বিরত থাকা। ইসলামী শরিয়াতের পরিভাষায় সাওম হলো- সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সাথে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা। প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক নারী-পুরুষের ওপর রমজান মাসের এক মাস সাওম পালন করা ফরজ। রোজা ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভের একটি। আল্লাহ তায়ালা মানুষের ধৈর্যের শিক্ষাদান ও রিপু দমন করার জন্য রোজা ফরজ করেছেন। রোজা পালনের বিধান পূর্ববর্তী সব উম্মতের জন্য অপরিহার্য এবাদত ছিল। এ প্রসঙ্গে মহাল আল্লাহ বলেন- ‘হে ঈমাদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অর্জন করতে পারো’ (সূরা : বাকারা-১৮৩)।

রোজা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অন্য এক আয়াতে বলেন- ‘রমজান মাস এমন মাস, যার ভেতর কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের পথপ্রদর্শক এবং সত্য পথ প্রদর্শনের ও সত্য-মিথ্যার প্রভেদ করার স্পষ্ট নিদর্শন। তোমাদের মধ্যে যে রমজান মাস প্রাপ্ত, সে যেন তাতে রোজা রাখে।’ (সূরা : বাকারা-১৮৫)।

রোজা পালন করলে মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ধনীরা গরিবের অনাহারে অর্ধাহারে জীবনযাপনের কষ্ট অনুধাবন করতে পারে। ফলে তারা দানখয়রাতে উৎসাহিত হয়। রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা, ধূমপানে আসক্তি ইত্যাদি বদভ্যাস ত্যাগ করতে পারে।

রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বমানবের মুক্তি সনদ সর্বাঙ্গীণ জীবনব্যবস্থা পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। এর দ্বারা রমজান মাসের বিশেষ ফজিলতের কথাই প্রমাণিত হয়। রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার সব প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের জন্য বিশেষ ইবাদত রোজা ফরজ করে অশেষ নেকি হাসিল করার এবং আল্লাহ তায়ালার রহমত, মাগফিরাত ও দোজখের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের বিশেষ সুযোগ দিয়েছেন। এ মাসে তারাবিহর নামাজ আদায় করে আল্লাহ তায়ালার বান্দারা তাঁর নৈকট্য অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করে। এ মাসের অপর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এ মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল ইবাদত আদায় করে সে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করে, সে অন্যান্য মাসের ৭০টি ফরজ কাজ আদায় করার সওয়াব লাভ করবে। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যাকে বলা হয় ‘কদরের রাত’। এ রাতে যারা ইবাদত-বন্দেগি করবে তারা এক হাজার মাসের ইবাদত-বন্দেগি করার সওয়াবের তুল্য সওয়াব পাবে।

কদরের রাত কোনটি সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কুরআন মাজিদে কিছু বলা হয়নি। নবী মহাম্মদ সা:কে সাহাবিরা শবেকদর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় তারিখে শবেকদরের তালাশ করো। শবেকদর যেন কোনোভাবে ছুটে না যায় সে জন্য অনেক মুমিন মুসলমান রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ পালন করেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মতে, ২৭ রমজান হলো শবেকদরের রাত। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সূরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ বাক্যটি তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাক্যটি লিখতে নয়টি হরফ ব্যবহৃত হয়েছে। নয়কে তিন দ্বারা গুণ করলে সাতাশ হয়। আর এ কারণেই তার ব্যাখ্যানুযায়ী রমজানের ২৭ তারিখের রাতই হলো শবেকদর অর্থাৎ কুরআন নাজিলের রাত।

হাদিস শরিফে আছে, ‘যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করায়, তার বরকতে সে ব্যক্তি সব পাপ থেকে নাজাত লাভ করে এবং দোজখ থেকেও তার মুক্তি লাভ ঘটবে। আর ওই রোজাদার ব্যক্তি রোজার বদলে যে সওয়াব লাভ করবে, সেও তার সমপরিমাণ সওয়াবের ভাগীদার হবে। এর দ্বারা রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না।’ মুহাম্মদ স:-এর কাছ থেকে এ কথা শ্রবণ করার পর উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রত্যেকের এমন খানাপিনা নেই, যার দ্বারা রোজাদারকে ইফতার করাতে পারি।’ তখন তিনি বললেন- ‘একটি খুরমা, একটু দুধ, একটু পানি দ্বারা যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ব্যক্তি এ সওয়াব হাসিল করবে।’ এ মাসটি উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহ তায়ালার খাস রহমত। মুহাম্মদ সা: আরো বলেন- ‘আমার উম্মতকে রমজান মাসে এমন পাঁচটি নেয়ামত দান করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোনো নবীর উম্মতকে দান করা হয়নি।’ এ নেয়ামতগুলো হলো- (ক) রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মেশক বা কস্তুরির চেয়েও অধিক সুগন্ধি বলে বিবেচিত; (খ) এ মাসে রোজাদারের পক্ষ হয়ে পানির মাছ আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে; (গ) রোজার মাসে প্রতিদিন বেহেস্তকে নতুন নতুন সাজে সাজানো হয় এবং আল্লাহ পাক বেহেস্তকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমার নেক বান্দারা পৃথিবীর দুঃখপূর্ণ জীবন শেষ করে তোমাদের বুকে স্থান নেয়ার জন্য শিগগিরই আসছে; (ঘ) রমজান মাসে শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়। আর এ জন্য শয়তান অন্য মাসের মতো এ মাসে রোজাদারকে ধোঁকা ও বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে না এবং (ঙ) এ মাসের শেষরাতে রোজাদার বান্দাদের সমুদয় গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার কথা ঘোষণা দেয়া হয়। প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে আত্মরক্ষার হাতিয়ার হলো রোজা। রোজা পালনের মাধ্যমে পানাহারে নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এতে অনেক রোগ দূর হয় ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

রোজাদার ব্যক্তি নিম্নের ছয়টি বিষয় যত্মসহকারে আমল করতে পারলে আল্লাহর রহমতে রোজার সওয়াব ও বরকত লাভ করে ইহকাল ও পরকালের সাফল্য লাভ করতে পারবে-

(১) রোজাদার নিজের চোখের নজরকে হেফাজত করবে। শরিয়তে জায়েজ নেই এমন কিছুর প্রতি চোখের নজর যাতে না পড়ে এর প্রতি সতর্ক থাকা। এমনকি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দিকে এমনভাবে তাকাবে না যাতে একের প্রতি অন্যের কামভাব জাগ্রত হয়। অলিয়ে কামেল বুজর্গানে দ্বীন বলেন, ‘যে জিনিসের প্রতি নজর পড়লে মানুষের দিল আল্লাহ তায়ালার দিক থেকে অন্য দিকে ফিরে যায়, এমন কোনো জিনিসের প্রতি রোজাদারের নজর না দেয়াই উচিত।’

(২) রোজাদার নিজের জবানকে হেফাজত করবে। অর্থাৎ মিথ্যা কথা বলা, বাজে কথা বলা, অন্যের গিবত বা কুৎসা করা, কাউকে গালিগালাজ করা ইত্যাদি থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। রোজা রেখে জবান সংযত না করলে রোজার বরকত থাকে না। মুহাম্মদ সা: বলেন, ‘কোনো রোজাদারের সাথে যদি কেউ ঝগড়া করতে চায়, তবে রোজাদার ব্যক্তি যেন তাকে বলে দেয় যে, আমি রোজা রেখেছি’ (অর্থাৎ অন্যের উসকানি সত্ত্বেও ঝগড়ায় জড়িত না হয়ে রোজার মর্যাদা রক্ষা করবে)। আর কথা বলার পরও যদি ওই ব্যক্তি না শোনে, তবে নিজ মনকে সান্ত্বনা দেবে এ বলে, রোজা রেখে তার পক্ষে কলহে লিপ্ত না হওয়া উচিত।

(৩) রোজাদার নিজ কানের হেফাজত করবে। যেসব বাক্য বলা পাপ তা শোনাও পাপ। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে- যে গিবত করে আর যে ব্যক্তি তা শ্রবণ করে উভয়ে গুনাহগার। সুতরাং গানবাজনার শব্দ থেকেও কানকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

(৪) শরীরের অন্য অঙ্গগুলোকে সব অন্যায় কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখবে। যেমন- হাত দ্বারা অন্যায়ভাবে কিছু স্পর্শ না করা, পায়ের দ্বারা কোনো খারাপ পথে না যাওয়া ইত্যাদি।

(৫) হালাল রোজগার দিয়ে হালাল বস্তু ক্রয় করে ইফতার করবে। হাদিস শরিফে আছে- হারাম বস্তু যদি এক গ্রাস পরিমাণও খায়, তাতে চল্লিশ দিনের ইবাদত-বন্দেগি নষ্ট হয়ে যায়। অতএব, হারাম বস্তু দ্বারা যাতে ইফতার করতে না হয় সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে এবং

(৬) ইফতা-সাহরিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। কেননা রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সংযমী হওয়া এবং মানুষের অন্তরের পশুশক্তিকে নিস্তেজকরত আত্মার শক্তিকে সজীব করা। মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ দেহকে সবল করে পশুশক্তিকে জোরদার করে এবং আত্মার শক্তিকে কমিয়ে দেয়। এ জন্য মুমিন মুসলমারা সবসময় বিশেষত রোজার মাসে পরিমিত খাদ্য গ্রহণে তৃপ্ত হয়ে থাকেন।

রমজানের এক মাস ইবাদত-বন্দেগি ও সংযমের মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের সবধরনের অন্যায় ও অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখার যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা পরবর্তী এগার মাস ধরে রাখতে পারলে তাদের পক্ষে সবধরনের অন্যায় ও অনৈতিক কাজ পরিহারপূর্বক জীবনধারণ সম্ভব। আর এরূপ জীবনধারণ যারা করতে পারবেন তাদের ইহকাল ও পরকাল উভয়ই সফল।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com