২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পরিবেশ দূষণ বাড়ছে তৈরি হচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি

-

পরিকল্পনার অভাবে দেশে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বায়ু, পানি, মাটি, কৃষি, শব্দ, নদী, খাদ্য, প্রকৃতি, পরিবেশসহ সবক্ষেত্রেই দূষণ এখন চরম রূপ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু, পানি, মাটি, সবক্ষেত্রেই দূষণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে নতুন কোনো বিষয় না হলেও পরিস্থিতি এখন সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে দূষণের বিষয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। দূষণের কারণে বিভিন্ন রোগ যেমন বাড়ছে তেমনি অনেক মানুষের মৃত্যুও হচ্ছে। যা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ এ সংস্থার বেধে দেয়া সীমার দশগুণের বেশি। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় বায়ুদূষণের মধ্যে কাটিয়ে দেয়, তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। সার্বিক দূষণের জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলো অনেকটাই দায়ী। এসব দূষণ রোধে শক্ত পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিকল্পনার অভাবেই এমনটি হচ্ছে বলে সংস্থাটি মনে করে।
অপর দিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকায় বায়ুদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ঢাকাকে ঘিরে বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষাসহ নদীগুলোর দূষণের মাত্রা বাড়ছে। এখন দেশের অন্য শহরগুলোর মানুষও দূষণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। কৃষিকাজে বিষাক্ত রাসায়নিক বা কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দূষণের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে খাদ্যে।
তাদের মতে, বাংলাদেশে বায়ু পানি কৃষিসহ সব ক্ষেত্রেই দূষণের যে পরিস্থিতি, সেখানে কোনো একটি ক্ষেত্রে দূষণের মাত্রা কম এ কথা বলার সুযোগ নেই। পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেলে সবার টনক নড়বে ঠিকই কিন্তু তখন কিছু করার থাকবে না।
পরিবেশ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দূষণের মাত্রা বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তিনি দূষণরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথাও তুলে ধরেন। বলেন, ট্যানারি কারখানাগুলো ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ইটের ভাটায় বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এভাবে পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের মতে, দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে মাটি, পানি, বাতাস সবই কিন্তু দূষিত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ আমরা যে ধরনের শিল্প গড়েছি, সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে দূষণ হচ্ছে। একই সাথে ইট ভাটার কারণেও দূষণ হচ্ছে। নদীগুলো দূষিত হচ্ছে শিল্প কারখানার বর্জ্য পড়ে। আমাদের খাদ্যে দূষণের প্রভাব খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। তাই এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলেও সেগুলো দূষণের প্রভাব মুক্ত করতে অনেক সময় লেগে যাবে।
বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, বায়ু এবং শব্দ দূষণের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। এতে করে মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার মতো রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।
সবুজ পরিবেশ আন্দোলনের সমাজসেবা সম্পাদক সফিউল আযম জানান, দেশে দূষণের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হবে না। বিশেষ করে দূষিত বায়ু মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। তিনি বলেন, দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে শ্বাসযন্ত্রের রোগ ছাড়াও ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্কে মারাত্মক রোগব্যাধি হচ্ছে। দূষণরোধে সরকারের উদ্যোগকে আরো ত্বরান্বিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বিশ^ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে পরিবেশগত দূষণ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতে, প্রতি বছর, শুধু ঢাকায়ই বিভিন্ন দূষণে এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। সারা দেশে শহরাঞ্চলে মারা যায় ৮০ হাজার মানুষ। এ ছাড়া বায়ু পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতি ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ২ দশমিক ৭ শতাংশ। শুধু বায়ুদূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় শিশুরা।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে রাজধানীসহ সারা দেশে দূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ঢাকা মহানগরীতে দূষণের প্রকোপ অনেক বেড়ে গেছে। হাজার হাজার ইটভাটায় ইট প্রস্তুত ও পোড়ানোর পাশাপাশি মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের কারণে দূষণ এখন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্রেনের ময়লা আবর্জনা রাস্তার দুইপাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে দূষণ বন্ধে জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement