২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রেকর্ড দামে তরঙ্গ বেচাকেনা, মোবাইল সেবা কি বাড়বে

রেকর্ড দামে তরঙ্গ বেচাকেনা, মোবাইল সেবা কি বাড়বে - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে বেতার তরঙ্গ বা স্পেকট্রাম বরাদ্দের জন্য নিলামে অংশ নিয়ে রবির সাথে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার লড়াইয়ের পর রেকর্ড দামে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনে নিয়েছে গ্রামীণ ফোন।

নিলামে অংশ নিয়ে গ্রামীণ ফোন মোট ১০ দশমিক ৪, রবি ৭ দশমিক ৬ এবং বাংলালিংক ৯ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনে নেয়।

সোমবারের এ নিলামে মোট ২৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বিক্রি করে অপারেটরদের কাছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ পেয়েছে সরকার। বরাদ্দ পাওয়া তরঙ্গের বিপরীতে অর্থের ২৫ শতাংশ শুরুতে দিয়ে পরের পাঁচ বছর প্রতি বছর ১৫ শতাংশ করে টাকা শোধ করবে অপারেটরগুলো।

বিটিআরসির হিসেবে এখন সব মিলিয়ে গ্রামীণফোনের হাতে ৪৭ দশমিক ৪, রবির ৪৪, বাংলালিংকের ৪০ ও টেলিটকের ২৫ দশমিক ২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ আছে।

গ্রামীণ ফোন আশা করছে নতুন করে তরঙ্গ নেয়ার ফলে তাদের গ্রাহক সেবা আরো উন্নত হবে কিন্তু এজন্য গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত অর্থের কোন চাপ পড়বে না।

অন্যদিকে রবি বলছে তাদের গ্রাহকদের ফোন ও ইন্টারনেট সেবার মান আরো বাড়বে অতিরিক্ত তরঙ্গ ব্যবহার করে।

নতুন তরঙ্গে সেবা কি বাড়বে?

কলম্বো ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আবু সাঈদ খান বলছেন নতুন করে এ তরঙ্গ বরাদ্দের কারণে টেলিকম সেবায় স্বল্পকালীন কিছু উন্নতি হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সুফল আসবে না।

‘দীর্ঘমেয়াদী সুফল আনতে হলে অপটিক্যাল ফাইবার অবকাঠামো উন্নত করতে হবে সরকারকে। এখন সেই অবকাঠামো ঠিক না করেই তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হলো। এর ফলে সীমিত সময়ের জন্য গ্রাহকদের সংযোগ বা এমন সেবার কিছু উন্নতি হলেও নতুন করে আবার গ্রাহক বাড়লে সেই আগের সমস্যাই দেখা দেবে।’

তিনি বলেন নতুন তরঙ্গ দিয়ে বেস স্টেশন থেকে গ্রাহকের হাতের ফোন পর্যন্ত কানেকশনের কিছুটা উপকার হবে কিন্তু অপটিক্যাল ফাইবার অবকাঠামোর সুবিধার অভাবে মূল নেটওয়ার্ক থেকে উৎসারিত সেবা বেস স্টেশনে ঠিকমতো যাবে না।

খান বলেন এ ক্ষেত্রে টেকসই সমাধান চাইলে নেটওয়ার্কের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যাধুনিক অবকাঠামো দরকার।

নিলামে যা হলো
সোমবারের এই নিলামে দেশের চারটি মোবাইল অপারেটরই অংশ নেয়। নিলামের শুরুতেই ১৮শ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ৩১ মিলিয়ন ডলার প্রতি মেগাহার্টজ মূল্যে গ্রামীণ শূন্য দশমিক ৪, রবি দুই দশমিক দুই ও বাংলালিংক চার দশমিক চার মেগাহার্টজ পরিমাণ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ নেয়।

এরপর ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গর নিলামে ৫ মেগাহার্টজ করে তিনটি অপারেটর নিয়ে নেয় ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দরে।

বাকি পাঁচ মেগাহার্টজ নিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লড়াই করে গ্রামীণ ও রবি। ২৭ মিলিয়ন ডলার দরে ভিত্তিমূল্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত গ্রামীণ তা কিনে নিয়েছে ৪৬দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলারে।

তবে ভিত্তিমূল্যের চেয়ে এতো বেশি দামে কেনার বিষয়ে গ্রামীণ ফোন বলছে নিলামে এটিই স্বাভাবিক বিষয়।

‘কোনটি ফ্লোর প্রাইসে আবার কোনটি বেশি দামে কেনাটাই স্বাভাবিক। আমাদের আরো তরঙ্গ দরকার। কিন্তু নিয়ম কানুন আছে, সেগুলো মেনেই কিনতে হয়। এখন সেবা আরো উন্নত হবে ওদিকে সরকারকে পাঁচ বছর ধরে টাকাটা (শোধ) দিতে হবে। তাই গ্রাহকের ওপর সরাসরি কোনো চাপ পড়বে না,’ বলছিলেন তিনি।

বিটিআরসি যা বলছে
বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলছেন বিপুল পরিমাণ বাড়তি অর্থ দিয়ে তরঙ্গ নিলেও তাতে গ্রাহকের উদ্বেগের কিছু নেই।

তিনি বলেন, আমাদের কিছু নিয়মকানুন আছে। সার্বক্ষণিক মনিটরিংও করা হয়। হটলাইন, ওয়েবসাইটে মানুষ অভিযোগ জানালে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তাই বেশি অর্থ দিয়ে তরঙ্গ কিনে সেটি গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হবে এমনটি হবে না। আবার বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও যাতে নিয়ম মেনে ও গ্রাহক স্বার্থ ঠিক রেখে ব্যবসা করতে পারে সেটিও দেখা হবে।

কিন্তু ফোরজি চালু করে সে সুবিধা দিতে না পারা মোবাইল অপারেটরগুলোর বিষয়ে তাহলে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এতদিন কিছু কারণে টাওয়ার স্থাপন বন্ধ ছিলো এখন সেগুলোর অনুমতি দেয়া হয়েছে।

বিটিআরসির এই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যন্ত এলাকায় টাওয়ার হচ্ছে। আবার একই সাথে তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ফলে সামনে অনেক সুফল আসবে। আর গ্রাহক স্বার্থে বিটিআরসি সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখবে।’

এক লিখিত বিবৃতিতে গ্রামীণফোন বলছে, তারা গ্রাহক সেবার মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন(বিটিআরসি) আয়োজিত স্পেকট্রাম নিলামে অতিরিক্ত ১০.৪ মেগাহার্টজ অধিগ্রহণের ফলে গ্রামীণফোনের সর্বমোট স্পেক্ট্রামের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭.৪ মেগাহার্টজ।

গ্রামীণফোনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী এবং প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ইয়েন্স বেকার বলেন, ‘একটি সফল ও স্বচ্ছ নিলাম পরিচালনা করার জন্য আমরা বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। এ নিলামের ফল দেশ, টেলিকম খাত এবং গ্রাহকদের জন্য ভালো ফল নিয়ে আসবে।

‘অতিরিক্ত এ স্পেক্ট্রামের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগে আরও বেশি অবদান রাখতে এবং শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান উচ্চগতির ইন্টারনেট চাহিদা মেটাতে গ্রামীণ ফোনকে আরও বেশি সমর্থ করে তুলবে।’

‘অতিরিক্ত স্পেকট্রামের মাধ্যমে গ্রাহকদের ফোরজি ব্যবহার অভিজ্ঞতা এবং সেবা গ্রহণের মান সমুন্নত করার লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে কাজ করবে গ্রামীণফোন। সর্বোচ্চ সংখ্যক ফোরজি সাইটের মাধ্যমে বিস্তৃত ফোরজি কাভারেজ নিশ্চিত করতে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে গ্রামীণফোন।'

আরো পাঁচ মেগাহার্টজ কিনতে চেয়েছিলাম : রবি
রবির চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার, সাহেদ আলম একটি বিবৃতিতে বলেছেন, বিটিআরসির সর্বশেষ নিলাম থেকে আমাদের লক্ষ্য অনুসারে প্রয়োজনীয় তরঙ্গ আমরা কিনতে পেরেছি।

‘তবে কৌশলগত কারণে সর্বশেষ ব্লক থেকে আরও ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ আমরা নিতে চেয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘কারণ এই ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ যদি আমরা বেশি নিতে পারতাম তাহলে আমাদের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো নির্মাণের খরচ কম হতো এবং আমাদের নেটওয়ার্কে সেরা অবস্থান আরো সুদৃঢ় হতো।

‘পাশাপাশি আমরা গ্রাহকদের জন্য প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে বেশি গতিতে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে পারতাম,’ বলা হয়েছে রবির বিবৃতিতে।

এরপরও ১৮০০ ও ২১০০ মেগাহার্টজের দুটি ব্যান্ডে যে তরঙ্গ আমরা কিনেছি তা আমাদের সেবার মান বৃদ্ধিতে অবশ্যই সহায়ক হবে বলে রবির বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন সাহেদ আলম।

তবে গ্রাহকদের প্রত্যাশিত পর্যায়ে টেলিযোগাযোগ সেবার মান উন্নীত করার জন্য মোবাইল অপারেটরদের আরো অনেক বেশি তরঙ্গ প্রয়োজন।

নতুন নতুন ব্যান্ডে বেতার তরঙ্গ বরাদ্দের উদ্যোগের পাশাপাশি অপটিক্যাল ফাইবার, ৪-জি উপযোগী ডিভাইসের ব্যবহার বৃদ্ধিসহ সামগ্রিক টেলিযোগাযোগ ইকোসিস্টেম উন্নত হলেই একমাত্র মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement