১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

পূর্ণিমাতে ভাইসা গেছে নীল দরিয়া...

অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী এন্ড্রু কিশোর - ফাইল ছবি

সময় ফুরিয়ে গেলে পৃথিবী আর কাউকে আলিঙ্গণ করে রাখে না। নিষ্ঠুরভাবে বলে দেয়, বিদায়। গানের সুরে এই উপলব্দিটাই আরো সহজ করে দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। তার গান শোনেননি, বাংলাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এক জীবনে তিনি যতগুলো শ্রোতাপ্রিয়, কালজয়ী গান গেয়েছেন, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে তো তিনি অদ্বিতীয়।

তার কালজয়ী একটি গানের কথা, ‘পূর্ণিমাতে ভাইসা গেছে নীল দরিয়া/ সোনার পিনিশ বানাইছিলা যতন করিয়া/ চেলচেলাইয়া চলে পিনিশ, ডুইবা গেলেই ভুস।’

গানের কথার মতো তার জীবনটাও ভুস হয়ে গেছে। ৬ জুলাই সন্ধ্যায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লম্বা সময় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন দেশের এই প্লে-ব্যাক সম্রাট। এপ্রিল মাসে কেমো ও রেডিওথেরাপি শেষ হওয়ার পর সুস্থ হওয়ার আশা জেগে ছিল। দেশে ফেরার জন্য টিকেটও কাটা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন শিল্পীর পরিবার। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর দুর্বল শরীর নিয়ে বিমানে উঠতে রাজি ছিলেন না। চেয়েছিলেন আরো কিছুদিন সেখানে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দেশের পথে রওনা দিতে। সেই ইচ্ছে অনুযায়ী আবার হাসপাতলে গিয়ে জানতে পারলেন, জীবন বিদায়ের ঘণ্টা অতি নিকটে। কেমো দেয়ার পর যে ক্যান্সার নির্মূলের জন্য দিন গুণ ছিলেন, সেটাই ফিরে এসেছে দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে।

এন্ড্রু কিশোর যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন তার নাম ‘লিম্ফোমা’। চিকিৎসকরা শুরুতেই বলেছিলেন ‘লিম্ফোমা’ যদি একবারে নির্মূল না হয়, পুনরায় ফিরে আসে, তাহলে সেটা ‘দ্বিগুণ শক্তিশালী’ হয় আর খুব দ্রুত ছড়ায়। সেটা আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

‘লিম্ফোমা’ দ্বিতীয়বার ফিরে আসার খবরে স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলেন শিল্পীর স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু ইতি। তিনি বলেছেন, ডাক্তার আমাকে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে নিয়ে গেলেন এবং দেখালেন। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে কিছু নাই। কিন্তু ‘লিম্ফোমা’ ভাইরাস ডান দিকের লিভার এবং স্পাইনালে ছড়িয়ে গেছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প আছে। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। চোখের পানি ঠেকাতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে চিকিৎসককে বললাম, হোয়াট নেক্সট (পরবর্তী ধাপ কী)? তিনি বললেন, আই এম সরি (আমি দুঃখিত), আমার আর কিছুই করার নেই।

এই কঠিন সত্যটি জানার পর এন্ড্রু কিশোর চিকিৎসকে বললেন, আমাকে রিলিজ দেন। আমি দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কাল দেশে ফিরব। এরপর কাগজপত্র ঠিক করে ১১ জুন বিকেলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আনা হয় শিল্পীকে। ঢাকা থেকে চলে যান জন্মভূমি রাজশাহীতে। নিজ শহরের মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। সেখানেই শেষ হয় তার জীবনের গল্প, পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন সঙ্গীত জগতের এই কিংবদন্তী।

এন্ড্রু কিশোরের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর। তার সঙ্গীত চর্চার শুরু হয় আব্দুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে। অসামান্য প্রতিভা থাকায় তিনি অল্প সময়েই সঙ্গীত সংশ্লিষ্টদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। সব ধরণের গানেই তার দক্ষতা ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, আধুনিক, লোক এবং দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভূক্ত শিল্পী ছিলেন।

চলচ্চিত্রের গানে এন্ড্রু কিশোরের অভিষেক হয় ১৯৭৭ সালের ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমা দিয়ে। এতে আলম খানের সুরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ শীর্ষক একটি গান গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এরপর তিনি বাদল রহমান পরিচালিত ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ সিনেমায় ‘ধুম ধাড়াক্কা’ শিরোনামের গানে কণ্ঠ দেন।

তবে এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয়তা আসে ১৯৭৯ সালে। সে বছর এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘প্রতীজ্ঞা’ সিনেমায় তার কণ্ঠে ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি শ্রোতাদের মন জয় করে নেয়। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বৃষ্টিধারার মতো গান করে গেছেন এই শিল্পী।

তার গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙের ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি বন্ধু আমার চিরসুখে থাকো’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘ও সাথী রে যেও না কখনো দূরে’, ‘কী যাদু করেছো বলোনা’, ‘প্রতিদিন ভোর হয়’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘এতো প্রেম ছিল’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না’, ‘আকাশেতে লক্ষ তারা’, ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ’সহ অসংখ্য গান।

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এন্ড্রু কিশোর জিতেছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে আটবার শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পাঁচবার বাচসাস পুরস্কার ও দুইবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অন্যতম।

পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মে এন্ড্রু কিশোর চলে গেছেন। কিন্তু এক জীবনে তিনি যা দিয়ে গেছেন, সেটা দেশের সঙ্গীতকে যেমন করেছে সমৃদ্ধ, তেমনি তাকে করেছে অমর। চলে গিয়েও এন্ড্রু কিশোর থেকে যাবেন প্রতিটি বাঙালির মনে। তুমুল প্রেম, বুক ভাঙা বিরহ কিংবা দেশাত্মবোধের অনুভবে মানুষ ঠিকই খুঁজে নেবেন এন্ড্রু কিশোরের গানগুলো। আর এভাবে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। পূর্ণিমার আলো হয়ে সুরের মায়া ডোরে বেধে রাখবেন শ্রোতাদের।


আরো সংবাদ



premium cement