২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না : ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না : ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী - ছবি : নয়া দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। তাই সমাজে তথা রাষ্ট্রে যেসব গুণী ব্যক্তি বাস করেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া আমাদের কর্তব্য। সভ্য দেশগুলোর দিকে তাকান দেখবেন তারা গুণীদের সম্মান দিতে ভুল করে না।

এ সময় তিনি ব্যথিত চিত্তে বলেন, কবি ফররুখ আহমদকে নিয়ে আপনারা অনেক আলোচনা করেছেন। ফররুখের মতো কবি এদেশে জন্ম নিয়ে আমাদের গর্বিত করেছে। আমরা তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি।

এ সময় তিনি কবি ফররুখ আহমদের স্মৃতিবিজড়িত বসতবাড়ি অক্ষুণ্ণ রেখে রেল লাইন স্থাপনের দাবি জানিয়ে বলেন, এ গুণীকে অসম্মান না করাই হবে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গৌরবের।

শনিবার দুপুর ১২টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে মানবতাবাদী কবি ফররুখ আহমদের বসতভিটা আক্রান্ত : ঐতিহ্য রক্ষায় করণীয় ও তার ১০৩তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।

জাতীয় স্মরণ মঞ্চের সভাপতি প্রকৌশলী আ হ ম মনিরুজ্জামান দেওয়ান মানিকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক কবি অধ্যাপক আব্দুল হাই শিকদার, বিএফইউজের মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, কাদের গনি চৌধুরী, বাচিক শিল্পী অ্যাডভোকেট নাসিম আহমেদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী সদস্য শাহনাজ সিদ্দিকী সোমা, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ডিইউজের সাবেক সহ-সভাপতি আমিরুল ইসলাম কাগজী ও কবি ফররুখ আহমদের ছেলে মো: ওয়াহিদুজ্জামান প্রমুখ।

প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, ইউরোপকে এক সময় অন্ধকার যুগ বলা হতো। ইউরোপের সেই অন্ধকার যুগ কেটে গেছে।

তিনি আরো বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি ফররুখ আহমদ মানবতার কবি। মানবতার জাগরণের কবি। ফররুখ আহমদ এদেশের মানুষের জাগরণের কথা তার কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি কবি ফররুখ আহমদও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সরকারের উচিত তাকে সম্মান দেয়া এবং তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি যাতে রেল লাইন থেকে রক্ষিত থাকে সেই দাবি সরকারের নিকট ব্যক্ত করেন।

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ফররুখ আহমদ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফররুখ আহমদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পীদের ধর্মঘটে যোগদানে সংগঠিত ও উৎসাহিত করেন। বায়ান্নর পর রেডিওতে কর্মরত শিল্পী-আলতাফ মাহমুদ, আবদুল আহাদ, আবদুল হালিম চৌধুরীর সাথে কবি ফররুখ শিল্পী-ধর্মঘটে যোগ দেন। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসকদের ব্যঙ্গ করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে একটি নাটক লেখেন যা ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে অভিনীত হয়। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী তাতে অভিনয় করেন।

তিনি বলেন, ফররুখ আহমদের মতো গুণীকে সম্মান দিতে না পারা আমাদের দৈন্যতা। এতে উনার কোনো ক্ষতি নেই। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার একজন ছাড়া আর কাউকে সম্মান দিতে চায় না।

কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ব্রিটিশ-বেনিয়ারা এদেশ থেকে তাদের অপশাসন তুলে লেজ গুটিয়ে চলে যাওয়ার পর ভারত বিভক্তি হলে পাক শাসকেরা রাষ্ট্রীয় ভাষা নিয়ে জোচ্চুরি করতে আরম্ভ করে। ওই সময় বাংলা ভাষার পক্ষে কবি ফররুখ আহমদ তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে জনমত তৈরি করেন। ‘উর্দু বনাম বাংলা’ নামক ব্যঙ্গকবিতায় ১৯৪৫ সালেই তিনি তীব্র বিদ্রূপ হেনে লিখেছিলেন,
‘দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন/বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা’।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই প্রকাশিত তার ‘পাকিস্তান’ : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্যে তিনি দ্বিধাহীন জানিয়েছিলেন : ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছে। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তাই হয়, তাহলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’

তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে লেখনী পরিচালনা করেন। এভাবে যখন চলে আসে উত্তাল কাল ১৯৭১ সাল। তখন মাতৃভূমি বাংলাদেশে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। হাতে বন্দুক নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ না করলেও তিনি স্বাধীনতার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার সম-সাময়িক অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবীকে দেখা গেছে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে ও দেশ স্বাধীনের পরে নিজেকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে প্রচার করতে। অথচ দেশপ্রেমিক এ বিপ্লবী কবির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন থাকার পরেও এখন তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। উল্টা তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপবাদ দেয়া হচ্ছে।

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ফররুখ আহমদের অবস্থান ছিল শোষণের বিরুদ্ধে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান থেকে তাৎক্ষণিক সব অনুষ্ঠান বন্ধ করেন তিনি। নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে নিয়ে নেমে আসেন রাস্তায়। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের হাত থেকে পুরষ্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান। ‘হায়াতদারাজ খান’ ছদ্মনামে পাকিস্তানী শাসকচক্রের অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে রচনা করেন অসংখ্য ব্যঙ্গ রচনা।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ভারতে বৃষ্টি হলে যারা বাংলাদেশে ছাতা ধরেন তাদের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বেতারের চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয় এবং সরকারি বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অবশ্য বিভিন্ন মহল থেকে এর প্রতিবাদ করার ফলে শেষ পর্যন্ত তাকে বাসা ছাড়তে হয়নি। ইস্কাটন গার্ডেনের ওই সরকারি বাসাতেই নানা দুঃখকষ্ট, অনাহারে অর্ধাহারে এবং বিনা চিকিৎসায় কবি অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর কবরের জায়গা চেয়েও সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত তার বন্ধু ও কবি বেনজীর আহমদ শাহজানপুরে তার পৈতৃক কবরস্থানে কবিকে দাফন করার জায়গা দান করেন।


আরো সংবাদ



premium cement