১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া জাদুঘর থাকবে না মসজিদ হবে তা ঠিক হবে আদালতে

-

তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করা হবে কি না এ ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার সেদেশের এক আদালতের যে রায় দেয়ার কথা ছিল তা ১৫ দিনের জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। দেড় হাজার বছরের পুরনো ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া এক সময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা, পরে তা পরিণত হয় মসজিদে, তারও পর এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। এখন আবার এটাকে মসজিদে পরিণত করতে চাচ্ছে দেশটির সরকার এবং আদালত পক্ষে রায় দিলে তা হতে পারে। তবে মাত্র ১৭ মিনিটের শুনানির পর তুরস্কের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সংস্থা দ্য কাউন্সিল অব স্টেট বলেছে তারা ১৫ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি রুলিং দেবেন।
মসজিদ না জাদুঘর?
আয়া সোফিয়া নির্মিত হয়েছিল ষষ্ঠ শতাব্দীতে, তখনকার বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের নির্দেশে। প্রায় ১০০০ বছর ধরে এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা। পরে ১৪৫৩ সালে যখন ইস্তাম্বুল অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় তখন একে পরিণত করা হয় মসজিদে। ১৯৩০এর দশকে এটিকে পরিণত করা হয় এক জাদুঘরে। এটি এখন ইউনেস্কো-ঘোষিত একটি বিশ্ব-ঐতিহ্য স্থান।
তুরস্কের ইসলামপন্থীরা বহুকাল ধরেই এটিকে আবার মসজিদে পরিণত করতে চাইছিলেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীদলীয় এমপিরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ও গত বছর এক নির্বাচনী সভায় আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করার কথা বলেছিলেন। গত বছর এরদোগান এক নির্বাচনী সভায় এই পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান।
আয়া সোফিয়ার বিচিত্র ইতিহাস
বসফরাস প্রণালীর পশ্চিম পাড়ে ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় গম্বুজশোভিত এই বিশাল ঐতিহাসিক ভবনটি খুব সহজেই দর্শকদের নজর কাড়ে।
সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আদেশে এই আয়া সোফিয়া নির্মাণ শুরু হয়েছিল ৫৩২ সালে। ইস্তাম্বুল শহরের নাম তখন ছিল কনস্টান্টিনোপল, যা ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী যাকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যও বলা হয়। এই সুবিশাল ক্যাথিড্রাল তৈরির সময় তখনকার প্রকৌশলীরা ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন। হাগিয়া সোফিয়া নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ সালে। এখানে ছিল অর্থডক্স চার্চের প্রধানের অবস্থান। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো এখানেই। প্রায় ৯০০ বছর ধরে আয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টান ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। অবশ্য মাঝখানে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে একটি সংক্ষিপ্ত সময় ছাড়া, যখন চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিকরা এক অভিযান চালিয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। তারা আয়া সোফিয়াকে একটি ক্যাথলিক ক্যাথিড্রালে পরিণত করেছিল। কিন্তু ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদের অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় কনস্টান্টিনোপল। এর নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল। আয়া সোফিয়ায় ঢুকে বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ নির্দেশ দেন এটাকে সংস্কার করে একটি মসজিদে পরিণত করতে। তিনি এই ভবনে প্রথম জুমার নামাজ পড়েন।
অটোমান স্থপতিরা সোফিয়ার ভেতরের অর্থডক্স খ্রিষ্টান ধর্মসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতীক-চিহ্নগুলো সরিয়ে ফেলেন বা পলেস্তারা দিয়ে ঢেকে দেন। ভবনের বাইরের অংশে যোগ করা হয় উঁচু মিনার। ইস্তাম্বুলে ১৬১৬ সালে ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত আয়া সোফিয়াই ছিল শহরের প্রধান মসজিদ। নীল মসজিদসহ এ শহরের এবং বিশ্বের অন্য বহু মসজিদের নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে এর স্থাপত্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৮ সালে শেষ হলে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। বিজয়ী মিত্রশক্তিগুলো তাদের ভূখণ্ডকে নানা ভাগে ভাগ করে ফেলে। তবে ওই সাম্রাজ্যের অবশেষ থেকেই জাতীয়তাবাদী তুর্কি শক্তির উত্থান হয়। তারা প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক তুরস্ক। তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক আদেশ দেন আয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে পরিণত করতে। আয়া সোফিয়াকে ১৯৩৫ সালে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পর এটি তুরস্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনস্থলে পরিণত হয়েছে।
আয়া সোফিয়া এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
তুরস্কের ভেতরে এবং বাইরে বহু গোষ্ঠীর জন্য আয়া সোফিয়ার ১৫০০ বছরের ইতিহাস ব্যাপক ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। ১৯৩৪ সালে করা এক আইনে এই ভবনটিতে ধর্মীয় প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু ইসলামপন্থী গোষ্ঠী এবং ধার্মিক মুসলমানরা দাবি করেন যে, আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করা হোক। তারা ওই আইনের বিরুদ্ধে ভবনটির বাইরে বিক্ষোভও করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বক্তব্যে এই দাবির প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। গত বছর স্থানীয় নির্বাচনের আগে এক প্রচার সভায় দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা ছিল এক ‘বিরাট ভুল’। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, আয়া সোফিয়ায় কোনো পরিবর্তন আনা হলে তা এখন যেভাবে দুই ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সেতু হিসেবে কাজ করছে তা বিনষ্ট হবে। গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক মার্কিন অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ স্যাম ব্রাউনব্যাক তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন আয়া সোফিয়া এখন যে অবস্থায় আছে তেমনি রাখা হয়। কিন্তু তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু জোর দিয়ে বলেছেন, এই ভবনটির অবস্থান তুরস্কের ভূখণ্ডে তাই এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গ্রিসের কিছু বলার থাকতে পারে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement