Naya Diganta

একটি পাতার আত্মজীবনী

একটি পাতার আত্মজীবনী

তপ্ত দুপুরে দখিনা বাতাস। বাতাসের রেশ কী যে স্নিগ্ধ ও উৎফুল্লতা যা বলা বাহুল্য। বাতাসের সাথে ভেসে আসছিল বসন্তের নতুন ডাক ক-হু কু-হু। হাঁক ছেড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে কোকিল পাখির পাল। চেয়ে চেয়ে দেখছি তাদের আনন্দ-উল্লাস। মাথা বরাবর ছাউনি বিছানো ছিল নীল আকাশ। সাদা মেঘের দেখা নেই। শুধুই নীল আকাশ।
বাঁশের তৈরি রাবির চারুকলায় বানানো একটি সুন্দর মোড়ায় বসে আছি। সুখের কুঁড়েঘর বানাব বলে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছি নীল আকাশের ছাউনির নিচে। কিন্তু, সুখের কুঁড়েঘর বানানোর ভাবনাটা দখিনা বাতাসের সাথেই কেড়ে নিয়ে গেল একটি ঝড়ে পরা পাতার দুঃখভরা জীবন দেখে।
গাছ থেকে ঝড়ে পড়া পাতাটি আমার হাতের কবজি বরাবর পড়ে। পাতাটি আমায় সুখের কুঁড়েঘর বানানোর ভাবনা থেকে দূরে ঠেলে দিলো এক বিষাদের কুঁড়েঘরে। যেখানে কেবল অত্যাচার আর নিপীড়ন। নেই অনূভুতি। নেই ভালোবাসা।
ঝড়ে পড়া পাতাটির আত্মজীবনী উপলব্ধির অংশটুকু, একটা সময় ছিল আমি খুব ছোট্ট ছিলাম। তখনকার সময়ে আমার গায়ের রঙ ছিল হালকা টিয়ে। সময়ের পালাবদলের সাথে সাথে বেড়ে উঠতে লাগলাম। বড়ও হয়ে গেলাম। তখন আমার গায়ের রঙ একেবারে সবুজ। সবুজ মানে গাড় সবুজ। আমার সৌন্দর্য অন্য পাতাদের মতোন হাল্কা সবুজ নয়। গাড় সবুজের সাথে মিশে আছে কালো রঙের রেশ।
আমার মতো অনেক পাতা আছে যে, পাতাগুলো আমাকে দেখে হিংসা করত। আমার সাথে মিশতে চাইত না। তীব্র বেগে আসা দখিনা বাতাস যখন গাছটির ডালগুলো হেলেদুলে এদিক-ওদিক দুলছিল তখনো আমাকে সাথে নিয়ে দুলতে চাইত না। তবুও প্রকৃতির বেঁধে দেয়া নিয়ম তো আর অস্বীকার করা যায় না। বাতাসের সাথে ‘ওরা’ বাধ্য হয়ে আমার সাথেই দুলত। আমার সাথে অন্য পাতাদের ভালোবাসা নেই, কারণ, আমি ওদের মতো সুন্দর ছিলাম না।
সুন্দর হবোইবা কী করে? রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করা মানুষগুলো আমায় লাঠি দিয়ে শরীরে আঘাত করে। আমার সবুজ গা-টা ছিঁড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কিছু দিন পর আবার ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু শেষবার যখন মানুষজন আমাকে একটু বেশিই আঘাত করতে লাগল ঠিক তখনি আমার গায়ের ক্ষতবিক্ষত দাগগুলো রয়ে গেল। আর কখনো ঠিক হয়ে ওঠেনি। পুরো পাতাজুড়ে শুধু ক্ষতবিক্ষত হওয়া এক ঝড়ে পড়া পাতা আমি। আমার গায়ের রঙটা এখন আর সবুজ নেই। ক্ষত-বিক্ষত এক দুঃখভরা পাতা। আজ তাদের ছেড়ে চলে এসেছি আপনার হাত বরাবর। দয়া করে আমাকে ছুড়ে মারবেন না। একটু জায়গা করে দেন না! আমি আপনার হাতে শুয়ে থাকি। সারাজীবন তো অন্য ‘পাতার’ কলে ঘুমাতে পারিনি। আপনার কাছে-ই না হয় শেষ ঘুম ঘুমাই। শেষ-ই তো হয়ে গেল আমার জীবন। আর আমাকে কেউ আঘাত করতে পারবে না। পারবে না আর কেউ আমাকে দেখে হিংসা করতে। ‘ওদের’ ইচ্ছানুযায়ী বাতাসে হেলেদুলে সুখের ভালোবাসা এক-ওপরের প্রতি ভাগবাটোয়ারি করবে। করুক, কষ্ট নেই।’
একটি ঝড়ে যাওয়া পাতার কী স্বপ্ন নেই? তার কী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই? তার কী একটু ইচ্ছে হয় না সব পাতাদের সাথে বাতাসে দুলতে? মনে রাখবেন, সবুজ পাতাটিরও প্রাণ আছে, সহানুভূতি আছে; আছে তার জীবনের মূল্য। আমরা মানুষ বড় বেখবর তাদের (পাতা) জীবনের ভাবনা নিয়ে। আসলেই বেখবর।