১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ

কারিমা এলরাস, যিনি তার ছেলে আহমেদকে গাজার আল নাসের হাসপাতালে খুঁজে পেয়েছেন। গত ২৫ জানুয়ারি আহমেদ নিহত হন। - ছবি : বিবিসি

একজন মা তার নিখোঁজ সন্তানকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াবেই এবং যতদিন পর্যন্ত তার শরীরে শক্তি আছে, ততদিন পর্যন্ত তিনি তার খোঁজ থামাবেন না।

এক্ষেত্রে তার সন্তান জীবিত না কি মৃত, সেটি কোনো বিষয় না তার কাছে।

গত চারদিন ধরে কারিমা এলরাস গাজার আল নাসের হাসপাতালের গণকবরের কোলাহল, ধুলোবালি ও অসহনীয় দুর্গন্ধের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

তিনি ২১ বছর বয়সী সন্তান আহমেদের মা, যিনি গত ২৫ জানুয়ারি দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরে নিহত হন। কিন্তু এরপর থেকে আহমেদের লাশ নিখোঁজ রয়েছে।

গত মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল কারিমা অবশেষে তার ছেলেকে খুঁজে পান।

তিনি বলেন, ‘আমি এখানে বারবার এসেছি। আমার ছেলের, আমার ছেলে আহমেদের, আমার আদরের ছোট্ট ছেলে, আমার ভালোবাসা’র লাশ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত। ওর বয়স যখন ১২ বছর, তখন ও ওর বাবাকে হারিয়েছে এবং তারপর থেকে আমিই ওকে বড় করেছি।’

অন্য পরিবারগুলো গণকবরের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল।

হতাশাজনক হলেও বিশ্বের সব যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলেরই খুব পরিচিত দৃশ্য এটি।

মৃতদেরকে খুঁজে পাওয়ার জন্য বুলডোজারগুলো মাটি খুঁড়ছে। মাটির নিচ থেকে একটি শক্ত হাত প্রসারিত হয়ে আছে। কবর থেকে উত্তোলিত লাশ সমাধিস্থ করার জন্য আলাদা আলাদা স্থান চিহ্নিত করছেন খননকারীরা। প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলো আশা করে আছে যে কবর থেকে উত্তোলন করা লাশগুলোর মাঝে তাদের খুঁজে পাবে।

কিন্তু এমন দৃশ্যের ব্যাখ্যা সবসময় একইরকম না। প্রতিটি গণকবর- সেটি হোক বলকান অঞ্চলের দেশগুলো, মধ্য আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, অথবা অন্য কোথাও- সেখানকার স্থানীয় অবস্থার ফলাফল।

গাজার এমন একটি যুদ্ধ চলছে, যেখানে ৩৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, যারা একটি জনাকীর্ণ স্থানে বসবাস করতো। এখন এই লাশগুলোকে দাফন করা বেশ জটিল ও বিপজ্জনক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছু করবস্থানে কোনো জায়গাই আর খালি নেই। আবার চলমান লড়াইয়ের কারণে অন্য কবরস্থানগুলোতে পৌঁছানোটাও অসম্ভব। এসব কারণে লাশগুলোকে হাসপাতাল চত্বরেই কবর দেয়া হচ্ছে, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী হামাসের সাথে যুদ্ধ করেছে বলে বলছে।

আমি এর আগে কিছু যুদ্ধ নিয়ে রিপোর্ট করেছি। সেসব ক্ষেত্রে এটি খুব দ্রুততার সাথে যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা সম্ভব ছিল যে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে এলে কী হয়েছে। এটা বলা সম্ভব ছিল, কারণ ময়নাতদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতো এবং সাংবাদিকরাও দ্রুত ওই এলাকায় প্রবেশ করতে পারতো।

কিন্তু গাজার বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে ইসরায়েল ও মিশর আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের কাছে কিছু স্বীকার করতে অস্বীকার করছে এবং ময়নাতদন্তকারীদের যে কোনো দলের জন্য এই সংঘাত অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে, সেখানে দাঁড়িয়ে নাসের হাসপাতাল এবং আল শিফা হাসপাতালের কবর থেকে মৃতদেরকে কখন ও কীভাবে উত্তোলন করা হয়েছিলো, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বলা মুশকিল কবে তারা মৃত্যুবরণ করেছে।

এদের মধ্যে অন্তত কিছু মানুষ কি ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল- যেমনটা দাবি করছে হামাস ও স্থানীয় উদ্ধারকারীরা।

অথবা, গণকবরে পাওয়া শত শত লাশ কী মেডিক্যাল কমপ্লেক্সের ভেতরে ও চারদিকে হওয়া বিমান হামলা ও লড়াইয়ের শিকার? না কি তারা যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট কোনো রোগ ও অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেছে? না কি ইসরায়েলি বাহিনী এই লাশগুলোকে একটি কবর থেকে আরেকটি নতুন কবরে স্থানান্তর করেছে?

নাসের হাসপাতালের সমাধি সম্বন্ধে আমরা কী জানি?
গত ২২, ২৩ ও ২৮ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা কিছু ভিডিও যাচাই করে দেখেছে বিবিসি ভেরিফাই। সেগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে ফিলিস্তিনিরা গাজার আল-নাসের হাসপাতাল প্রাঙ্গণের দু’টি স্থানে লাশ দাফন করছে। পোস্ট করা সেই ভিডিওগুলোর মাঝে মিল রয়েছে। তাতে সারিবদ্ধ পাম গাছ ও অদূরে অবস্থিত ভবন দেখা গেছে।

চিকিৎসাকর্মী এবং বাস্তুচ্যুত বেসামরিক ব্যক্তিরা ওই এলাকাজুড়ে তীব্র লড়াইয়ের কথা জানায় এবং এরপর হাসপাতালটিকে ইসরায়েলি বাহিনী ঘেরাও করে ফেলে। সেখানে অস্থায়ী দাফন করা হয়।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি অভিযান শুরু করার আগে কতগুলো লাশ দাফন করা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করার কোনো উপায় আমাদের কাছে নেই। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৭ জানুয়ারি বলেছে যে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ১৫০ জনকে দাফন করা হয়েছে, কিন্তু এই সংখ্যাটি যাচাই করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।

তবে আমরা এটি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে খান ইউনিস থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পর সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে একই সমাধিস্থল দেখানো হয়েছে। ভিডিওগুলোতে গাছে ও ভবনের একইরকম সারি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে যে ৩৩০টিরও বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষগুলো কখন ও কীভাবে মারা গেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারছি না। ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের আগে ওখানে কতগুলো লাশকে দাফন করা হয়েছে, নাসের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই হিসাব রাখতে পারে। কিন্তু আমরা তা জানি না।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করেছে যে হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মধ্যে কেউ ছিল কি না, তা দেখার জন্য তারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণের কবরগুলো খুঁড়ে লাশগুলোকে বের করে পরীক্ষা করেছে এবং পরীক্ষা শেষে ‘তাদের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।’ কিন্তু স্কাই নিউজ ভিডিও এবং স্যাটেলাইট ইমেজ যাচাই করেছে। সেখানে দেখা যায় যে অভিযান পরিচালনার সময় ইসরায়েলি বুলডোজারগুলো হাসপাতাল প্রাঙ্গণের ওপর দিয়ে চলে গেছে। ফলে ওই স্থানের দৃশ্যমান ক্ষতি হয়েছে।

আল নাসের হাসপাতাল
ফিলিস্তিনি অঞ্চলের জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার দফরের পরিচালক অজিথ সাংহে আমাকে বলেছেন, কবরগুলোর একটি স্বাধীন ময়নাতদন্ত করতে হবে।

মঙ্গলবার জাতিসঙ্ঘের আরেক কর্মকর্তা জানান, হাত বাঁধা অবস্থায় কিছু লাশ পাওয়া গেছে।

উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি দল প্যালেস্টেনিয়ান সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তার বক্তব্যের সাথে এই কথার মিল পাওয়া যায়। ওই কর্মকর্তাও বলেছিলেন যে লাশদেরকে হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে, কিছু লাশকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা গেছে এবং কয়েকজনকে বন্দিদের পোশাক পরিহিত অবস্থায়ও পাওয়া গেছে।

রিম জেইদান, যিনি দুই সপ্তাহ ধরে তার ছেলে নাবিলের লাশের খোঁজ করছেন। সবশেষে বুধবার বিকেলে তিনি তার ছেলের লাশ খুঁজে পেয়েছেন।

রিম বলেন, তিনি মৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। সেইসাথে লাশগুলোর হাত বাঁধা ছিল।

তিনি বরেন, ‘তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কাউকে কাউকে আবার হাত ও পা একসাথে বেঁধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। আর কতকাল এটি চলবে?’

আমি সাংহেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তিনি হাত বাঁধা লাশের কোনো প্রমাণ দেখেছিলেন কি না।

উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে, কিন্তু এখনো কোনো প্রমাণ নেই। এই তথ্যটি বিভিন্ন উৎস থেকে নিশ্চিত হওয়া দরকার এবং সেকারণেই আমাদের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত করা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা তা অনুমোদন করতে পারি না। এই পরিস্থিতিতে আমরা গাজায় অসংখ্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেখেছি, যার মাঝে অনেকগুলোই সম্ভাব্য যুদ্ধ অপরাধ। এবং যেখানে আমরা সম্ভাব্য নৃশংস অপরাধের শঙ্কা উত্থাপন করেছি, তা অস্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্রতা আরো ব্যাপক হয়েছে।’

সাংহে বলেন, ইসরালের অনুমতি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেলে গাজায় মোতায়েন করার মতো দল প্রস্তুত প্রস্তুত আছে তার।

এদিকে, হাসপাতালে লাশ দাফন করার বিষয়টিকে মিথ্যা ও মানহানিকর আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

এক বিবৃতিতে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) জানায়, ‘আইডিএফ ফিলিস্তিনিদের লাশ দাফন করেছে, এই দাবি ভিত্তিহীন ও অমূলক।’

আইডিএফ আরো বলেছে, গত ৭ অক্টোবর যাদেরকে জিম্মি করে হামাস গাজায় নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মাঝে কেউ ছিল কি না, তা দেখতে লাশগুলোকে তোলা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে : ‘গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী যেসব স্থানে জিম্মিদের উপস্থিতির সম্ভাবনা ছিল, শুধুমাত্র সেসব স্থানে খুব সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করা হয়েছিল। মৃত ব্যক্তিদের মর্যাদা বজায় রেখে পরীক্ষাটি সম্মানের সাথে পরিচালিত হয়েছিল। শনাক্তকরণের চেষ্টা ও লাশকে যথাযথ সম্মানের সাথে দাফন করার চেষ্টা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।’

সোমায়া আল-শোরবাগি নাসের হাসপাতাল থেকে তার স্বামী ওসামার লাশ উদ্ধার করেন এবং তাকে পরিবারের বাকি সদস্যদের পাশে সমাহিত করার জন্য একটি কবরস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।

তার মেয়ে হিন্ডের সাথে তিনি সদ্য খোঁড়া কবরের কাছে হাঁটু গেড়ে বসেন।

সোমায়া বলেন, ‘আমার মেয়ে আমাকে তার বাবার কবর দেখাতে বলেছিল। এবং আমি তাকে বলব যে যত দ্রুত সম্ভব দাফন দেওয়ার পর আমরা তার কবর দেখতে যাব। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এটি খুব কঠিন পরিস্থিতি, কিন্তু তাকে দাফন করার পর আমরা কিছুটা স্বস্তি পাব।’

ছোট্ট হিন্ড, যার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। শিশুর সারল্যের দৃষ্টিতে বাবাকে স্মরণ করছিল: ‘সে আমায় ভালোবাসত এবং আমার জন্য প্রায়ই অনেককিছু কিনত। সে আমাকে নিয়ে প্রায়ই বাইরে ঘুরতে যেত।’

এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে এলিস ডয়ার্ড, হানিন আবদিন, নিক মিলার্ড ও শেরিন ইউসেফ।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement