২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ভেজাল ইফতারি চেনাবে মাছি ও পিঁপড়া

- ছবি : নয়া দিগন্ত

ভেজালের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছে রোজাদারের ইফতারি। বাজারের কোনটি ভেজাল আর কোনটি নির্ভেজাল সহজে তা যাচাই-বাছাইও করতে পারছেন না কেউই।

অথচ সারাদিন রোজা রাখার পর ভেজাল খাবারে ইফতার করা হলে তা শরীরের শক্তি আর প্রশান্তির পরিবর্তে রোজাদারের কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিই থাকে বেশি।

তবে সম্প্রতি বেসরকারিভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে খাবারের কোনটি ভেজাল আর কোনটি নির্ভেজাল তা প্রকৃতিগতভাবেই চিনিয়ে দিচ্ছে মাছি আর পিঁপড়া। ফলে বাজারে গিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে আর কোন গবেষণা ছাড়াই যে কেউই এখন ভেজাল আর নির্ভেজাল পণ্য সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন।

বেশ কিছু বাজারের মাছ এবং মওসুমী ফলের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, মাছে ব্যবহার করা হচ্ছে উচ্চমাত্রায় ফরমালিন। আর বিভিন্ন রকমের ফলে ব্যবহার করা হয় জীবনের জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ফরমালিন, কৃত্রিম হরমোন বা বৃদ্ধি সহায়ক ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কৃত্রিম রং আর স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কেমিক্যাল। মুখরোচক খাবার শুটকিতে ব্যবহার করা হচ্ছে কীটনাশক। আখের গুড়ে ব্যবহার করা হচ্ছে হাইড্রোজ, চানাচুর আর জিলাপীকে মচমচে করতে ব্যবহার করা হচ্ছে মানবদেহের পাকস্থলিকে অকেজো করে দেয়ার মতো পদার্থ পোড়া মবিল ও ট্রান্সফর্মারের তেল।

সাধারণ গবেষণায় যে বিষয়টি ভোক্তাদের মনে আশার সঞ্চার করেছে তা হলো, মাছ কিংবা অন্য কোনো মৌসুমী ফলে যদি ফরমালিন কিংবা অন্য কোনো প্রকার কেমিক্যোল ব্যবহার করা হয়ে থাকে তাহলে ঐ মাছ বা ফলের উপর মাছি বসবে না। আর চিনিতে যদি কোনো প্রকার কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তাহলে সেখানে পিঁপড়াও আসবে না। এতে ক্রেতা বা ভোক্তা সহজেই ভেজাল আর নির্ভেজাল পণ্য বাছাই করতে পারবেন।

এদিকে রমজানে ইফতার এবং সেহরীতে বিশুদ্ধ খাবারের জন্য প্রত্যেক রোজাদারই চান ভেজালমুক্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে। কিন্তু ভেজালের ভীড়ে এখন বিশুদ্ধ খাবারেরই যেন হাহাকার। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনষ্টিটিউট (বিএসটিআই) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রোজার শুরুর প্রথম দিন থেকেই রাজধানীতে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে।

কিন্তু এরপরেও বাজারে যেন ভেজাল খাবারের সয়লাব। এরমধ্যে রোজাদাররাই বা কিভাবে নিজেদের উদ্যোগে নির্ভেজাল খাদ্য সংগ্রহ করবেন তার জন্য তারা প্রতিনিয়তই হিমশিম খাচ্ছেন। খাবারের ভেজাল মেশালো হয়েছে কিনা তা সাধারণভাবে চেনা-জানার কিছু উপায়ও গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে। কিছু বিষয়ে ক্রেতা বা ভোক্তা সাধারণ সচেতন হলেই ভেজাল খাবার এড়ানো সম্ভব ।

ভেজাল বা নির্ভেজাল খাবার চেনার কিছু সাধারণ উপায়:

  • মাছ: ফরমালিন থাকলে মাছি পড়বে না, মাছের চোখ নিচের দিকে দেবে যাবে, আইশ ধূসর বর্ণের হবে, মাছের দেহ শক্ত হবে, আশঁটে গন্ধ কম হবে। ফরমালিন না থাকলে মাছি পড়বে, ফুলকা উজ্জ্বল লাল বর্ণের হবে, আইশ উজ্জ্বল হবে, ত্বকের আশঁ পিচ্ছিল হবে। মাছের ফুলকাতে কৃত্রিম রং আছে কিনা হাত দিয়ে নেড়ে দেখতে হবে, হাতে আলগা রং লেগে যাবে ফুলকা উজ্জ্বল লাল হবে, হাতে কোন রং লাগবে না।

 

  • বিভিন্ন মওসুমী ফল: ফরমালিন/ কার্বাইড থাকলে প্রাকৃতিক সুঘ্রাণের পরিপর্তে ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসবে, ফলের কিছু অংশের স্বাদ মিষ্টি হবে আর কিছু অংশের স্বাদ টক হবে।  ফরমালিন/ কার্বাইড না থাকলে সম্পুর্ণ ফলই মিষ্টি লাগবে, ফল নাকের কাছে ধরলে সুঘ্রাণ আসবে,কোন ঝাঁঝালো গন্ধ লাগবেনা।

 

  • কলায় কৃত্রিম হরমোন থাকলে সম্পুর্ণ কলা হলুদ হলেও বোঁটার অংশটি সবুজ থাকবে, প্রাকৃতিক কোন গন্ধ থাকবে না, ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসবে সম্পুর্ণ অংশ একসাথে হলুদ হবে না।

 

  • লিচুতে ফরমালিন/সংরক্ষণে ব্যবহৃত কেমিক্যাল থাকলে গাছে থাকা অবস্থায় কেমিক্যাল দেয়ায় রং হবে মেজেন্ডা। দেখতে রসালো হবে না, ছোলার পরেও রসালো থাকবে না পাকা অবস্থায় রং হবে ইট রঙ্গের। কাঁচা অবস্থায় সবুজ, দেখতে টসটসে ও রসালো হবে।

 

  • আম, পেঁপে, টমোটোতে কৃত্রিম হরমোন/ ক্যালসিয়াম কার্বাইড থাকলে টক বা মিষ্টি কোন স্বাদ থাকবে না, খেতে অনেকটা পানসা লাগবে,শক্ত তেঁতো স্বাদযুক্ত মনে হবে। আর এগুলো না থাকলে ফলের পুরো অংশ একসাথে পাকবে না, ফলের গায়ে কসের দাগ থাকবে।

 

  • আনারসে কৃত্রিম হরমোন/ ক্যালসিয়াম কার্বাইড থাকলে স্তুপের সবগুলো আনারস একসাথে পাকা থাকলে সেখানে নিশ্চিত কেমিক্যাল মেশানো হয়েছে। আর না থাকলে সম্পুর্ণ অংশ একসাথে হলুদ হয়না বা পাকে না, কিছু অংশ সবুজ আর কিছু অংশ হলুদ ছোপ ছোপ অবস্থায় থাকে।

 

  • পটল, আলু, কাঁচা মরিচে কৃত্রিম রং থাকলে হাতে আলগা রং লেগে যাবে, প্রাকৃতিক কোন ঘ্রাণ থাকবে না। আর কৃত্রিম রং থাকলে হাতে কোন রং লাগবে না, প্রাকৃতিক ঘ্রাণ থাকবে।

 

  • শুটকিতে কীটনাশক থাকলে শুটকীর সেই উঁটকো গন্ধ থাকবে না। আর না থাকলে শুটকিতে উটকো গন্ধ থাকবে।

 

  • চিনিতে ফরমালিন/ কেমিক্যাল থাকলে চিনির ওপরে কোন পিঁপড়া বা মাছি পড়বে না। আর না থাকলে মাছি এবং পিঁপড়া সরতেই চাইবে না।

 

  • আখের গুড়ে হাইড্রোজ থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে গুড়ের রং বেশি সাদা ও উজ্জ্বল দেখাবে। আর না থাকলে কিছুটা কালচে থাকবে, প্রাকৃতিক গন্ধ অটুট থাকবে।

 

  • চানাচুর/ জিলাপীতে পোড়া মবিল/ট্রান্সফর্মারের তেল থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় মচমচে থাকবে। আর না থাকলে অতিরিক্ত সময়ে মচমচে থাকবে না, কিছু সময়ের পরে নেতিয়ে যাবে।

সূত্র: ‘বিশুদ্ধ খাদ্য চাই’ এর গবেষনা প্রতিবেদনের আলোকে প্রচারনাপত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য

সারা বছরই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার পক্ষ থেকে ভেজাল বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকে। রমজানে যদিও এই অভিযান কিছুটা দ্রুততার সাথে দেখা যায় কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে রোজার পরেই আবার সেই আগের অবস্থায় চলে যায় সব অভিযান। কিন্তু গ্রাহক বা ক্রেতাদের জীবন ও স্থাস্থ্যের বিষয়ে শুধু সারা বছরই নয় প্রতিটি দিন ক্ষণই চিন্তায় রাখতে হবে। তাই বিশুদ্ধ খাদ্যের বিষয়ে শুধু রোজাতে নয় খাদ্যের ভেজাল বিরোধী অভিযান চালাতে হবে সব সময়েই।

গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিষ্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. শাকিল মাহমুদ নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানান, সুস্থ জীবনের জন্য চাই বিশুদ্ধ খাবার। সামাজিকভাবে সচেতনতার উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি আরো জানান, জনগণকে বিশুদ্ধ খাদ্যের বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। কোনটি খাদ্য আর কোনটি খাদ্য নয় তা চিনতে হবে বুঝতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া নির্দেশনা মতো পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিশুদ্ধ খাদ্য নিয়ে জনগণকে আরো বেশি সচেতন হওয়ার উপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement