২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হাত বাড়ালেই হেলিকপ্টার

হাত বাড়ালেই হেলিকপ্টার - ছবি : সংগৃহীত

দেশে হুহু করে বাড়ছে হেলিকপ্টারের চল। ২৪ ঘণ্টা আগে বুকিং দিয়ে এখন যে কেউ দেশের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে চাইলেই উড়ে যেতে পারেন এই বাহনে।

বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়েক বছর আগেও দেশে হেলিকপ্টার চলাচল ছিল খুবই কম। সেটা এখন বহুগুণে বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীতে কিছুটা কমলেও এখনো বেশ ব্যস্ততা রয়েছে হেলিকপ্টার অপারেটরদের।

এত দিন এই হেলিকপ্টার যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তবে পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়েছে যে, এখন আর সেখানে এত এত ফ্লাইট সামাল দেয়া যাচ্ছে না। তাই হেলিকপ্টারের জন্য আলাদা একটি হেলিপোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

অবশ্য এই খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এটা আরো আগেই হওয়া উচিত ছিল।

বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স, হেলিকপ্টার অপারেটর, জেনারেল অ্যাভিয়েশন আউটফিট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন হচ্ছে, অ্যাভিয়েশন অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। এক সময় এটাকে সাধারণ যাত্রী পরিবহনকারী এয়ারলাইন্সগুলোর সংগঠন বলে মনে করা হতো। তবে অ্যাভিয়েশন অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, এখন তাদের সংগঠনের বেশিরভাগ সদস্য হেলিকপ্টার অপারেটররাই।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লার লালমাই উপজেলার নাসিরউদ্দিন মির্জা বিয়ে করেন হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে। সেই সময় তিনি ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি।

বাড়ি থেকে বের হয়ে এক ঘণ্টার যাত্রায় পাশের গ্রামে বিয়ে করে তিনি বউ নিয়ে ফিরেছিলেন বাড়িতে।

ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতির হেলিকপ্টারে বিয়ের এই ঘটনায় অনেকেই সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন সামাজিক মাধ্যমে। এখন গ্রামেগঞ্জে এভাবে হেলিকপ্টারে বিয়ের খবর প্রায়ই সংবাদে শিরোনাম হয়। মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুরেও প্রত্যন্ত গ্রাম, এমনকি চড়েও হেলিকপ্টারে বিয়ের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।

বিয়ের মতো উপলক্ষ্যে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা ব্যক্তিরা সমালোচনায় মুখে পড়ার পর তাদের পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের একজন সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার সোলায়মান সুখন।

তিনি সেই সময় একটি ভিডিও’তে বলেছিলেন, ‘কেউ যদি বিয়ের জন্য হেলিকপ্টার নিয়ে যেতে চায়, যাবে। ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ। আমরা যাতে নেগেটিভলি ফেসবুক ভরিয়ে না ফেলি। এ রকম তো হয়, একটা-দুইটা গরু না কেটে সে তো করতেই পারে।’

দেশের প্রথম বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার অপারেটর কোম্পানি সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের অপারেশন ডিরেক্টর স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) গুলজার হোসেন বলেন, ‘এটা এখন আর বিলাসবহুল বিষয় না। এটা এখন একটা সাধারণ যাত্রী পরিবহন সেবা। এভাবেই এটাকে দেখতে হবে।’

বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে হেলিকপ্টার বা বিমান এখনো ‘আকাশে উড়া রহস্যের বাহন। আকাশ দিয়ে বিমান চললে অনেকেই ছুটে আসেন উঠোনে। আর এ রকম বিয়ে, ওয়াজের মতো উপলক্ষ্যে কোথাও হেলিকপ্টার নামলে সেখানে কেবল শিশুরাই নয়, বরং বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষরা ভিড় করেন।

তবে এখন হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে। জরুরি করপোরেট যাতায়াত, বিদেশী বিনিয়োগকারী ও বায়ারদের কারখানায় নেয়া, মেডিক্যাল ইভাকুয়েশন, শুটিং-ফিল্মিং, বার্ড আই ভিউ টুরিজমের মতো বিভিন্ন কারণে মানুষ এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করে।

যাদের হাত ধরে বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক হেলিকপ্টারের যাত্রা শুরু হয় সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের হাত ধরে। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে।

এই কোম্পানির অপারেশন ডিরেক্টর স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) গুলজার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০০০ সালের দিক থেকে আমরা হেলিকপ্টার ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকি। বাংলাদেশে এখন যেসব কোম্পানির হেলিকপ্টার রয়েছে, তারা সবাই মূলত এক সময় আমাদের ক্লায়েন্ট ছিল। চাহিদা বাড়ার পর এখন তারা নিজেরাই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সেই সময় দুইটা হেলিকপ্টার ছিল। এই দুইটা হেলিকপ্টার দিয়ে পুরো বাংলাদেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। তাই অনেকে চাইলেও আমরা ফ্লাইট দিতে পারিনি। তখন আরো কোম্পানির জন্ম হয়।

কারা দেয়, কাদের দেয়?
বর্তমানে স্কয়ার এয়ার লিমিটেড, মেঘনা এভিয়েশন, আর অ্যান্ড আর এভিয়েশন কোম্পানি লিমিডেট, বসুন্ধরা এয়ারওয়েজ, ইমপ্রেস এভিয়েশন, বিআরবি এয়ার লিমিটেড, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স, পারটেক্স এভিয়েশন, বিসিএল প্রভৃতি কোম্পানি এই সার্ভিস দেয়।

এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে হেলিকপ্টার সেক্টরের যাত্রা বেশিদিনের নয়। ১১টা অপারেটর আছে। তাদের আন্ডারে ৩১ হেলিকপ্টার আছে।’

অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান আছে, যারা নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে হেলিকপ্টার কিনেছে। সেখানে যখন তাদের প্রয়োজন হয় না, সেটা বাণিজ্যিকভাবে দিয়ে দেয়। ঘণ্টায় ৬০ হাজার টাকা দিলেই এখন হেলিকপ্টার ভাড়া নেয়া যায়। তবে হেলিকপ্টারের আসন, ধরন ইত্যাদি ভেদে ভাড়া হেরফের হয়। অনগ্রাউন্ড অপেক্ষায় থাকার সময় আলাদা আলাদা চার্জ নেয় কোম্পানিগুলো। তবে কোনো কোনো হেলিকপ্টারে প্রথম এক-দুই ঘণ্টায় এই চার্জ দরকার হয়।

হেলিকপ্টার ভাড়া নিতে হলে যাত্রা এবং গন্তব্যের স্থান, যাত্রীদের পরিচয় ইত্যাদি উল্লেখ করে ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করে বুকিং দিতে হয়। কোনো বিদেশী যাত্রী থাকলে তাদের পাসপোর্টের অনুলিপিসহ আরো বিভিন্ন তথ্য জমা দিতে হয়।

হেলিকপ্টার কোথায় নামবে, তার ব্যবস্থা করতে হয় যাত্রীকেই। একইসাথে স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করে প্রয়োজনে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও তাদেরকেই করতে হয়। বুকিং পাওয়ার পর যাত্রীর তথ্য নিয়ে হেলিকপ্টার কোম্পানিগুলো সিভিল এভিয়েশনের কাছে উড্ডয়নের আবেদন করে। বর্তমানে সাধারণ যাত্রায় উড্ডয়নের অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে এই আবেদন করতে হয়।

বেবিচক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নিরাপদ গমনাগমন নিশ্চিতে আমাদেরকে এসব নিয়ম করতে হয়েছে। তবে জরুরি মেডিক্যাল ইভাকুয়েশনে আমরা তাৎক্ষণিক অনুমতি প্রদান করি।’

সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের অপারেশন ডিরেক্টর স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) গুলজার হোসেন বলেন, ‘শিল্পপতিরা এখানকার সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী। হয়ত বিমানবন্দরে বায়ার এসে নেমেছে। সেখান থেকেই তাদেরকে স্পটে নিয়ে গিয়েছি।’

‘বাংলাদেশে বাইরোডে যাওয়া কতটা কষ্টসাধ্য-সেটা বলার মতো না। একবার কেউ গেলে আর যেতে চাইবে না।

এখানে ইনটানজিবল ভ্যালু হিসাব করতে হবে। যাওয়ার সমস্যা হলে হয়ত আরেকবার আসতোই না। এখন তাদের জন্য এই সার্ভিসটা দেয় হেলিকপ্টার।

তিনি বলেন, ইমপ্রেসের একটা হেলিকপ্টার আছে। সেটা মেডিক্যালি ক্যাপাবল। গত কয়েক মাসে তারা ওই একটা হেলিকপ্টার দিয়ে এই করোনার সময় ১৬৫টি মিশন করেছে।

বেশ কিছু কোম্পানির হেলিকপ্টার এখন মেডিক্যাল ইকুইপড। তারা দ্রুত রোল চেইঞ্জ করতে পারে। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ক্রিটিক্যাল রোগীকে যেকোনো সময় তারা ট্রান্সফার করতে পারে। খুব দ্রুতই ডেডিকেটেড হেলিকপ্টার ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল সার্ভিস বাংলাদেশে চলে আসবে। কারণ, এটার চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে।

এ ছাড়াও শুটিং, ফিল্মিংয়েও অনেকে এই সার্ভিস দেয়।
এক প্রশ্নের জবাবে গুলজার বলেন, ওয়াজ করতে যাওয়া হুজুরদের হেলিকপ্টার ভাড়ার বিষয় মৌসুমী। এটা শীতকালে হয়। কারণ আমাদের দেশে বর্ষাকালে কোনো ওয়াজ হয় না।

তবে হুজুররা কোথাও গেলে সেখানে অনেক মানুষ থাকে, তারা ভিডিও করে। সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে চলে এসে আলোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু করপোরেট প্রয়োজনে যিনি নিচ্ছেন, তারটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। কারণ, তিনি যেখানে নামেন, সেখানে কেউ সেটা ভিডিও করে না।

সাধারণ যাত্রী পরিবহনকারী বিমানগুলো যেখানে ওঠানামা করে, সেটাকে এয়ারপোর্ট বলে। আর হেলিকপ্টারের জন্য নির্ধারিত জায়গাকে বলে হেলিপোর্ট। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো হেলিপোর্ট নেই। বরং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই কাজ চালানো হয়।

এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, প্রত্যেক বড় সিটিতে এক বা একাধিক হেলিপোর্ট থাকে। দিল্লি, লন্ডন, প্যারিসে হেলিপোর্ট আছে। আমাদের সাইজের চেয়ে ছোট হেলিকপ্টার ইন্ডাস্ট্রির দেশেও হেলিপোর্ট আছে। আমাদের ঘনবসতির কারণে এখানে হেলিকপ্টার নামা কঠিন। তাই এখানে হেলিপোর্ট দরকার।

আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দিক থেকেও হেলিকপ্টারকে আলাদা করে দিতে হয়।

হেলিকপ্টারের চাহিদা ক্রমেই বাড়তে থাকায় হেলিপোর্ট নির্মাণের দিকে যাচ্ছে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
বেবিচকের চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালের কাজ চলছে। তাই সেখানে হেলিকপ্টার রাখা যাচ্ছে না। আপাতত তাই উত্তর দিকে জেনারেল এভিয়েশনের সাইটে সরিয়ে নেবো। পরে হেলিপোর্ট হয়ে গেলে সেখানে নিয়ে যাবো।

তিনি বলেন, ‘রাজধানীর খিলক্ষেতের কাওলায় হবে এই হেলিপোর্ট। এর কাজ এখন ডিজাইন পর্যায়ে আছে। আমরা জায়গা নির্ধারণ করে ফেলেছি। এটা ভরাট করতে হবে। সিভিল এভিয়েশনের একটা জায়গাতেই করবো।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ২৮ থেকে ২৯টা হেলিকপ্টার আছে। এখন যে হেলিপোর্ট করছি, সেখানে ন্যূনতম ৫০টি হেলিকপ্টার থাকতে পারবে। এটাকে আরো এক্সপানশন করা যাবে। আপাতত জায়গা ভরাট এবং নকশার কাজ করছি। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।

দেশের প্রথম বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার অপারেটর কোম্পানি সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের অপারেশন ডিরেক্টর স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) গুলজার হোসেন বলেন, আমাদের এখানে দক্ষ জনবলের সঙ্কট সবচেয়ে বড় সঙ্কট। বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত পাইলটরাই এ খাত চালিয়ে নিচ্ছেন বলে মত তার।

তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলটসহ সব ধরনের জনবল সঙ্কট রয়েছে এখানে। এভিয়েশন এমন একটা খাত, এর কোনো লোকাল স্ট্যান্ডার্ড নেই। সব গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড। তাই এটা অন্য যেকোনো ব্যবসা থেকে পৃথক। এখানেও অনেক চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, এখানে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ যন্ত্রাংশের অভাব। সব পার্টসই বিদেশ থেকে আনতে হয়। আনতে গিয়ে যথাসময়ে আনা যায় না। কাস্টমসের লোকজন এখানকার ইমার্জেন্সি বোঝে না। জরিমানা করে। এসবে এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement