Naya Diganta

দূষিত বায়ুর দেশ

২৬ মার্চ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের ৫১তম স্বাধীনতা দিবস পালিত হলো। আমাদের এ স্বাধীনতা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লাখ লাখ মানুষ যেমন জীবন দিয়েছেন, তেমনি অসংখ্য মা-বোন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ স্বাধীনতার জন্য এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছেন, সাড়ে তিন কোটি মানুষ ঘরহারা হয়েছিলেন। একাত্তরের আগুনঝরা দিনগুলোতে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী কোনোভাবেই ভুলবার নয়। সেই নৃশংসতার বিরুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসে লড়েছেন। প্রাণ উৎসর্গ করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি। রক্ত দিয়েই আমরা লিখিয়েছি বাংলাদেশের নাম। আমাদের এ স্বাধীনতা সম্পর্কে সেদিন লন্ডন টাইমসের মন্তব্য ছিলÑ ‘যদি রক্তের দামে স্বাধীনতা কিনতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে বেশি মূল্যে কেউ স্বাধীনতা কিনেনি।’ স্বাধীনতার ৫১তম বার্ষিকীতে তাই আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন।

আমাদের এ স্বাধীন দেশকে আমরা ভালোবাসি। এ দেশকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। কবির কবিতায় আছেÑ ‘এমন দেশটি কোথাও খোঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।’ সত্যিই তাই, ঋতুবৈচিত্র্যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপা বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া ভার। কবি জীবনানন্দ দাশ সেই ১৯৩২ সালে লিখেছিলেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতা। সেই কবিতায় বাংলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে তিনি বিশ্বের রূপ দেখতে পেয়েছিলেন। পৃথিবীর রূপবৈচিত্র্যে তার কোনো মোহ নেই। তিনি লেখেন, ‘তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর...।’ একদিন এমনই ছিল আমাদের এ দেশ। আজ খারাপ লাগে যখন দেখি দেশটির সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক গতিধারা বাধা পাচ্ছে।

আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ হবে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক দেশ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত ৫১ বছরে তা নিশ্চিত হয়নি। গণতন্ত্র যে নির্বাসিত হয়ে গেছে, তা না বলাই ভালো। শ্রমিক, কৃষকসহ সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ তো হয়ইনি, উপরন্তু জীবন চালাতে আজ তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য এতটাই বেড়েছে যে, টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঁচার জন্য মানুষের হাহাকার শোনা যাচ্ছে। টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাকের পেছনে অসহায় মানুষের দীর্ঘ লাইন এরই প্রমাণ। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে হয়তো অচিরেই দেখতে হবে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে।

বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষ বাংলাদেশ
স্বাধীনতা দিবসের দু-তিন দিন আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং প্রচারিত একটি খবর আমাদের সবাইকে বিষণœ করেছে। যে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে আমরা গর্ব করি, ঋতুবৈচিত্র্যে মুগ্ধ হই, যে দেশের নদী-নালা, পাহাড়, বন-বনানী চক্ষু শীতল করে, মওসুমি বায়ু প্রাণ জুড়ায়Ñ সে দেশটি এখন বিশ্বের একনম্বর দূষিত বায়ুর দেশ। গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালেও বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ ছিল বাংলাদেশ। অবস্থানে কোনো নড়চড় হয়নি। দূষিত বায়ুর রাজধানী শহরের তালিকায় গতবারের মতো এবারও দ্বিতীয় হয়েছে ঢাকা।

সুইজারল্যান্ডের দূষণরোধকারী প্রযুক্তি সেবাদাতা সংস্থা আইকিউ এয়ারের ‘বিশ্ব বায়ুমান প্রতিবেদন-২০২১’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুমান পর্যালোচনা করা হয়।

রিপোর্টে বলা হয়, আগের প্রতিবেদনগুলোতে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-১০ ও পিএম-৫ এর উপস্থিতিকে আমলে নেয়া হতো। আর এবার নেয়া হয়েছে আরো অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণাকে যার পিএম-২.৫। দেশভিত্তিক বায়ুমান পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ বাংলাদেশ। এরপর রয়েছে আফ্রিকার দেশ চাদ, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান ও ভারত। সবচেয়ে দূষিত রাজধানী শহরের মধ্যে রয়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। এর পরেই রয়েছে ঢাকা, চাদের রাজধানী এনজামেনা, তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে এবং ওমানের মাসকাট।

স্মল পার্টেকল বা সূক্ষ্ম বস্তুকণা যে বাতাসে যত বেশি, সে বাতাস বা বায়ু দূষিত বেশি। এই বস্তুকণা নিঃশ্বাসের সাথে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ফুসফুসের নানা রোগ দেখা দেয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে মূলত ধুলা ও ধোঁয়াদূষণের কারণে এ ধরনের বস্তুকণার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আইকিউ এয়ারের এ রিপোর্টটিতে বলা হয়, এ দূষিত বায়ু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের গড় আয়ু এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে।

অনেক দেশ বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়েছে। একসময় চীনে এ ধরনের দূষণ ভয়াবহ ছিল। তবে চীন যথাযথ উদ্যোগ নেয়ায় বায়ুমান পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বহু আগ থেকেই বায়ুদূষণ পরিস্থিতি খারাপ হওয়া সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্র ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুমান পরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে আসছে। কিন্তু কেউ তাতে গা লাগায়নি। রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্রের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়, ঢাকার বায়ুদূষণের অর্ধেক তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধোঁয়া ও ধুলা থেকে হচ্ছে। আর ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস হচ্ছে খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা। ঢাকার দূষণে ধারাবাহিকভাবেই দেখা গেছে ধোঁয়া এবং ধুলার প্রভাব বেশি এবং তা বাড়ছেই।

বায়ুমান গবেষক অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে জানান, ঢাকা শহর ও পুরো বাংলাদেশে বায়ুদূষণ রোধে জরুরি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে বাধ্য। বায়ুদূষণরোধে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর অবহেলা আগের তুলনায় এখন আরো বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তাদের যেন কোনো দায় নেই। হাত-পা গুটিয়ে তারা বসে আছে। বায়ুদূষণ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেই তারা নগরজুড়ে উন্নয়ন কাজের কথা বলেন। অবকাঠামো উন্নয়নে এ অসুবিধাটুকু মানুষকে মেনে নিতে হবে বলে সবক দেন। কিন্তু যে কাজটুকু তাদের করার দায়িত্ব রয়েছে; তা নিয়ে তাদের কোনো কথা নেই। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে শর্ত মানা। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নামে সরকারের একটি সংস্থা আছে। নির্মল বায়ু ও পরিবেশ বিষয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে তারা টাকা ব্যয় করছে ঠিকই। কিন্তু বায়ুর মানে উন্নতি হচ্ছে না। বায়ুদূষণ দেশের অর্থনীতিরও বড় ক্ষতি করছে। বৈশ্বিক সূচকে এমন নেতিবাচক অবস্থান বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি করছে। এমন পরিস্থিতি বিদেশী বিনিয়োগকেও নিরুৎসাহিত করবে। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য বায়ুদূষণরোধে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ঢাকা আজ ক্যান্সার রোগী!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: সামছুল হক নগর গবেষক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারীও তিনি। গণপরিবহন ও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়েও গবেষণা করেছেন। সম্প্রতি ঢাকার ভয়াবহ যানজট পরিস্থিতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সহযোগী দৈনিকে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তার চোখে ঢাকা এখন খেয়াল খুশির উন্নয়নে এক ক্যান্সার রোগী।

চলমান প্রকল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. হক বলেন, একের পর এক প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পরও একই ধরনের আরো ‘মোটাতাজা প্রকল্প’ নেয়া হচ্ছে। কারণ এখানে কারো কোনো জবাবদিহি নেই। এসব প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপকৃত হচ্ছেন বা তাদের উন্নয়ন হচ্ছে। জনগণ বা ঢাকার কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। তিনি বলেন, সুন্দর সুন্দর কথা বলে প্রকল্প পাস করানো হয়। কাজ করার পর এর পুনর্মূল্যায়ন হয় না। চটকদার কথা বলে সাতটি উড়াল সেতু করা হলো। সেটার ওপর যানজট লেগে থাকে। ঢাকার যানজট এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, আর্মি নামিয়েও সমাধান করা সম্ভব হবে না। যারা কোনো দিন মেট্রোরেল করেনি, বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) করেনি তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। ফলে তা ঝুলে যাচ্ছে। এখন বিশ্বজুড়ে এ বিশ্বাস চলে এসেছে যে, গণপরিবহনই টেকসই সমাধান দেবে, উড়াল সড়ক নয়। আর আমরা ষাটের দশকের উন্নয়নের ধারণা ঢাকা শহরের মতো মেগাসিটিতে আমদানি করে শহরটির অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলছি। যানজটে ঢাকা দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

ড. সামছুল হক আরো বলেন, এক দশক আগে ঢাকার যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। সেখান থেকে নামতে নামতে সেটি এখন ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। প্রায় হাঁটার গতির সমান। ঢাকার অবস্থা এখন অনেকটা ‘ক্যান্সার রোগীর’ মতো। তার হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে কমে আসছে। সত্যিই বড় দুর্ভাগ্য আমাদের।

শব্দদূষণেও ঢাকা বিশ্বের একনম্বর নগরী
বাংলাদেশ শুধু দূষিত বায়ুর দেশই নয়, শব্দদূষণের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই শব্দদূষণ ভয়াবহ মাত্রায় রয়েছে। রাজধানী ঢাকার শব্দদূষণ বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে।

জাতিসঙ্ঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) প্রতিবেদন ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’-এ বলা হয়েছে বিশ্বের ৬১টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ ঢাকায়। এ শহরে বেশির ভাগ সময় শব্দের মাত্রা থাকে সহনীয় মানের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এ শব্দদূষণ বাসিন্দা, পথচারী ও চলাচলকারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। ঢাকার শব্দের গড় তীব্রতা ১১৯ ডেসিবেল, যা বিশ্বের ৬১টি প্রধান শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী শব্দের সনহীয় মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। সেখানে ঢাকায় গড়ে ১১৯ ডেসিবেল। শব্দদূষণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এবিএম বদরুজ্জামান বলেন, ঢাকা নগরী এখন শব্দদূষণের স্তর থেকে শব্দবোমার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
Email:abdalb2@gmail.com