২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুনাফায় বিকল্প নির্ভরতা

-

নানা কারণে দেশে প্রকৃত বিনিয়েগে স্থবির হয়ে পড়ছে। কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় পুঁজিবাজারও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এক দিকে ঋণ আদায় কমে গেছে, অপর দিকে আমানতকারীদের টাকা খাটানোর ক্ষেত্র কমে গেছে। সবমিলিয়ে লোকসানের মুখে পড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক। তাই বছর শেষে মুনাফা বাড়িয়ে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং শুরু করে। অনেকে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের বাইরে এসে ক্রেডিট কার্ড, ভোক্তাঋণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণসীমা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ভোক্তাদের। কিন্তু এর পরেও বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারেনি।
ব্যাংকের কেন এ পরিস্থিতি জানতে কয়েকজন ব্যাংকারের সাথে আলাপকালে তারা জানান, দীর্ঘ দিন যাবৎই ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ শূন্যতা রয়েছে। চলমান পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের দিকে আসছেন না। নতুন কোনো শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ নেই। তারা উচ্চ ব্যয়ে আমানত সংগ্রহ করছেন। কিন্তু তা বিনিয়োগ করতে না পারায় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। এ দিকে ব্যবসাবাণিজ্যের মন্দার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা গত বছরের চেয়ে কমে গেছে।
এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, জামানতবিহীন ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে ব্যাংক খাতে। কেননা এমনিতেই জামানত নিয়েও ব্যাংকের বড় বড় ঋণের বিপরীতে আদায় হয় না। হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ধকল ব্যাংক খাতকে এখনো ভোগাচ্ছে। এর বাইরে জামানতবিহীন ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, যা ঝুঁকির পরিমাণ আরো বাড়ানো হচ্ছে এ খাতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, গ্যাস সঙ্কট দীর্ঘ দিন যাবৎ রয়েছে। এ সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না। ব্যাংকগুলো কোনো রকম চলমান প্রকল্পে বিনিয়োগ করে টিকে ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্কট বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ এক রকম শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। ব্যবসাবাণিজ্যের স্থবিরতার কারণে যারা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা ব্যাংকের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। এর ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অপর দিকে ব্যবসাবাণিজ্য স্থবিরতার কারণে উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো তা খাটাতে পারছে না।
এর বাইরে পুঁজিবাজারে দরপতন অব্যাহত রয়েছে। নানা পদক্ষেপেও উন্নতি হচ্ছে না পুঁজিবাজার। এর ফলে যেসব ব্যাংক ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়েছিল ও ব্যাংকের নিজস্ব বিনিয়োগ ছিল তা আজো সমন্বয় হয়নি। বরং যে মূল্যে ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনেছিল মূল্য পতন অব্যাহত থাকায় এখন তা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। অপর দিকে ব্যাংকিং খাতে বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন রাখতে হচ্ছে তুলনামূলক বেশি হারে।
সবমিলে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকগুলোর মুনাফা অব্যাহতভাবে কমছে। আর এ মুনাফা কমতে কমতে এখন অনেক ব্যাংকের নিট আয় শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। এ দিকে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাদি, বিভিন্ন সেবা বিল, অফিস ভাড়াসহ পরিচালন ব্যয় কমছে না, বরং দিন দিন বেড়ে চলছে। এ পরিস্থিতিতে চলতি বছর শেষে প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার হ্যাট্রিক হয়েছে অনেক ব্যাংকের। অর্থাৎ বিগত কয়েক বছরে বেশির ভাগ ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে গেছে। চলতি বছরেও কমে যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাছে ব্যাংকের ইমেজ সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
এর দিকে মুনাফা বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপিদের বিশেষ ছাড় দেয়া হলেও অনেক ব্যাংকই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। অনেকেই নিশ্চিত লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করতে নানা অপ্রচলিত ব্যাংকিং করেছে। আশ্রয় নেয়া হয়েছে আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে। বিনিয়োগ করছে ভোক্তাঋণ, ক্রেডিট কার্ডসহ জামানতবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে।
ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বেশি ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ শ্রেণী বিভাজন করা যাচ্ছে না। এর ফলে পরিদর্শন করতে গিয়ে নানা বিপত্তির মুখে পড়ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা। গ্রাহকদের সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণসীমা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকদের এক লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণসীমা দেয়া হচ্ছে। জামানতবিহিন ঋণ দেয়ার মাধ্যমে ঋণ ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলে নতুন করে ঝুঁকির মুখে ফেলছে ব্যাংকিং খাতকে।


আরো সংবাদ



premium cement