গারো পাহাড়ে পর্যটনের অপার সম্ভাবনায় নানাবিধ সমস্যা
- মো: রফিকুল্লাহ চৌধুরী মানিক, হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ)
- ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:১৭
সীমান্তের ওপারে মেঘালয় রাজ্যের উঁচু নীল তুরক পাহাড়। পাখিদের সাথে উড়ে আসে সাদা সাদা মেঘ। মেঘগুলো পাহাড়ে ঝর্ণা হয়ে ঝরে। এপারে ছোট-বড় পাহাড়ের গাছে ছুটে কাঠবিড়ালি, বানর। আরো কত অপরূপ দৃশ্য।
গল্প মনে হলেও এমনি সব দৃশ্যই চোখে পড়ে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার গাবরাখালী গারো পাহাড় পর্যটনকেন্দ্রে। গারো পাহাড়ের চূঁড়ায় দাঁড়িয়ে দেখা যায়, সীমান্তে ওপারে মেঘালয় রাজ্যের মানুষের জীবন ও জীবিকার দৃশ্য।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হালুয়াঘাট পৌরশহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেষা গাবরাখালী পাহাড়। ১২ কিলোমিটারের এক কিলোমিটার ইটের তৈরি ভাঙাচোরা সড়ক। প্রায় পাঁচফুট প্রশস্ত সড়ক দিয়ে ভ্যানে অথবা অটোরিকশায় চড়ে যেতে হয় ওই পর্যটনকেন্দ্রে। বাস কিংবা অন্য বড় যানবাহন নিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
জানা যায়, গাবরাখালীতে একসময় হাজং ও বানাই জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। সীমান্তঘেঁষা এই গ্রামের উত্তর প্রান্তে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমানা। ১২৫ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছোট-বড় ১৬৭টি টিলা রয়েছে। কোনোটি প্রায় ৭০ ফুট, আবার কোনোটি ২০০ ফুট উঁচু।
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৯ সালের শেষের দিকে গাবরাখালীতে পর্যটনকেন্দ্র করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে কাজ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত এই পর্যটনকেন্দ্রে রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধান হলে হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার লাখ লাখ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এটি অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
পর্যটকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে এটি উপযুক্ত জায়গা। তবে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্রে। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে । যে কারণে কারোর সাথে যোগাযোগ করা যায় না। ছোট ছোট টঙ দোকান থাকলেও নেই ভালো মানের খাবারের দোকান। বিশুদ্ধ পানিরও সঙ্কট। বোতলের পানি পর্যটকদের ভরসা। পর্যটনকেন্দ্রের পাশে একটি কুয়া রয়েছে। কুয়ার পানি ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটক টানতে হলে ওয়াইফাই, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা, আবাসিক ব্যবস্থা, ভালো মানের খাবার এবং জীবন রক্ষাকারী বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আগে করা প্রয়োজন।
পর্যটনকেন্দ্রকে আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রবেশ মুখেই রয়েছে সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলের মনোরম ঝর্ণাধারা। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া লেকে ঝুলন্ত ব্রিজ, লেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য প্যাডেল বোটের ব্যবস্থা। পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য গারো ভাষায় জারামবং (পূর্ণিমা) ও ফ্রিংতাল (শুকতারা) নামে দুটি বিশ্রামাগার। এছাড়াও আছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে এই কেন্দ্র।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই পর্যটন কেন্দ্র দেখতে আসা আঞ্জাম আশরাফী অনন্ত। তিনি বলেন, ‘আসার সময় যে রাস্তাটা দিয়ে এসেছি, সেটার অবস্থা একেবারেই বেহাল। এই রাস্তা দিয়ে বড় কোনো গাড়ি আসাটা অসম্ভব। এখানে ঢোকার পর থেকে মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই, তাই কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। তাছাড়া, এখানে ভালো মানের খাবারের হোটেল নেই।’ এই সমস্যাগুলো সমাধান হলে দর্শনার্থীদের টানতে পারে এই পর্যটনকেন্দ্রটি বরে মনে করছেন তিনি।
ধোবাউড়া গোয়াতলা থেকে স্বপরিবারে ঘুরতে এসেছেন মো: সাইদুল মিয়া। তিনি বলেন, এখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। পাহাড়ের উপরে দাঁড়ালে ভারতের ভেতরের দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু এখানে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, ছেলে মেয়েদের নিয়ে দুপুরে খাওয়া বা আবাসিক কোনো ব্যবস্থা নেই। এই সমস্যাগুলো সমাধান হলে পর্যটনে অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি ।
পর্যটনকেন্দ্রে মামা চটপটির দোকানদার সোহেল মিয়া বলেন, বেশ কিছু দিন আগেও অনেক পর্যটক আসত। এখন কিছুটা কম আসে। খাওয়ার পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। বোতলের পানি কিনে খেতে হয়। এছাড়া আরও বেশকিছু সমস্যা আছে। যে কারণে দর্শনার্থী খুব কম আসে।
স্থানীয় আরেক দর্শনাথী ইব্রাহিম বলেন, এখানে সবচাইতে বড় সমস্যা মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে না। যে কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাস্তার অবস্থা ভালো না। দেয়াল না থাকায় অনেক পর্যটক ভারতের সীমান্তে চলে যায়, সিকিরিউরিটিও কম।
পর্যটন কেন্দ্রের আরেক ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, এই পর্যটন কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিশুদ্ধ পানির। এখানে অনেকবার টিউবওয়েল স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, নলকূপ স্থাপনের সময় ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাথর পড়ে। যে কারণে নলকুপ স্থাপন করা যাচ্ছে না।
এখানের সবাই কূপের পানি পান করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পানি সমস্যার সমাধান হলে পর্যটক বাড়বে। সবার সুদিন ফিরবে।
গারো পাহাড় পর্যটন কেন্দ্রের সুপারভাইজার মো: নিজাম উদ্দিন বলেন, গাবরাখালী গারো পাহাড় পর্যটনকেন্দ্র নতুন সৃষ্টি। সাবেক জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এই পর্যটনকেন্দ্র চালু হয়। এটি দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। শুরুতে এখানে পাকা রাস্তা বলতে কিছুই ছিল না। ছিল কেবল পাঁচ ফুট প্রশস্ত কাঁচা রাস্তা। সম্প্রতি ইট দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে হালুয়াঘাট উপজেলা প্রশাসন এই পর্যটন কেন্দ্রের উন্নয়নের জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আকর্ষণীয় করে তুলতে চেষ্টা করা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য ১৪ জন স্টাফ সবসময় দেখাশোনা করেন। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্কের কিছুটা সমস্যা রয়েছে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। পর্যটকদের জন্য ওয়াইফাই ব্যবস্থা করার বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, পাহাড়ি অঞ্চল হলেও এখানে কোনো দিন অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। মাদকের আড্ডার কোনো প্রশ্রয় নেই এই পর্যটন কেন্দ্রে। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসন ও বিজিবি সদস্যরা টহল দেয়। এছাড়া কোনো দর্শনার্থী যেন সীমান্তে চলে না যায় এজন্য সীমান্ত এলাকায় সাইনবোর্ড দেয়া আছে। তাছাড়া মাইকিং করে দর্শনার্থীদের সতর্ক করা হয়।
তিনি আরো জানান, এরইমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রটি ঘিরে বিভিন্ন দোকান করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে প্রধান ফটক, সুইমিং পুল, ওয়াচ টাওয়ার, শিশুপার্ক, তথ্যকেন্দ্র, মিনি চিড়িয়াখানা ইত্যাদির কাজ চলমান রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা হাসান বলেন, তিনি গত ২৮ নভেম্বর যোগদান করেছেন। ওই পর্যটনকেন্দ্র সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে যেমন বিশুদ্ধ পানি, মোবাইলে নেটওয়ার্ক, যাতায়াতের রাস্তা, আবাসিক থাকার ব্যবস্থা এবং ভালো মানের খাবারের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে অচিরেই সমাধান করা হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা