২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

করোনার পর যেসব দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে

করোনার পর যেসব দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরেও অনেককে নানা সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে এবং চিকিৎসকরা বলছেন অনেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর শরীরে থেকে যাওয়া সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব না দেয়ায় পরে আরো জটিলতায় পড়ছেন।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলছেন, পোস্ট কোভিড উপসর্গে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর মধ্যে কারো কারো অবস্থা আরো জটিল হয়ে পড়ছে সময়মতো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে।

এই পোস্ট কোভিড সিনড্রোমই লং কোভিড হিসেবে পরিচিত।

কানাডাভিত্তিক চিকিৎসক ডা: শাহরিয়ার রোজেন বলছেন, বাংলাদেশে এবার বয়স্কদের মতো অনেক তরুণের মধ্যে সুস্থ হওয়ার পর লং কোভিডের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

আর বাংলাদেশে গত বছরের মার্চে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর শুরুর দিকে বিষয়টি ততটা নজরে না এলেও গত বছরের শেষ দিকে এসে এবং চলতি বছরের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ার পর লং কোভিডে অনেককেই ভুগতে দেখা যাচ্ছে বলে চিকিৎসকরা বলছেন।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে দেশে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা মোট ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩ জন। আর এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ৩৯৭ জনের।

অন্যদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১১ লাখ ২৫ হাজার ৪৫ জন।

এই সুস্থ হওয়াদের অনেকেই আবার চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হচ্ছেন নানা জটিলতা নিয়ে।

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফারজানা হোসেন তাদেরই একজন। গত বছর সেপ্টেম্বরে তিনি, তার স্বামীসহ পরিবারের কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছিলেন। তবে এখনো তাদের নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হচ্ছে করোনার কারণে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতার কারণে।

ফারজানা বলেন, ফুসফুসের অতটা ক্ষতি তখন বোঝা যায়নি। পরে দেখলাম অল্পতে এত বেশি ক্লান্ত হচ্ছি আবার খুব খারাপ লাগছিল। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেল ফুসফুসের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে যার চিকিৎসা এখনো নিচ্ছি।

ডা: সাজ্জাদ হোসেন বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হওয়ার কিছু দিন পর আবার হাসপাতালে আসছেন অনেকে।

তার মতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে।

প্রায় দেড় বছর ধরে করোনা রোগীদের নিয়ে কাজ করা এই চিকিৎসক বলছেন করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা মূলত কয়েকটি সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এগুলো হলো-

•কোভিড নিউমোনিয়া

•হাইপারটেনশন

•ফাঙ্গাল ইনফেকশন

•ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন

•নিউরোজিক্যাল সমস্যা

•হৃদরোগ

•লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া

•কিডনিতে সংক্রমণ

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কিছু ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেএসেছেন। আমরা এমন রোগী পেয়েছি যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ফুসফুসের ১০ থেকে ১২ শতাংশ সংক্রমণ হয়েছিল। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পরে আবার যখন অসুস্থ হলো তখন দেখলাম যে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ফুসফুস ড্যামেজ।

তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে অনেকের ফুসফুস ছোট হয়ে যায়, যথাযথ চিকিৎসা না হলে যা পরে সুস্থ হওয়ার পরেও জটিলতা তৈরি করে।

অন্যদিকে ফাঙ্গাল ও ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন শরীরে বহুমাত্রিক জটিলতা তৈরি করে।

সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, আবার যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারাও যেমন নানা সমস্যায় পড়েন তেমনি হার্ট, লিভার ও কিডনি নিয়েও সুস্থ হওয়ার পরে অনেককে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে।

কানাডাভিত্তিক চিকিৎসক এবং সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের ডা: শাহরিয়ার রোজেন বলছেন, বাংলাদেশে লং কোভিড বলতে ফুসফুস কেন্দ্রিক সমস্যাই বেশি হচ্ছে এবং অনেকের দীর্ঘ দিন কাশি থাকছে। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন এমন বয়স্কদের সাথে অনেক তরুণও শরীরে যেমন শক্তি পাচ্ছে না, তেমনি তাদের মধ্যে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আবার অনেকে নতুন করে ডায়াবেটিস বা হাইপারটেনশনের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন যা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আগে তাদের ছিল না।

তিনি বলেন, খুব কম সংখ্যায় হলেও সুস্থ হওয়ার পর কারো কারো মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যা স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের মতো ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

লং কোভিডের লক্ষণগুলো কী?
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী কেউ যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর- তা গুরুতর বা মৃদু যাই হোক না কেন - ১২ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও যদি রোগীর দেহে এমন অসুস্থতার লক্ষণ রয়ে যায়, যার কারণ হিসেবে অন্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে ধরে নিতে হবে তার ‘লং কোভিড’ হয়েছে।

ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার তথ্য অনুযায়ী লক্ষণগুলো হচ্ছে :

১. চরম ক্লান্তি বা অবসন্নতা।

২. শ্বাস নিতে কষ্ট বা হাঁপিয়ে ওঠা, হৃৎপিণ্ডের ঘন ঘন স্পন্দন বা বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা বা টানটান ভাব।

৩. স্মৃতি শক্তি বা মনঃসংযোগের সমস্যা - যাকে বলা হয় ‘ব্রেন ফগ’ বা বোধশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।

৪. স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতিতে পরিবর্তন।

৫. হাড়ের জোড়ায় ব্যথা।

তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বৃহত্তম জরিপটি চালিয়েছে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) এবং তারা লং কোভিডে আক্রান্ত লোকদের ১০টি প্রত্যঙ্গে আঘাত হানে এরকম ২০০টি লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন।

লং কোভিডের চিকিৎসা কী
ডা: সাজ্জাদ হোসেন বলছেন, হার্ট, লিভার কিংবা কিডনির ক্ষেত্রে নিয়মিত চিকিৎসা পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হয়। কিডনির অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে কিছু রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়েছে যা করোনার আগে তাদের করাতে হয়নি। আর অন্যগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ট্যাবলেট বা ইনহেলার ব্যবহারের পরামর্শ দেই আমরা। তবে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে গেলে অনেক সময় জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তাই সবাইকে আগেই সচেতন হওয়া বিশেষ করে সুস্থ হওয়ার পরেও নিয়মিত ফলোআপ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়তই লং কোভিড থেকে মুক্ত থাকতে করণীয় বা প্রতিরোধ বিষয়ে নানা ধরণের পরামর্শ দিচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে :

•করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাগ্রহণ করা

•ফুসফুসের ব্যায়াম করা

•পুষ্টিকর খাবারগ্রহণ

•অক্সিজেনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে দরকার হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement