২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শহীদুল আলম চৌধুরী আর নেই

শহীদুল আলম চৌধুরী - ছবি : সংগ্রহ

একসময়ের বহুল আলোচিত লেখক, প্রশিক্ষক, সংগঠক ও সমাজসেবক শহীদুল আলম চৌধুরী আর নেই। গত ১৩ মে নগরীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

দীর্ঘদিন ধরে তিনি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক রোগে ভুগছিলেন। গত ৮ মে তিনি পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে নগরীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তর স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে রয়েছে। 

দীর্ঘ রোগভোগের কারণে শেষ কটি বছর কিছুটা অবসর ও লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। ১০ আগস্ট, ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার অন্তর্গত দক্ষিণ রূপকানিয়া (নয়াপাড়া) গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা মলিহুল আলম চৌধুরী বিমানবাহিনীতে কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের 'লেজার কিপার' হিসেবে অবসর নেন। মা খোদেজা বেগম ছিলেন শিক্ষিতা, ধার্মিক ও পর্দানশীন গৃহিণী। যিনি কায়কোবাদের 'মহাশশ্মান' ও বিভিন্ন পুঁথি পাঠ করে গ্রাম্য মহিলাদের আসর মাতিয়ে রাখতেন। দাদা ওয়াহিদ বক্স চৌধুরী ছিলেন জমিদার (ব্রিটিশ আমলে চিটাগাং কালেক্টর এর পক্ষ থেকে এপ্রিশিয়েশন লেটার পেয়েছিলেন), তার মেয়েজামাই ঐতিহ্যবাহী গারাঙ্গিয়ার বড় হুজুর, অর্থাৎ চৌধুরী সাহেবের আপন ফুপা। তিনি বড় হুজুরের স্নেহধন্য ছিলেন। পেয়েছেন আধ্যাত্মিক সবকও।

শহীদুল আলম চৌধুরী ১৯৭২ সালে সাতকানিয়া মডেল হাই স্কুল থেকে ১ম বিভাগে এসএসসি ও সাতকানিয়া মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর বি.এ পাস কোর্সে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে একজন সংস্কৃতি কর্মী, বিতার্কিক ও সংগঠক হিসেবে তিনি দক্ষিণ চট্টলায় বিখ্যাত ছিলেন। পারিবারিক টানাপোড়েন ও ৯ ভাইবোনের সংসারে হাল ধরতে গিয়ে বি.এ শেষ করেননি। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম টেরি বাজারে কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম স্টিল মিলে 'মাস্টার টেক' পদে চাকরি জীবন শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া নিবাসী শামসুল হক চৌধুরীর বড় কন্যা রওশন আরা বেগমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৯৪ সালেস্টিল মিল বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সুনামের সাথে চাকরি করেন। এর মধ্যে তিনি ও তার পরিবার ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল, চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড়ের দু:সহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। সেসময় এই অভিজ্ঞতা ও দূর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তাবনা সংক্রান্ত তাঁর কলাম দৈনিক ইনকিলাব ও সাপ্তাহিক সোনারবাংলা'তে প্রকাশিত ও প্রশংসিত হয়। ১৯৯৩-৯৪ সালে জনাব শহীদুল আলম চৌধুরী কম্পিউটার, প্রযুক্তি ও বিভিন্ন ভাষাশিক্ষা বিষয়ক অনেকগুলো কোর্স করেন এবং প্রশিক্ষণে অংশ নেন। তিনি হয়ে ওঠেন কম্পিউটার পরিচালনা বিষয়ক চট্টগ্রামের প্রথম বেসরকারি প্রশিক্ষক ও উদ্যোক্তা। তৎকালীন চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লাতে 'হোটেল ইন্টারন্যাশনাল' ভবনে ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামের ১ম 'কম্পিউটার রিসার্চ একাডেমী' প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী ১০ বছরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী কম্পিউটার ও বিভিন্ন বিদেশি ভাষা শিক্ষা করে দেশে-বিদেশে সুনামের সাথে সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহ করছে। ২০০৫ সালে তিনি 'মোস্তফা গ্রুপ' এর শিপ ব্রেকিং কোম্পানিতে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেন। সর্বশেষ 'যমুনা শিপ ব্রেকার্স' কোম্পানি হতে ২০১৭ সালে অসুস্থজনিত কারণে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সততা, নিষ্ঠাও পরিশ্রমপ্রিয়তার জন্য তিনি কর্মক্ষেত্রে সর্বজন শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।

শহীদুল আলম চৌধুরী একজন স্বভাব কবি, লেখক ও কলামিস্ট ছিলেন। তিনিই চট্টগ্রামে প্রথম 'কম্পিউটার কোর্স ফর অফিস জবস' নামে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের বই লেখেন। বইটি প্রচুর পাঠক সমাদৃত হয়। কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে পাঠ্যতালিকা ভূক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেটি আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৩ সালে তার প্রথম কবিতার বই 'আজান' প্রকাশিত হয়। 'আজান' একটি সিরিজ কবিতাগ্রন্থ যেখানে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজের আজানকে কেন্দ্র করে ২৮টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এছাড়া মোহাম্মদ সা.কে নিয়ে একটি কবিতা সিরিজের পাণ্ডুলিপি, সমসাময়িকতা নিয়ে অসংখ্য কবিতা, কম্পিউটার সংক্রান্ত আরও দুটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত ও ঘোষণা দিয়েও তিনি প্রকাশ করে যেতে পারেননি। জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব, সংগ্রাম, সাপ্তাহিক সোনারবাংলা, চট্টগ্রামের বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণ প্রভৃতি পত্রিকায় তার কলাম অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। একজন বিশ্বাসী কবি হিসেবে ইসলামের বিভিন্ন প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ এবং কল্যাণমুখী বিষয়াদি নিয়ে তিনি কবিতা লেখেন। যেমন- 'শবেবরাত''মাওলানা রুমি', বৃক্ষরোপণ, ধূমপান'ইত্যাদি শিরোনামে তাঁর লেখা কবিতা পাওয়া যায়। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে কটাক্ষ করে তিনি 'তেলের মজা'নামের একটি কবিতা লেখেন।

কৈশোর কাল থেকেই তিনি জনদরদী ছিলেন। এলাকার বনেদি পরিবারের একজন ও শিক্ষিতজন হিসেবে শিক্ষার প্রসার, সমাজ সংস্কার ও মানব হিতৈষী কার্যক্রমে বরাবর সম্পৃক্ত ছিলেন। তার একান্ত উদ্যোগ, প্রচেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুইটি ব্রিজ, কয়েক কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, মসজিদ নির্মাণসহ অগণিত সমাজকল্যাণমূলক কাজে তিনি সদা তৎপর ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে দুখি মানুষের সমস্যার সমাধান, শহরে নিয়ে চিকিৎসা প্রদান, ইয়াতিমের পড়াশোনার খরচ চালানো ইত্যাদি কাজে তিনি ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। বাগ্মিতা, সদা সহাস্যমুখ ও বিনয়ের জন্য পরিচিত মহলে সবার প্রিয়পাত্র ছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement