১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভারতীয় শ্রমিকরা ইসরাইলি সৈন্যদের ছাউনি, ফিলিস্তিনিদের বন্দীশালা নির্মাণ করছে!

মোদি ও নেতানিয়াহু - ফাইল ছবি

ইসরাইল-ফিলিস্তিনি যুদ্ধ অব্যাহত থাকার মধ্যেই এপ্রিল আর মে মাসজুড়ে দফায় দফায় ভারতীয় শ্রমিকরা উড়ে যাচ্ছে ইসরাইলে। এপ্রিলের গোড়ায় ইসরাইল সরকার একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ছয় হাজার শ্রমিক যাতে এই দু’মাসে আসতে পারেন, তার জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিকাদারের মাধ্যমে নয়, দু’দেশের সরকারের মধ্যে শ্রমিক সরবরাহের চুক্তি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি এবং বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত বছর মে মাসে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন যে ভারত থেকে ৪২ হাজার শ্রমিক পাঠানো হবে। এপ্রিলের গোড়ায় ৬০ জন ইসরইলে পৌঁছে গেছে।

যথেষ্ট দক্ষ শ্রমিক পেতে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, এজেন্ট নিয়োগ করেছে ভারতের স্কিল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে চলা এই সংস্থার মাধ্যমেই শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে ইসরাইলে। বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানাতে দক্ষ কর্মীদের নাম লেখাতে বড়সড় কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়েছে। ৩৪ হাজার নির্মাণশ্রমিক এবং আট হাজার নার্সিং কর্মী প্রয়োজন। তা ছাড়াও দরকার লোহার কাজে দক্ষ শ্রমিক, সিরামিক টাইলস বা প্লাস্টার করার কাজে দক্ষ মিস্ত্রি। ভারতীয় শ্রমিকদের চাহিদার কারণ- যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইসরাইল সরকার ৯০ হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিকের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ বাতিল করেছে। অনেক বিদেশী শ্রমিক যুদ্ধ শুরু হতে দেশে ফিরেও গেছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে ভারত সরকার।

সরকারের এই সিদ্ধান্তে দু’টি বড় প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম প্রশ্নটি নৈতিক। ইসরাইলকে সহায়তা করার অর্থ, গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধের সহায়তা করা, যেখানে ইতিমধ্যেই অন্তত ৩০ হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। ভারতীয় শ্রমিকরা ইসরাইলের সৈন্যদের ছাউনি, কিংবা ফিলিস্তিনি বন্দিদের জেলখানা বানাচ্ছন, এই কল্পনায় মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ভারতের ১০টি প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন একযোগে প্রতিবাদপত্র দিয়ে ইসরাইলে ভারতীয় শ্রমিক পাঠানোর বিরোধিতা করেছে। অরুন্ধতী রায় সরকারের সমালোচনা করে লিখেছেন, আমেরিকা রফতানি করছে তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ- অস্ত্র আর টাকা, আর ভারতও রফতানি করছে তার উদ্বৃত্ত সম্পদ- কর্মহীন, দরিদ্র মানুষ। তবে এই সব বিরোধী কণ্ঠস্বরকে নরেন্দ্র মোদি সরকার কানে তোলেনি।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ওই শ্রমিকদের নিরাপত্তার। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে, গত বছর অক্টোবরে ভারত সরকার ‘অপারেশন অজয়’-এর মাধ্যমে ছয়টি বিমানে ইসরাইল থেকে বেশ কিছু ভারতীয় নাগরিককে উদ্ধার করেছিল। অথচ আজ যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে সে দেশে পাঠাতে চায়। এপ্রিলে প্রথম দফায় শ্রমিকদের পাঠানোর সময় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রণধীর জায়সওয়াল সাংবাদিকদের বলেন যে শ্রমিকদের সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য সার্বিক ব্যবস্থার শর্ত দু’দেশের চুক্তির মধ্যেই রয়েছে, এবং ইসরাইল তার রূপায়ণ করছে।
বস্তুত গত বছর মে মাসে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিতে বলা হয়েছে, ভারতের শ্রমিকদের ইসরাইলের নাগরিকদের সমান মর্যাদা দেয়া হবে, এবং যথাযথ আবাসন, স্বাস্থ্য বিমা এবং সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বিশদ শর্তগুলি কী, তা জানা যায়নি। মালয়ালি শ্রমিক নিবিন ম্যাক্সওয়েল (৩১) হামাসের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। অতীতে কুয়েত, ইরাকের যুদ্ধ, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের সময়ে ভারতীয় শ্রমিকদের অবস্থা হয়েছিল ভয়ঙ্কর। ইসরাইলে কাজের অভিজ্ঞতাও সর্বদা ভালো নয়- কম মজুরি, অতিরিক্ত সময় খাটানো, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা, থাকা-খাওয়ার অব্যবস্থা, এমন নানা সঙ্কটের কথা জানিয়েছিলেন ভারতীয় শ্রমিকরা।

উল্লেখ্য, বিদেশে যাওয়ার জন্য শ্রমিকদের যে নিয়মবিধি বা ‘প্রোটোকল’ রয়েছে- যেমন বিদেশ দফতরের ই-মাইগ্রেট পোর্টালে নথিভুক্ত করা, বিমা করা- সে সব এ ক্ষেত্রে মানা যাচ্ছে না। কারণ গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে ইসরাইল নেই। কেবল দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভরসায় শ্রমিকদের পাঠানো হচ্ছে, অথচ যুদ্ধরত একটা দেশ কী করে শ্রমিকদের সুরক্ষিত রাখবে, তা স্পষ্ট নয়।

কিছু দিন আগে ভারত সরকার ইতালির সঙ্গে চুক্তি করে সে দেশেও ২০ হাজার শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। ডিসেম্বর ২০২৩-এ এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কথা চালাচ্ছে তাইওয়ানের সরকার, এক লাখ শ্রমিক পাওয়ার জন্য। পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকরা বিভিন্ন উপনিবেশে ভারতীয় শ্রমিকদের রফতানি করত। কী অমানবিক পরিস্থিতিতে তাদের কাজ করতে হতো, তার সাক্ষ্য মেলে ইতিহাসে, সাহিত্যে। স্বাধীন ভারতে ইতিপূর্বে ভারত সরকার বিদেশে শ্রমিক পাঠানোয় সক্রিয় ভূমিকা নিত না। মোদি সরকার সেই নকশা বদল করল। বহু শ্রমিক এতে উৎসাহী- বিদেশের মুদ্রায় তারা যা রোজগার করতে পারবে, তা ভারতের চাইতে অনেকটা বেশি। আবার অনেকে আপত্তি করছে, ভারতে কাজ তৈরি না করে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো কেমন নীতি? দেশের শ্রমসম্পদকে কি এখন রফতানিযোগ্য ভাবা হচ্ছে? অতীত দেখিয়েছে, বিদেশে দরিদ্র মানুষটাই পণ্য হয়ে যায়, মানবাধিকার বা নীতি-নৈতিকতা অবশিষ্ট থাকে না। চুক্তির মাধ্যমে এ বছর যে শ্রমিকরা বাইরে যাচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা সুরক্ষিত থাকবে তো?
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা


আরো সংবাদ



premium cement