১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যাংকে বিনিয়োগে অনাগ্রহ

-

কোনো কোম্পানির ওপর যখন বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারী যখন বুঝতে পারেন, সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে তার বিনিয়োগ তুলতে পারবেন না, তখন ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেন না। এতে ওই কোম্পানির মূল্য কমে যায়। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপদ করতে মৌলভিত্তি শেয়ারের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি ক্রেতা আকৃষ্ট করতে অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগমুখী করতে একটি কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ার বিকল্প নেই।
দেশের পুঁজিবাজারে খাতভিত্তিক শেয়ারের লেনদেনের অবস্থা আলোকপাত করলে দেখা যায়, অনেকটা দুরবস্থায় পড়েছে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। আগে যেখানে মোট বাজার মূলধনের ৪০ শতাংশের ওপরে দখলে ছিল এ খাতের, এখন সেটা কমতে কমতে ২০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। শুধু তাই নয়, অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে ৮ ব্যাংকের শেয়ার। ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থার জন্য এ খাতের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব দেখা দেয়াই অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্যাংকে বিনিয়োগে কেন অনাগ্রহ : গত কয়েক বছর যাবত ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়ম ও লুটপাটের খবরে বিনিয়োগকারীদের আস্থার মুখে ফেলে দিয়েছে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক, এনন টেক্স, ক্রিসেন্টের মতো বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা যখন বিনিয়োগকারীরা জানতে পারেন, পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ঘটনা যখন ঘটে, খেলাপি ঋণ যখন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, তখন শঙ্কিত হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগ করে মূলধন হারানোর আতঙ্ক থেকে এ খাতের ওপর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যাংকের শেয়ার মূল্যের ওপর। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য যখন ১০ টাকা, সেখানে ৮টি ব্যাংকের শেয়ার মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমে গেছে।
ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার জন্য নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ঘন ঘন নীতিমালা শিথিল করা। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে প্রায় ১৫ হাজার ঋণ নবায়ন করা হয়। এর বাইরেও ওই সময়ে অনেক ব্যাংকেরই ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। এতে রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমে গেলেও আবার ঋণখেলাপিরা এ সুযোগ নিয়ে নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। কিন্তু নবায়ন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা নতুন করে খেলাপি হয়। এভাবেই গত কয়েক বছর যাবত ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেযায় ঋণপরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেক ভালো ঋণগ্রহীতা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের শুরুতেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। এতে সুদের হারেও ছাড় দেয়া হয়। এ সুবিধার আওতায় দীর্ঘ ১০ বছর মেয়াদি ঋণ নবায়নের সুযোগ নিতে ঋণ পরিশোধ অনেকাংশেই বন্ধ করে দেন বড় বড় ঋণগ্রহীতা। এর পরেও গত সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকায়। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রাতহবিল আইএমএফের হিসাবে তা প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংকের নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। ব্যাংকাররা মনে করেন, সামনে এ আয়ের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর আয় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর।
ব্যাংক খাতের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়া। গত কয়েক বছর যাবত ব্যাংকিং খাতে যে দুর্নীতি, ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, আর এসব সংবাদ শুনতে শুনতে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। হলমার্ক ঘটনার দাগ মুছতে না মুছতেই বিসমিল্লাহর ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে। এর কিছু দিন পড়েই বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে। বেসিক ব্যাংকের রেশ কাটতে না কাটতেই এননটেক্স, ক্রিসেন্ট লেদারের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়। এর বাইরে প্রতিনিয়তই ব্যাংকের কোনো না কোনো ঘটনা বিনিয়োগকারীরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না কিছু কিছু ব্যাংক। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছেন না। এসব কারণে গত কয়েক বছর যাবত, অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এ কারণেই গত কয়েক বছর যাবত ব্যাংক কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী লভ্যাংশ দিতে পারছে না। বেশির ভাগ ব্যাংকের এমন অবস্থার কারণে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ব্যাংক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে। এতেই সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের ওপর।
এ দিকে আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা। বাড়তি মুনাফার আসায় কষ্টার্জিত অর্থ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ হওয়ার আশঙ্কা করছে ব্যাংকগুলো। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সামনে অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলোর আমানত আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আগামী ১ এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ ঋণের হার কার্যকর করতে গত ১ ফ্রেব্রুয়ারি থেকেই আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে ব্যাংকগুলো। আমানতের অভিন্ন এ সুদহার কার্যকর হওয়ায় ব্যাংকগুলো থেকে অনেকেই আমানত তুলে নেয়ার তাগিদ দিচ্ছে। ব্যাংকাররা জানান, আমানতের অভিন্ন সুদহার অর্থাৎ ৬ শতাংশ কার্যকর হওয়ার পর অনেকেই ব্যাংকের শাখায় এসে খোঁজখবর নিচ্ছেন। কেউ কেউ আমানত প্রত্যাহার করতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাদেরকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে ব্যাংকেই যান না কেন, সব ব্যাংকেই একই অবস্থা। তবে, তাদেরকে এরকম সান্ত্বনা দিয়ে বেশি দিন রাখা যাবে না। আশঙ্কার বিষয় হলো, আমানতপ্রবাহ তো এমনিতেই কমে আসছে, এরওপর ৬ শতাংশ কার্যকর হওয়ার পর আমানতপ্রবাহ আরও কমে যেতে পারে। অপর দিকে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে বেশি সুদের আশায় বুঝে না বুঝে নানা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করলে আমানতকারীদের কষ্টার্জিত পুরো অর্থই ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এর সরাসরি প্রভাব আমানতকারীসহ ব্যাংকের ওপর পড়বে বলে মনে করছেন ওই কর্মকর্তা। কারণ এতে আমানতকারীই অর্থ খোয়াবে না, ব্যাংকের আমানতপ্রবাহ কমে গেলে ঋণ দেয়ার মতো অর্থ ব্যাংকের হাতে থাকবে না। এতে বছর শেষে ব্যাংকগুলোর নিশ্চিত মুনাফা কমে যাবে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোর বাজার মূলধন ধরে রাখতে পারবে না বলে তিনি আশঙ্কা করেন। এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংক কোম্পানিগুলোর সার্বিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করেই সব ব্যাংকের জন্যই অভিন্ন পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা করা হয়। আর এ ৪০০ কোটি টাকার মূলধন করতে গিয়ে দুর্বল ব্যাংক কোম্পানিগুলো শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ও ইকুইটি ধরে রাখতে পারছে না। তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পরিশোধিত মূলধনের পরিবর্তে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মূলধন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুপারভিশন ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তা হলে বর্তমান অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement