২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মহসিন ভিন্নধর্মী এক যোদ্ধা

বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড এবং হুইল চেয়ার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সংগঠন দু’টির প্রতিষ্ঠাতা মো: মহসিন (ডানে) - নয়া দিগন্ত

শারীরিক প্রতিবন্ধিতা জয় করা সম্ভব। প্রতিবন্ধীরা অদৃশ্য গোষ্ঠী নয়। সুযোগ পেলে তারাও অন্য দশটা মানুষের মতো দক্ষ। হোক তা কর্মক্ষেত্রে কিংবা ক্রীড়াঙ্গন। এর প্রমাণ দিয়েছেন মহসিন। বাংলাদেশের হুইল চেয়ার ক্রিকেটের জন্ম মহসিনের হাত ধরে। মহসিন আর তার হুইল চেয়ার ক্রিকেটের সফলতার কথা লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

নাম মো: মহসিন। জন্ম গাজীপুরের টঙ্গী উপজেলার মরকুন গ্রামে। কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। ছোটবেলায় পলিওতে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা তাকে টানত। চলাফেরা করতে পারেন না। তার আবার খেলাধুলা কী? মানুষ এমনই বলত। মহসিন ক্রিকেট ভালোবাসতেন। বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জয় করল। মহসিনের আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। ‘ক্রিকেটার হব, স্বপ্নটা তখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল’- বললেন মহসিন। খেলার পাশাপাশি বাবার ঠিকাদারি ব্যবসা দেখাশোনা করেন তিনি। দুই কন্যাসন্তানের জনক।
বড় কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

টঙ্গী থেকে গুলিস্তান, স্টেডিয়ামপাড়া। কম দূর? সুস্থ মানুষেরই যেতে ভোগান্তির শেষ নেই। তার ওপর যখন তখন যেখানে সেখানে মহসিন যেতে পারেন না। ‘বাসে উঠতে গেলে বাসওয়ালারা নিতে চাইত না। সিএনজি তো নেয়ই না। প্র্যাকটিস শেষ করতে রাত হয়ে যেত’Ñ বলছিলেন মহসিন। নিজেকে কখনো আমি অক্ষম ভাবি না। প্রতিবন্ধিতা আমাকে বন্দী করে রাখতে পারেনি। নিজের সব কাজ আমি নিজেই করি। যখন হুইল চেয়ার ছিল না তখন মাটিতে বসে ক্রিকেট খেলতাম। শুধু ক্রিকেট নয়, মহসিন ভালো ব্যাডমিন্টনও খেলেন। ২০১৯-এ প্রথম প্যারা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে তিনি রানারআপ হন।

দল গঠন

‘হাজারটা প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবু থেমে যাইনি। লড়াই করে চলেছি।’ ২০১২ সালে সিআরপির সহযোগিতায় শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় শারীরিক প্রতিবন্ধী দল বাংলাদেশে আসে। তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মহসিনকে মূল দলে নেয়া হয় না। একটি ম্যাচও তিনি খেলতে পারেননি। অথচ দল গঠনের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। কারণ হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী যারা, কর্তৃপক্ষ তাদের মাঠে নামাতে অনীহা দেখাল। অথচ ভারতে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী খেলোয়াড়রা জাতীয় প্রতিবন্ধী দলে সুযোগ পান। মহসিন খুব কষ্ট পেলেন।

তিনি ভাবলেন, এই বৈষম্যের অবসান হতে হবে। সে ভাবনারই প্রতিফলন হুইল চেয়ারে থাকা খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গঠন। বাংলাদেশ প্যারা অলিম্পিকের কোচ ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদুর রহমান। তার কাছে মহসিন ছুটে গেলেন। তিনি সাহায্য করলেন। গঠন করা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড নামে একটি সংস্থা। জেলা থেকে আবার খেলোয়াড় সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। মহসিন জানালেন, ‘৬৫ জন খেলোয়াড়কে নিয়ে ক্যাম্প করা হয়। ২০১৪ সালের জুনে দলটি ভারতে তাজমহল ট্রফি খেলতে যায়। তখন দলটির স্পন্সর হিসেবে পাশে ছিল জনতা ব্যাংক।’ মহসিনের নেতৃত্বে শারীরিক প্রতিবন্ধী দল ২০১৪ সালের জুনে তাজমহল ট্রফি জয় করে। ২-১ এ সিরিজ জয় করে দেশে ফেরে দলটি। দলটির অধিনায়ক ছিলেন মহসিন। তাজমহল ট্রফি জয়ের পর দলটিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

দু’টি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মহসিন

বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড এবং হুইল চেয়ার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশÑ দু’টি সংস্থাই মহসিনের হাতে গড়া। হাত, পা কোনো একটা নেই। তারা হলেনÑ বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড সংগঠনের সদস্য। আর যারা শুধু হুইল চেয়ারে বসে ক্রিকেট খেলেন, তারা হলেন হুইল চেয়ার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সদস্য। মহসিন এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। এরা শুধু হুইল চেয়ারে বসেই ক্রিকেট খেলেন। মহসিন যখন দেখলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী দলে হুইল চেয়ারে বসে ক্রিকেটাররা জায়গা পান না। তিনি নিজেও এ বিষয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তখন গঠন করলেন হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল। এটা ২০১৬ সালের ঘটনা। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব হুইল চেয়ার ক্রিকেট। এই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মো: মহসিন। এই সংস্থায় বাংলাদেশী আরো তিনজন যুক্ত রয়েছেন বলে জানালেন মহসিন।

চেয়ারে আটকে থাকা জীবন

হুইল চেয়ার যাদের নিত্যসঙ্গী। যখন তখন যেখানে সেখানে যাওয়াÑ মন যা চায় করতে পারেন না তারা। চেয়ারবন্দী জীবন। আসলেই কি তাদের জীবন থেমে আছে? মহসিন বললেন, ‘প্রত্যেক প্রতিবন্ধীর পেছনের জীবনে একটা কষ্টের গল্প আছে। কেউ গাছ থেকে পড়ে, কেউ শিশুকালে পোলিও রোগে, কেউ ভুল চিকিৎসায় অঙ্গ হারিয়েছেন। উপার্জন ভালো নয়। কেউ দোকানদারি, কেউ ছোটখাটো কাজ করেন।’ স্বপন, মইনুলদের কথাই ধরা যাক। ছোটকালে পা হারিয়েছেন। কোথাও কোনো খেলায় তাদের নিত না। মহসিন তাদের কাছে টেনে নিলেন। নতুন, আনন্দময় জীবনের সন্ধান দিলেন। এককালে যারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। তারাই ডেকে এনে চা খাওয়ায়। বললেন প্রতিবন্ধী ক্রিকেটার স্বপন দেওয়ান। খেলার কথা শুনে সাতক্ষীরা থেকে এক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটার একাই ঢাকা চলে আসেন, যা মহসিনকে অবাক করেছিল।

হুইল চেয়ার ক্রিকেটারদের মিলনমেলা

স্বপ্নবাজ মহসিনের স্বপ্ন আলোর মুখ দেখল ২০১৬ সালে। ২০০ হুইল চেয়ার ক্রিকেটার জড়ো হলেন হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে। সেখান থেকে ৩৮ জন হুইল চেয়ার ক্রিকেটার বাছাই হলো। মহসিন বললেন, ‘ক্রিকেটারদের বাছাই করে নিয়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে। অনেকবার বাসে উঠতে গিয়ে আঘাত পেয়েছি। তবুও হাল ছাড়িনি। দমে যাইনি।’ রেনেটার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত হুইল চেয়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চারটি দল অংশ নেয়। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিল ইমাগো স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট। ‘২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ন্যাশনাল হুইল চেয়ার টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় মোট চারটি দলের অংশগ্রহণে। ৬৫ জন ক্রিকেটার আসেন ঢাকার বাইরে থেকে’Ñ জানালেন মহসিন।

মনে জোর আর দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। একটুখানি সহায়তা পেলে প্রতিবন্ধীরা তাদের প্রতিভা মেলে ধরতে পারে। নিজেকে আর দশটা মানুষের সমান প্রমাণ করতে পারে। অন্য প্রতিবন্ধীদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। সেটিই সেদিন শ’দুয়েক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটার প্রমাণ করলেন। হুইল চেয়ারে বন্দী থাকেনি তাদের জীবন। ‘এভাবে কোনো দিন ক্রিকেট খেলতে পারব। স্বপ্নেও ভাবিনি’Ñ বলছিলেন প্রতিবন্ধী এক ক্রিকেটার।

প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা

তাজমহল ট্রফি জয় করল সোনার টুকরো প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল। দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করলেন। এক কোটি টাকা অনুদান, মাঠ, অফিস, বিজয়ী খেলোয়াড়দের এক লাখ টাকার চেক প্রদান করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক মো: মহসিন বললেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, ক্রিকেটার মুশফিকুর রহীম, কাজী সাব্বির, আহমেদ রাকিব, আমিনুর রহমান সুলতান, তৌহিদ ফিরোজ, কাজি সাব্বির, তৌহিদুল ইসলাম দ্বীপ, রাসেল হোসেন প্রমুখ হুইল চেয়ার ক্রিকেটারদের সাহায্য-সহায়তা করেন।

সীমাবদ্ধতার মধ্যে শত সফলতা

কেবল তাজমহল ট্ররফি জয় নয়; ২০১৫ সালে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তানÑ এই পাঁচ দেশ নিয়ে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট এশিয়া কাপ আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ সে টুর্নামেন্টে ভারতকে পরাজিত করে। এর আগে নেপালকেও বাংলাদেশ দল পরাজিত করেছিল। মহসিন জানালেন, তার নেতৃত্বে দল ১৫টি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলেছে, যার মধ্যে আটটি ম্যাচে জয়লাভ করেছে। ২০১৭ সালে ঢাকায় ওয়ালটন সিরিজ, ২০১৭ সালে নেপালে টুর্নামেন্টে রানারআপ, ভারতে অনুষ্ঠিত দু’টি টুর্নামেন্টে দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়।

শুধু নেই আর নেই

নির্দিষ্ট মাঠ নেই। অফিস নেই। সব সময় স্পন্সর থাকে না। খেলার উপকরণ সঙ্কট। এমন অনেক কিছুই নেই। তারপরও মহসিনরা একটুও থেমে নেই। প্রধানমন্ত্রী একটি মাঠ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সে মাঠ এখনো হুইল চেয়ার ক্রিকেটাররা বুঝে পাননি। মাঝে মধ্যে আহসানউল্লাহ স্টেডিয়ামে দল প্র্যাকটিস করে। সপ্তাহে দুই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে ব্যাডমিন্টন কোর্টে দল প্র্যাকটিস করার সুযোগ পায়। বললেন মহসিন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নিয়মিত কোনো সাহায্য প্রদান করে না বলে জানা যায়। তবে জুনে ১৫টি স্পোর্টস হুইল চেয়ার দেবে বলে জানা গেছে।

স্বপ্ন

মহসিনরা আসলে কখনো হারে না। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করতে জানে তারা। স্বপ্ন দেখেন এবং দেখান। প্রত্যেক বিভাগে একটা করে হুইল চেয়ার ক্লাব থাকবে। হুইল চেয়ার ক্রিকেটারদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশে হুইল চেয়ার ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আয়োজন করা। মোটা দাগে এগুলোই লড়াকু মহসিনের স্বপ্ন।


আরো সংবাদ



premium cement