Naya Diganta

অবস্থা ‘না ঘরকা না ঘাটকা’

দেশে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা রাজনীতি, অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া, নিয়ন্ত্রণহীন বিশৃঙ্খল বাজার-ব্যবস্থাপনা, জীবনধারণে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর আকাশছোঁয়া দাম, প্রখর রোদে ক্লান্ত মানুষের টিসিবির পণ্য কেনার লাইন, আসন্ন রমজানে নীতিহীন ব্যবসায়ীদের অধিক লাভ করা আনন্দ আহ্লাদে ফুরফুরে হয়ে ওঠা, ওমিক্রনের নতুন ত্রাস, সড়কে বেশুমার প্রাণহানি, ইউক্রেন সঙ্কট; সব মিলিয়ে সর্বত্র এক হাহাকার অবস্থা। এমন সময়ে কোথায় কোন অরণ্যে মানুষ আশ্রয় নেবে। দেশের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কর্তৃপক্ষের ‘ইনঅ্যাবিলিটি’ এতটা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে যে, কাউকে আর বলে বোঝাতে হবে না। বিদ্যমান অবস্থা সামলানোর কোথাও কোনো সক্ষমতার প্রমাণ নেই। উপরে যা উল্লেখ করা হলো তাতে রঙচঙ লাগানো হয়নি। রাজধানীর বাসিন্দারা শুধু নন, সারা দেশের মানুষের একই উপলব্ধি। পেশাদার সাংবাদিক জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ আকাক্সক্ষা নেই। মানুষের করুণ অবস্থা নিয়ে কথামালার রাজনীতি করার নিম্ন রুচি কোনো সৎ সাংবাদিকের থাকতে পারে না।

ভাবা হয়েছিল, দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নির্বাহী অভিজ্ঞতার দক্ষতা এখন পরিপূর্ণ। তাদের মাঝে সক্ষমতার স্ফুরণ ঘটবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সুশীলসমাজ তো বটেই সাধারণের মধ্যে এ ধারণা প্রোথিত হয়েছে যে, তাদের ওপর আস্থা বিশ্বাস ভেঙে পড়ার উপক্রম। এ ধারণার সাথে যোগ হয়েছে, ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন এবং পারফেক্ট ম্যান ইন পারফেক্ট প্লেস’-এর অসামঞ্জস্য। সব জায়গায় যাদের বসানো হয়েছে সেটা সঠিক হয়নি। সক্ষম ও বিজ্ঞজনদের অনেক গুণাবলীর মধ্যে দূরদৃষ্টি ও আগাম চিন্তা থাকে। তাদের কাছে কাজের ক্ষেত্রে আত্মতুষ্টি ও বাগাড়ম্বর, কথার কচকচানি থাকে না। এখন তো মনে হয়, ‘এমটি ভেসেল সাউন্ড মাচ’। তাই দেখা যাচ্ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক নির্বাহীকে নিয়তই বহু ক্ষেত্রে তার অধীনস্থ রাজনৈতিক নির্বাহীদের দায়িত্ব পালনের বিষয়গুলো নিয়ে নির্দেশনা দিতে হচ্ছে। এর সরল ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বীয় কর্মক্ষেত্রে সক্ষমতার ‘রেসে’ হোঁচট খাচ্ছেন বা পিছিয়ে পড়ছেন। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এসব রাজনৈতিক নির্বাহী কিন্তু জনগণের কাছে যোগ্যতার ‘মানদণ্ডে’ উত্তীর্ণ হয়ে এ পর্যায়ে পৌঁছেননি। অর্থাৎ তারা জনগণের বাছাই করা জনপ্রতিনিধি নন। স্মরণ রাখতে হবে জনগণের পছন্দমতো যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করে দেয়ার এখন কোনো সুযোগ নেই। গলদ এখানেই। যে নির্বাচনী শৈলী এখন চালু সেটি সবার জানা। এ নিয়ে কথা বলার অর্থ হচ্ছে ‘চর্বিতচর্বণ’। যা নিয়ে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আলোচনা করব, উপরে দু’চার ছত্রে তা সন্নিবেশিত রয়েছে।

এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক নির্বাহীদের দায়িত্ব পালনে ভুল নীতির অনুসরণ, কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে অদক্ষতার কারণে জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। এর প্রতিবাদে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এখন সরব হচ্ছে। সারা দেশে বিক্ষোভের আয়োজন করছেন। এসব দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থরা লাঠিসোটাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের প্রতি মারমুখী হয়ে রাজপথে উত্তাপ সৃষ্টি করছেন। এসব সবে শুরু। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে ১২তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সময় যতই ঘনিয়ে আসবে, রাজপথ ততই উত্তাপ উত্তেজনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হবে। এসব কর্মীর তখন মারমুখী আচরণ তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা শতভাগ। কেননা দলটি ধারাবাহিকভাবে এক যুগ ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকায় এসব কর্মী অনেক অন্যায় অসাধুতার সুযোগ নিয়ে এক যুগ পরমানন্দে সুখ ভোগ, ভালোমন্দ খেয়ে পরে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছেন। সাথে ক্ষমতার ন্যায়-অন্যায় চর্চা করে সমাজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। প্রভাব প্রতিপত্তির শেষ ছিল না। এমন স্বর্গসুখ দীর্ঘায়িত করতে তাদের মরিয়া হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে সংগঠন থেকে তাদের প্রতি অশীর্বাদ শুভেচ্ছা সমর্থনে এতটুকু কমতি হওয়ার কথা নয়। তাই পরিস্থিতি তখন কোথায় গিয়ে গড়াবে সহজেই অনুমেয়।

নির্বাচনের আগে এখনই একটা বড় প্রশ্ন সৃষ্টি হবে। নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। অভিজ্ঞতা বলছে, দেশে দলীয় সরকারের অধীনে গত দুটো সংসদ নির্বাচনসহ কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু, প্রশ্নমুক্ত এবং সবার অংশগ্রহণমূলক হয়নি। তাই রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে না বলে দাবি উঠেছে। কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাবও এসেছে। চারটি দলের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে মতামত পেশ করা হয়েছে। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বহু আগে থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে বলে আসছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক আ স ম রবের দল-জেএসডি পত্রিকায় যে মত দিয়েছে সেটি হলো, ‘জাতীয় সরকারের অধীনে’ নির্বাচন হওয়া উচিত। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অন্যতম সহযোগী এলডিপির মত, সুষ্ঠু নির্বাচনে দরকার জাতীয় সরকার গঠন করা। ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী জেএসডি এবং এলডিপির মতের পক্ষে। ঐক্যফ্রন্টের অপর শরিক নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না ভিন্নমত দিয়েছেন। তার মত, ‘অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করার মতো সরকার এখন প্রয়োজন।’ নিজেদের মধ্যে ভিন্নমত প্রসঙ্গে নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন তারা। তবে তারা এ-ও আশা করেন, ঠিক সময়ে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হবে। এক কথায় কেউ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন- এটা চান না।

সরকারের প্রতিপক্ষ দল যাই ভাবুক, বর্তমান সরকারি দল অবশ্যই আগামী নির্বাচনের একটি বড় পার্ট। সে কারণে তাদের নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ভাবনার গুরুত্ব কম নয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরাও শক্তিশালী পক্ষ সন্দেহ নেই। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং মতের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা যায় না। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কয়েক মাস পর উভয়পক্ষের দরকষাকষি রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল বিতণ্ডার সৃষ্টি করতে পারে। উভয়পক্ষের মতামতের মধ্য দিয়ে একটা পথ বের হবে খুব সহজ নয়। সরকার নিজের অধীনে জবরদস্তি নির্বাচন করিয়ে পার পেয়ে যাবে, এখন তেমন একতরফা কিছু করার পরিস্থিতি হয়তো আর নেই। সরকার একগুঁয়েমি করলে তার সব প্রতিপক্ষ যদি নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তবে নির্বাচন করিয়ে নেয়া কঠিন হবে। তেমন নির্বাচন যদি হয়ও তবে দেশে ও বিদেশে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হবে শুধু তা-ই নয়, বরং তার বৈধতা নিয়ে দেশের বাইরে থেকে ক্ষমতাসীনদের বড় ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হবে। ইতোমধ্যে এমন কিছু অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আলামত লক্ষ করা গেছে। যা কিনা সরকারকে শুধু বিব্রতই নয় সঙ্কটের সম্মুখীন করেছে। তা ছাড়া বিরোধী দলগুলো যদি একজোটে নির্বাচন বয়কট করে সে ক্ষেত্রে তাদের বিপুল সমর্থক গোষ্ঠীও যদি ভোটে অংশগ্রহণ না করে তবে একতরফা ভোট অর্থহীন ও প্রহসনে পর্যবসিত হবে।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাসীনরা একতরফা ভোট করে ‘বাজি মাৎ’ করবেন পরিস্থিতি এখন বোধ হয় সেই পর্যায়ে নেই। কেননা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও বোধ হয় বাইরে থেকে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে।

ভোটকালীন সময়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন গত দুই দফা ‘নতজানু’ ও ‘অনুরাগের’ বশবর্তী হয়ে যে ‘ঢেঁকি’ গিলেছেন এবার নবগঠিত নির্বাচন কমিশন সে অবস্থায় নিজেদের নিয়ে যাবেন কি না তা এখনই বলা যায় না। গত দুই কমিশন (হুদা-রকিব) যেভাবে নিন্দিত হয়েছেন বর্তমান কমিশন তাদের পূর্বসূরিদের ফেলে যাওয়া পাদুকা পায়ে তুলে সেই একই পথে হাঁটবেন তাও বলার সময় আসেনি। হুদা কমিশন যে আত্মম্ভরিতার পরিচয় দিয়ে আত্মপ্রসাদ অহমিকা প্রদর্শন করেছেন তা এই নতুন কমিশন করবেন এবং ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিজেদের স্থান করে নেবেন এমনটা এখনই কেউই ভাবতে পারছেন না। এই কমিশনের সিইসিসহ তিনজন আইনের চত্বরে স্বচ্ছন্দে পদচারণা করেছেন। নিশ্চয়ই তারা বিশ্বাস করেন, আইন মানুষের কল্যাণ চিন্তারই ফসল। সংবিধান, নির্বাচনী আইনের সংরক্ষক হিসাবেই তারা দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই আশা। আর আইন তো নৈর্ব্যক্তিক, সেখানে অনুরাগ বিরাগের কোনো স্থান নেই। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে পথ চলার ক্ষমতা দিয়েছে। বিগত দুই কমিশন সেটি অনুশীলন করেনি বটে। নতুন কমিশনকে ততটা ‘নতজানু’ ভাবা এই মুহূর্তে ঠিক হবে না বলে সুধীসমাজ অনুভব করেন। ইসি কিভাবে কোন পথে চলবে সেটি বোধকরি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও মনিটর করা হতে পারে। আগামী নির্বাচনের ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা অবশ্যই করবে, তবে অতীতের মতো কমিশনকে পকেটস্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠবেন না বোধ করি। তারা ভিন্ন কৌশল নিয়ে এগোতে পারেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এখন যে বাতাস বহমান ক্ষমতাসীনরা সেটি লক্ষ রাখছেন বলে মনে হয়।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর বিশ্বে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হবার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে। দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার পুরোটাই আমদানি করে পূরণ করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। ফলে গোটা অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে কোভিডের কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে সেটি এখনো সামলানো যায়নি।

ইদানীং দানাদার খাদ্যশস্যের মূল্য, ভোজ্যতেলের দাম, শাকসবজি, পেঁয়াজসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন ওষ্ঠাগত। মানুষ এখন পণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে দিশাহারা হয়ে ছুটছে। দেশের বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাপনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। বাজারে সব ধরনের পণ্যের ঘাটতি আছে এমন নয়। সব পণ্যই তো থরেবিথরে সাজানো। তবে সব কিছুর মূল্য আকাশছোঁয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এসব দেখার কোনো কর্তৃপক্ষ আছে বলে মনে হয় না। বাজারে মানুষ পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এখন এতটা কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন করছেন, তাতে তো মনে হয় মানুষ তার চাহিদার এক-চতুর্থাংশ কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত হারিয়ে ফেলতে চলেছেন। এর পরিণতি নিয়ে ভাবলে সম্মুখে এক ভয়াবহ চিত্র ভেসে ওঠে। দেশে এমন মূল্যবৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে মারাত্মক অনৈতিক বাণিজ্য, যার একমাত্র লক্ষ্য মানুষকে যত পার শুষে খাও, এমন মানসিকতা। মজুদদারি মুনাফার মধ্যস্বত্বভোগীদের লাগামহীন দৌরাত্ম্য চলছে। এসব নিয়ে বিচারের বাণী নিভৃতে রোদন করছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সামনে দুঃসহ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে। পবিত্র রমজান এসে পড়েছে। আমাদের একশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের নীতিনৈতিকতার বিষয় প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে রমজানে পরিস্থিতির অধোগতি চূড়ান্ত হবে। বরাবরের অভিজ্ঞতা এমনই। তখন তো মধ্যবিত্তদের পক্ষেই কোনো পণ্যের গা স্পর্শ করার সামর্থ্য থাকবে না। নিম্নবিত্তের কী হাল তা তো কল্পনা করাই যায় না। রমজানে রোজাদার মানুষ কী দিয়ে ইফতার, সাহরি সারবে তা কে বলবে। বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশে ব্যবসায়ীরা রমজানে রোজাদারদের খেদমতের উদ্দেশ্যে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আমাদের দেশে উল্টো।

হেন দিন নেই যে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের খবর পত্রপত্রিকায় থাকে না। বিষয়টি সবার গা সইয়ে নেয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন প্রতিযোগিতা চলছে। সড়কে দুর্ঘটনার পর যথারীতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সংশ্লিষ্ট গাড়ির চালককে খুঁজে বের করে আদালতে তুলবে। আমরা আমজনতা এতটুকুই জানি কিন্তু তার পরের যে অধ্যায়, তার আর আদ্যোপান্ত কিছুই জানা নেই। কখনো কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘটনার ভিতরে ঢুকে এর প্রতিকারের জন্য বাস্তবতার আলোকে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করেছেন! অন্যান্য দেশে যেখানে যানবাহনের সংখ্যা আমাদের দেশ থেকে বেশি, কিন্তু দুর্ঘটনার হার একেবারে ‘মাইক্রোস্কপিক’ এর হেতু কী? তা কি জানার চেষ্টা করেছেন। কারা কিভাবে লাইসেন্স নিচ্ছেন, ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন, হালকা যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নিয়ে ভারী যান চালাচ্ছেন, বিনা লাইসেন্সে কতজন গাড়ি চালাচ্ছেন, যানবাহনের ফিটনেস আছে কি না সে খবরইবা কে রাখে। সড়ক দুর্ঘটনায় এমন খবর অহরই পাওয়া যায় যে, দুর্ঘটনায় একই পরিবারে চার-পাঁচজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। প্রতিদিনের এমন হৃদয় বিদারক খবর তো মানুষের মনোরোগের কারণ হতে পারে। আর যে পরিবার তাদের স্বজনদের হারায়, জীবনভর দুঃসহ স্মৃতি তারা বহন করে চলেন। এর কি কোনো প্রতিকার হয়েছে? কিছু কিছু ঘটনায় আহত ভিকটিম উচ্চ আদালতে মামলা রুজু করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বাবদ সামান্য কিছু অর্থ আদায় হয়। কিন্তু যেসব পরিবার তাদের প্রধান ব্যক্তিকে বা একাধিক সদস্যকে হারায় সে ক্ষতি কিভাবে পূরণ হবে?

এখন ভূ-রাজনীতিতে ইউক্রেন পরিস্থিতি জটিল পর্যায়ে। পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া এবং তার মিত্রদের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তির সপক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। প্রায় দু’শত ছোট বড় দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতসহ কয়েকটি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। আর রুশ বলয়ের দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। কয়েকটি দেশের ইতিবাচক ভূমিকা অবাক হবার মতো, যেমন কিছু দিন পূর্বে চীনা প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, চীন-রুশ সম্পর্ক কঠিন শিলার মতো মজবুত। সেই চীন পশ্চিমা বিশ্বের আনীত প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেয়নি। আর ভারতবেষ্টিত ক্ষুদ্র দেশ ভুটান কিন্তু পশ্চিমের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে, অনুরূপ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপও প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। বস্তুত ইউক্রেনের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবাধিকারের পক্ষে এবং রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হয়েছিল সে ভোট। বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থেকে ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে।

বাংলাদেশের এই অবস্থান গ্রহণ এমনকি দেশের সংবিধানের পরিপন্থী। আমাদের সংবিধানের ২৫(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন;’

সরকারের এই অবস্থান গ্রহণ করার পেছনে জনগণের কিছু মাত্র সায় নেই। দেশে গণমাধ্যমে প্রতিদিন এমন সব খবর ও ছবি প্রকাশিত হচ্ছে, যা ইউক্রেনবাসীর দুঃখ-কষ্ট দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে। আর দৈনিকের উপসম্পাদকীয়গুলোতে নিত্য এমন সব নিবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে, যা রুশদের আগ্রাসনবিরোধী।

এই যুদ্ধে মুসলিম দেশ তুরস্কের ‘অনবদ্য, ম্যাচিওরড’ নীতির প্রশংসা না করে পারা যায় না। রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ বেশি। তারা এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে, আবার ‘রুশ-ইউক্রেন’-এর মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের জন্য তুরস্ক নিজ ভূমিতে দুই দেশের মধ্যে সঙ্কট নিষ্পত্তির আলোচনা বৈঠকের আয়োজন করেছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি কতটা পরিপক্ব এবং ভারসাম্যপূর্ণ।

আসলে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সুশাসন, যে শাসনব্যবস্থার সাথে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাকাপোক্ত সম্পৃক্ততা থাকলে রাষ্ট্র ও সরকারের শিরদাঁড়া মজবুত হয়। সে অবস্থায় যেমন সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা পরিলক্ষিত হয়, তেমনই তার বৈদেশিক নীতির পরিপক্বতা আসে, তথা রাষ্ট্রের সার্বিক স্বার্থ সংরক্ষিত হয়, কাউকে কুর্নিশ না করে পথ চলার শক্তি জোগায়।

ফিরে যাওয়া যাক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। যে পরিস্থিতি দেশে এখন বিরাজ করছে তাতে উদ্বেগ নৈরাশ্য ও হতাশা নিয়ে জনগণ জীবনযাপন করছে, তাতে তাদের সব কিছু অর্থহীন করে ফেলেছে, দেহ মনের স্বস্তি শান্তির অনুভূতি হারিয়ে গেছে। সবচেয়ে অবাক হতে হচ্ছে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য বিবৃতি মানুষকে কেবল বিস্মিতই করছে না তাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে সেসব কথা পরিহাসতুল্য বলে মনে হয়। বলা হচ্ছে, জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেই সাথে নাকি তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। সে জন্য পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে না। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আগে বলে আসা কথার জের টেনে বলতে চাই- ক্রয়ক্ষমতা সত্যিই যদি বাড়ত তবে মহানগরজুড়ে টিসিবির পণ্যের জন্য হাজার মানুষের এত দীর্ঘ সারি কেন? কেন-সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের শোনা মুখ থেকে শুনছি টিসিবি’কে আরো শক্তিশালী করা হবে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে তারা নিজেদের হাস্যস্পদ করে তুলছেন। কপটতা পরিহার করে, অন্তরে মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে স্থান করে দিলে, মানবিকতা লালন করলে সব কিছু জয় করা সম্ভব হয়, কিন্তু সে পরিচর্যা তো দেখছি না।

দেশে প্রশাসনের দায়িত্বশীলতা তো অদৃশ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবেচনায় দায়িত্বশীলতা বলতে ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রশাসন কর্তৃক অন্য একটি ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে জবাবদিহিকে বোঝায়। এই জবাবদিহি হতে পারে আইনের কাছে আবার হতে পারে রাজনৈতিকভাবেও। রাজনৈতিক বলতে সরল কথা এটাই যে, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জনগণ প্রতিনিধিদের কাছে। কিন্তু এই দুটোর কোনোটাই এখন কার্যকর নেই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজারব্যবস্থার অরাজকতা দূর করা ছাড়াও অনেক কিছুর সুরাহা করতে আইনে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু সেখানে সব ঠনঠনে অবস্থা। এভাবেই আইনের প্রতি আনুগত্য এখন অর্থহীন। রাজনৈতিক দিকটা হচ্ছে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি নিয়ে গঠিত সংসদের কাছে। এখন যে সংসদ, তার যে চরিত্র সেটি প্রশ্নবিদ্ধ, সেটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। তাই সেখানে জবাবদিহির হাল কী হতে পারে তা সবারই জানা। তাই প্রশাসনের দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে যে ব্যত্যয় হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার তেমন কিছু থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।’ অর্থাৎ সরকারের রাজনৈতিক কার্যক্রমের কারণে যদি মন্ত্রিসভা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারান তাহলে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য থাকিবে; যা সকল স্থানে তথা যেখানে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে সেখানে এটাই অনুসৃত হয়। কিন্তু আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থা সেরূপ নয়।

আমাদের সংবিধানের ৭০ অনু”চ্ছদে বর্ণিত আছে ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ সে কারণে ৫৫(৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘মন্ত্রিসভার যৌথ দায়িত্ব’ প্রকৃতপক্ষে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি হয়ে আছে।

যেকোনো সরকার কোনোক্রমে একবার ক্ষমতাসীন হলে, তার অদক্ষতা এবং শত অপকর্ম করলেও তাকে আর একটি নির্বাচন ছাড়া এখন দেশের বর্তমান সংসদের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে কখনো অনাস্থা প্রস্তাব বিরোধী দলের পক্ষে উত্থাপন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এখন নির্বাচনের যে হাল সে ক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীন দলকে ভোটের মাধ্যমে সরানো প্রায় অসম্ভব।

ndigantababor@gmail.com