১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পরিণামে কি শেষ পর্যন্ত লাভ হলো ইরানের?

সাদ্দাম হোসেন। - ছবি : বিবিসি

ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের পতনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জয় হয়েছে সত্যি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জয় আসলে শাপেবর হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিপক্ষ ইরানের জন্য।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর থেকে ইরান আসলে ইরাকের ওপর বড় ধরনের প্রভাব তৈরি করেছে, যা কখনো কখনো উদ্বেগের কারণ হয়েছে পশ্চিমা নেতাদের জন্যও। ইরাক যুদ্ধে সাড়ে চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা আর আনুমানিক এক লাখ বিশ হাজার ইরাকি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ২০ বছর পার হলেও এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসেনি ইরাকে।

এই যুদ্ধের আগে ওই সময়কার ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেনের কারণে দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান। ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শিয়া মতাবলম্বী হলেও সাদ্দাম ছিলেন সুন্নি। আবার এর মধ্যেই আঞ্চলিক প্রভাব বলয় তৈরির যে চেষ্টা ইরান করছিল, সেটি প্রসারের পেছনে একসময় বড় বাধাই ছিলেন সাদ্দাম হোসেন ।

২০০৩ সালে আমেরিকান আগ্রাসনে তার পতনের পর ইরান রাতারাতি যে সুবিধা পেয়ে যায়, তা কাজে লাগানোর চেষ্টা তারা তখন থেকেই অব্যাহত রেখেছে। ইরাকের ভেতরে একাধিক শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে বেশ সাফল্যও দেখিয়েছে ইরান। এমনকি এখন ইরাকি পার্লামেন্টের ভেতরেও ইরানের পক্ষে কথা বলার মত অনেকগুলো প্রভাবশালী কণ্ঠ তৈরি হয়েছে। এরপর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ইরানকে সেদেশে সামরিক উপস্থিতির সুযোগ তৈরি করে দেয়। এছাড়া পাশের দেশ লেবাননে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হেযবোল্লাহ দেশটির সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি।

আমেরিকার ঘাঁটিতে থেকে থেকে রকেট হামলা এবং সেই সাথে ইরাকের রাস্তায় আমেরিকান সৈন্য উপস্থিতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন যুগিয়েছিল ইরান। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন, সেটি অনেকে তেহরানের জন্য স্বস্তি তো বটেই, কেউ কেউ দেখেছেন বিজয় হিসেবেও।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের মতে, যুদ্ধের ২০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে ওই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্যে ইরান অনেক অগ্রসর হয়েছে এবং অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ২০ বছর আগের তুলনায় ওই অঞ্চলে ইরান তার প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও তুরস্কের তুলনায়ও অনেক ভালো অবস্থানে আছে।

তিনি বলেন,‘ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পর ওই অঞ্চলে এবং ইরাকে যে রাজনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ইরান। কারণ এখন ইরাকে যারা ক্ষমতায় আছেন তারা কোনো ভাবেই ইরানের প্রতি হুমকি নয়।’

ড. আলী রীয়াজ বর্তমানে সুইডেনের ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্রেসি ইন্সটিটিউটের ভিজিটিং রিসার্চার।

ইস্তাম্বুল ভিত্তিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিক্ষক মুরাত আসলানও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন। তার মতে যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ইরাকি সিস্টেম ভেঙে পড়েছিল এবং এর ফলে ভয়াবহ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ ও পরের সহিংসতায় হতাহত হয়েছে এক লাখেরও বেশি মানুষ। উত্থান হয়েছে আইএসের। পরে যখন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করল, তখনো আসলে ইরানের প্রভাবই মুখ্য হয়ে ওঠেছে। শেষ পর্যন্ত ইরানি রিভলিউশনারি গার্ডের নিয়ন্ত্রণেই চলে যায় রাজনৈতিক ও সামরিক নানা বিষয়।’

তার মতে ইরানই এখন ইরাকের শিয়া মতাবলম্বী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি বলেন, দেশটির প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর অনেকগুলোই ইরান ঘেঁষা। ফলে ইরাকের রাজনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুকে প্রাধান্য বিস্তারের মতো অবস্থানেই আছে এখন ইরান।’

ইরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র কোনগুলো
২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর থেকেই ইরাকি রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে থাকে ইরান এবং দেশটির অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের সাথেই ইরানের যোগসূত্র আছে। এসব দল কিংবা বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে অর্থ ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে ইরান। এরা সবাই মিলেই ইরাকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য তুমুল বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। ইরাকে থাকা মার্কিন সেনাদের ওপর অনেকগুলো হামলার জন্যও ইরানের সমর্থনকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে শুরু থেকেই ইরান কয়েকটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এর মধ্যে একটি হলো বাগদাদের সরকার যেন আগের মতো ইরান বিরোধী না হতে পারে সেটি নিশ্চিত করা।

এটি তারা করেছে মূলত নয় বছরের ইরাক-ইরান যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে। ওই যুদ্ধে ইরাক রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ আছে। আর ইরানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট ছিল ইরাকসহ ওই অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহারের পরিস্থিতি তৈরি করা। অন্যদিকে ইরানের বাইরে থেকে কাজ করা ইরানের কিছু কুর্দি গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল উত্তর ইরাকে। ইরান কখনো কখনো তাদের টার্গেট করে হামলাও করেছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই ইরান ইরাকের অভ্যন্তরে সক্রিয় ভাবে কাজ করতে শুরু করেছিল সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর।

ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘এখন ইরাকে এমন কোনো সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না, যারা ইরানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে। গত দুই দশকে ইরাক ও ইরানের মধ্যে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বাণিজ্য হয়েছে।’

২০১৯ সালে ইরাকে যে তুমুল সরকার বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল তাতেও ইরানের ইন্ধন ছিল বলে মনে করেন অনেকে।

তবে রাজনীতির বাইরেও ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান ইরানের জন্য ইরাকের ওপর প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। দু‘দেশেই শিয়া মতাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। উভয় দেশেই আছে কুর্দি জনগোষ্ঠী। হাজার মাইলেরও বেশি সীমান্তে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে উভয় দেশের মানুষের জীবনযাত্রা। পাশাপাশি প্রতি বছর হাজার হাজার ইরানি শিয়া মতাবলম্বী কারবালা ও নজফ ভ্রমণ করে ধর্মীয় কারণে।

গত কয়েক বছরে এসব মাজারের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে ইরান। আবার সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরতন্ত্রের সময় অসংখ্য ইরাকি ইরানে আশ্রয় নিয়েছিল, যাদের অনেকেই আবার সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ইরাকে ফিরে এসেছে।

দু‘দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কও এখন অনেক গভীর।

২০২১ সালে চীনের পর ইরান থেকেই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করেছে ইরাক। এছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য ইরানের ওপর নির্ভরশীলতা তো আছেই। সব মিলিয়ে সাদ্দাম হোসেনের পতন ইরানকে শুধু স্বস্তিই দেয়নি বরং ইরাকের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। আর তেহরান সেটিকেই সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষক মুরাত আসলান।

তিনি বলেন,‘ইরান এখন ইরাকের শিয়া রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে এটি সত্যি। নিরাপত্তা ইস্যুতেও তারাই এখন প্রধান খেলোয়াড়র, এটিও সত্যি।’

ইরাক যুদ্ধে জিতেছে ইরান
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ইরাক ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের, কিন্তু ইরাকে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা এ সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে চাননি আগে।

তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালের ইরানের বিপ্লবের পর থেকে ইরান চাচ্ছিল, ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমুক। সাদ্দাম হোসেন ও ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে যে যুদ্ধ হলো, সেই যুদ্ধ যাদের ক্ষমতায় এনেছে ইরাকে, তারা ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল শুধু নয়, সংশ্লিষ্টও বলা যায়।’

তার মতে কমপক্ষে ১২টি রাজনৈতিক দল ও প্যারা মিলিটারি গোষ্ঠী ইরানের সাথে সংশ্লিষ্ট। তারা ইরাকে থেকে কাজ করলেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখছে ইরানি নেতৃত্বের সাথে।

ইরাক আগ্রাসনের পাঁচ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন নতুন ইরাকের দুই ঘনিষ্ঠ দেশ ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা। তখনকার ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ গিয়েছিলেন বাগদাদে, যা ছিল ৩০ বছরের মধ্যে কোনো শীর্ষ ইরানি নেতার বাগদাদ সফর। এর দু‘সপ্তাহ পরেই যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি বাগদাদ গিয়েছিলেন। কিন্তু ইরানের প্রেসিডেন্ট যেখানে বাগদাদে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন সেখানে মিস্টার চেনিকে যেতে হয়েছিল ব্যাপক নিরাপত্তার মোড়কে আবৃত হয়ে।

এটির কারণ যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সব পক্ষের সাথেই সম্পর্ক রেখেছিল ইরান। শুধু তাই নয় ইরাকের প্রতি তাদের সহযোগিতাও ছিল ব্যাপক। আর দেশটির কৌশলগত ও আর্থিক এসব বিনিয়োগ তাদেরকে ইরাক বিষয়ে আরো প্রভাবশালী করে তোলে। অন্যদিকে এভাবে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ইরানকে ঠেকানোর কৌশল নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের জন্য ছিল খুব কঠিন কাজ। ফলে ইরাকের বাজারে এখন ইরানি পণ্য যেমন ভরপুর তেমনি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমালাতেও দেখা যায় ইরানের প্রতি সহমর্মিতা। নির্মাণ সামগ্রী থেকে শুরু করে নেশাদ্রব্য-সবই আসে ইরান থেকেই।

এমনকি প্রায় পাঁচ হাজার আমেরিকার সেনার জীবন আর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে যুক্তরাষ্ট্র নানা পুনর্গঠন কার্যক্রম চালানোর পরেও শীর্ষ স্তরের ইরাকি নেতাদের বেশিরভাগই ইরানি নেতৃত্বের আশীর্বাদপুষ্ট বলেই মনে করা হয়।

২০১৭ সালেই তাই নিউইয়র্ক টাইমস তার এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘এই প্রতিযোগিতায় ইরান জিতেছে আর যুক্তরাষ্ট্র হেরেছে।’

আলী রীয়াজ বলছেন, ‘ইরাক যুদ্ধের পর সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিবেচনায় ইরানের জন্য একটা বিজয় সূচিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের ফলে ও সাদ্দাম হোসেনের অপসারণের কারণে। এমনকি ইরাকে যে কাঠামো গড়ে উঠেছে সেটিও ইরানের পক্ষেই গেছে।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল