২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যেসব বিদেশী গাছের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শত শত দেশী গাছ

অস্ট্রেলিয়ার বনে ইউক্যালিপ্টাস গাছ এবং বাংলাদেশের শালবন। - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে ইউক্যালিপ্টাসের মতো আরো কিছু বিদেশী প্রজাতির গাছ গবেষক ও উদ্ভিদবিদদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা মনে করেন এসব গাছ বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের অপরিসীম ক্ষতি করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলছেন, বিদেশী কিছু বৃক্ষ বাংলাদেশের মানুষই যেমন এনেছে, আবার কিছু উদ্ভিদ নিজেই বাংলাদেশের ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

আর বিদেশী এসব গাছ ও গুল্মের ক্রমাগত বর্ধনের ফলে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে অন্তত এক হাজার প্রজাতির নিজস্ব গাছ।

‘গাছপালা, পশুপাখি, প্রকৃতি সব মিলিয়ে বাংলাদেশের আদি অকৃত্রিম যে ইকোসিস্টেম ছিল, সেই ইন্টিগ্রেশনটা ভেঙে গেছে বিদেশ থেকে আনা ও আসা বনজ বৃক্ষসহ নানা ধরনের উদ্ভিদের চাপে। এর মানে হলো যেসব বৃক্ষ আনা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে এগুলো আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।

মূলত বিদেশী প্রজাতি, যেমন- রেইনট্রি, সেগুন, আকাশমণি, আকাশিয়া, শিশু, বাবলা ও ইউক্যালিপ্টাস জাতীয় গাছের জন্য প্রচুর জায়গার দরকার হয় এবং এগুলো দেশী গাছের তুলনায় অনেক দ্রুততার সাথে বেশি পরিমাণে পুষ্টি মাটি থেকে শুষে নেয়।

এছাড়া এগুলো প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে আর এসব গাছ তাদের সাথে অন্য প্রজাতির গাছকে বাঁচতে দেয়া বলে দেশীয় প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির দিকে চলে গেছে। এভাবেই নষ্ট হয়েছে জৈববৈচিত্র্যের ভারসাম্য, বলছিলেন ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।

আগ্রাসী সব বিদেশী বৃক্ষ
ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে আনা হয়েছিলো রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বুলসহ কিছু গাছ। আবার আশির দশকে আনা হয়েছে আকাশমণি, ইউক্যালিপ্টাস, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা ও খয়ের জাতীয় গাছ।

এছাড়া রিফুজিলতা, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, পিসাইস, পার্থেনিয়াম, কচুরিপানাসহ বেশ কিছু লতা ও গুল্ম অনুমতি ছাড়াই দেশে ঢুকে পড়েছে।

‘উভয় ধরনের উদ্ভিদ মিলে গত কয়েক দশকে আমাদের নিজস্ব ইকোসিস্টেমকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে,’ বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, এক সময় আসবাবপত্র বানাতে ও জ্বালানী কাঠের জোগান দিতে গিয়ে সংকটের মুখে পড়ছিল বাংলাদেশের বনাঞ্চল। তখন বনকে রক্ষা করতে গিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশী প্রজাতির গাছ উদ্যোগ শুরু হয়েছিল।

আর এসব গাছ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো বনভূমি, সড়কের পাশে, এমনকি মানুষের ঘরবাড়ির পাশের জায়গা জমিতেও।

‘এতে করে বাংলাদেশের বনভূমির ওপর চাপ কমেছে সত্যি, কিন্তু কয়েক দশক পর এসে বোঝা যাচ্ছে যে বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে গেছে,’ বলছে জসীম উদ্দিন।

যেভাবে ক্ষতি করে এসব গাছ
ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলছেন, বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিদেশী প্রজাতির গাছগুলো দ্রুত বর্ধনশীল, অন্যদের চেয়ে আগে বাড়ে, অন্য কোনো উদ্ভিদকে সে আশ্রয় দেয় না, আবার নিজে খায় বেশি (অর্থাৎ পানি বা সার প্রয়োজন হয় অনেক বেশি), বংশবৃদ্ধির প্রবণতা বেশি।

‘আমাদের দেশীয় গাছপালাকে ঘিরে অনেক লতাগুল্ম জন্ম নেয় ও বেড়ে ওঠে। আবার এসব গাছপালার ওপার নির্ভর করে নানা ধরনের পাখি, কীট-পতঙ্গের বসবাস ছিল। কিন্তু বিদেশী প্রজাতির গাছগুলো তাদের সহযোগী উদ্ভিদ হিসেবে দেশীয় গাছকে গ্রহণ করেনি।’

ফলে লতাগুল্মসহ অনেক বড় ধরনের গাছও আর টিকে থাকতে পারেনি বলে বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, এক সময় বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণার পর ৩৮৩২টি পর্যন্ত রেকর্ড করা গেছে।

অর্থাৎ হাজারখানেক প্রজাতির বৃক্ষ এখন আর দেখা যায় না।

তবে বনজ গাছের চেয়ে লতাগুল্ম ধরনের কিছু বিদেশী উদ্ভিদ বেশি আগ্রাসীভাবে বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থানে ঢুকে পড়েছে বলে জানান তিনি।

‘রিফুজিলতা, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, পিসাইস, পার্থেনিয়াম, কচুরিপানা - এ জাতীয় প্লান্ট অনুমতি ছাড়াই দেশে ঢুকে পড়েছে। আপনি দেখবেন কয়েক দশক আগে যেখানে সহজেই শাপলা ও পদ্ম মিলতো, সেখানে এখন কচুরিপানা আবার শালবনে ইউক্যালিপ্টাসের সাথে রিফুজিলতা হয়ে গেছে।’

যেভাবে ছড়ালো বিদেশী গাছ
ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলছেন, কিছু সরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছে আবার কিছু সাধারণ মানুষও বিস্তার ঘটিয়েছে। সাম্প্রতিক দশকে বিদেশী গাছের বিস্তার হয়েছে নার্সারির মাধ্যমে।

‘নার্সারি মালিকরা উদ্ভিদবিদ নয়। তারা গাছ চেনে না। দেশী বা বিদেশী গাছ আলাদা করতে পারে না। তারা শুধু বিক্রি করে। যেমন ধরুন : ওয়াক্কাচুয়া নামে একটি গাছ দেখতে ছাতিম গাছের মতো, যেটি এসেছে চীন থেকে। এগুলো এখন দেদারছে বিক্রি হচ্ছে নার্সারিতে।’

তিনি বলেন, তারা নার্সারির ওপর জরিপ করে দেখেছেন যে, নার্সারিগুলোতে দেশীয় বনজ গাছ বিক্রি হয় খুব কম।

এমনকি বিদেশী যেসব প্রজাতি আসছে সেগুলো আনার ক্ষেত্রেও অনুমোদনের ধার কেউ ধারে না বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে ঢাকার আগারগাঁওয়ের একজন নার্সারি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলছেন, সব গাছই এক সময়ে সরকারি নার্সারি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে যা পরে ব্যক্তিগত নার্সারিগুলোর হাতে এসে বিস্তার পেয়েছে।

‘আমরা তো আমদানি করি নাই কিছু। বনজ গাছ বিক্রি হয় কম। বিদেশীগুলো বিক্রি বেশি, কিন্তু সেগুলো তো এক সময় সরকারি নার্সারি থেকেই পেয়েছে সবাই,’ বলছিলেন তিনি।

যদিও এখন অনেক নার্সারি মালিক সরাসরি বিদেশ থেকেও নানা প্রজাতি এনে এখানে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে বিক্রি করছেন এবং এভাবে বিস্তার হচ্ছে অনেক বিদেশী প্রজাতির প্লান্ট।

উত্তরণের উপায় 
ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলছেন, তারা মনে করেন কয়েকটি পদক্ষেপের মাধ্যমে আবার বিদেশী ক্ষতিকর গাছের বিস্তার রোধ করে দেশীয় বনজ গাছের সুসময় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে :

* দেশীয় নিজস্ব গাছপালা নার্সারিতে নিয়ে আসা।

* নার্সারি থেকে বিদেশী গাছ সরানো

* দেশীয় ফলমূল ও বনজ বৃক্ষের মাদার ট্রি থেকে বীজ আনা

* বিদেশে থেকে অনুমতি ছাড়া গাছ আনা বন্ধ করা

মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, বলেন এসব পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব হলে আগামী কয়েক দশক পর আর স্বপ্নেও দেশী গাছ পাওয়া যাবে না।

অবশ্য সরকারের বন বিভাগ সুফল প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের আওতায় সরকারি বনভূমিতে পঞ্চাশটির বেশি দেশীয় প্রজাতির বনজ বৃক্ষ লাগানোর কাজ করছে এবং আগামীতে তাদের এটি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

সূত্র : বিবিসি

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement