২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আমিরাত-ইসরাইল সম্পর্কে নতুন মাত্রা

আব্রাহাম চুক্তি সই হয় ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিতে - ছবি : সংগৃহীত

তেল আভিভ স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শুরু হয় যে ঘণ্টা বাজিয়ে, মোহাম্মদ আল খাজা সেটির বোতাম চাপলেন, তারপর ঝকঝকে কাচে ঘেরা ভবনটির ভেতর ঝরে পড়তে শুরু করলো হার্টের আকৃতির সোনালি কাগজ।

আল খাজা ইসরাইলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত। তিনি যখন তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান ইটাই বেন-জিভ এবং আবুধাবি গ্লোবাল মার্কেটের চেয়ারম্যান আহমেদ আল জাউবির সাথে করমর্দন করলেন, চারদিক থেকে উল্লাস শোনা গেল।

এটিকে ইসরাইলের প্রধান স্টক মার্কেটের কোনো গতানুগতিক দিনের লেন-দেনের শুরু বলে চিত্রিত করা ভুল হবে। বরং এটিকে বলা যেতে পারে ইসরাইল এবং ইউএই'র মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠছে, সেটির আরো একটি মাইলফলক।

এই দুই দেশের মধ্যে দু'বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এক ঐতিহাসিক আব্রাহাম চুক্তি সই হয়েছিল, যাতে যোগ দিয়েছিল আরেকটি উপসাগরীয় দেশ বাহরাইনও।

এই চুক্তি অনুযায়ী ইউএই এবং বাহরাইন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজি হয়েছিল এবং দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে স্থাপিত হয়েছিল। বহু দশক ধরে ইসরাইলকে বয়কটের যে নীতি এই উপসাগরীয় দেশগুলো অনুসরণ করত, এই চুক্তির মাধ্যমে তার অবসান ঘটল।

ইসরাইল সফরে যাওয়া ইউএই'র প্রতিনিধিদলের একজন ছিলেন আমিরাতি বিনিয়োগকারী সাবাহ আল-বিনালি। তেল আবিবে যখন তিনি এই অনুষ্ঠান দেখছিলেন, তখন তার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল। তিনি একটি ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড 'আওয়ারক্রাউড আরাবিয়ার' নির্বাহী চেয়ারম্যান।

'আমরা এখন যা দেখছি, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে, মধ্যপ্রাচ্যের দুটি প্রাকৃতিক প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আমরা এক দীর্ঘ, গভীর এবং ফলপ্রসূ সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখছি', বলছিলেন তিনি।

আল-বিনালি মনে করেন, ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সবাই লাভবান হবে।

'এখন আমরা লজিস্টিকস, চিকিৎসা প্রযুক্তি, কৃষি প্রযুক্তি এবং সাইবার সিকিউরিটির মতো ক্ষেত্রে যৌথ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। এরকম কিছু বিষয়ে কাজ এরই মধ্যে বেশ এগিয়ে গেছে।'

আল-বিনালি আরো বলছেন, গত মাসের সফরের পর আরো কিছু ব্যবসায়িক চুক্তির ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আব্রাহাম চুক্তির কারণে ইসরাইল এবং ইউএই'র মধ্যে বাণিজ্য যে বহুগুণ বাড়বে, সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা একমত। ইসরাইলের প্রযুক্তি খাত খুবই শক্তিশালী, এর পাশাপাশি সামরিক প্রযুক্তিতেও তারা এগিয়ে। ইউএই আবার উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তাদের অর্থনীতির মূল শক্তি এখনো তেল বেচা অর্থ, কিন্তু তারা এখন অর্থনীতির বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে।

কেতকি শর্মা হচ্ছেন দুবাইর একটি ডেটা এবং অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যালগরিদম রিসার্চের প্রধান নির্বাহী। দুবাই হচ্ছে যে সাতটি আমিরাত নিয়ে ইউএই গঠিত, তার একটি।

তার বিশ্বাস, ইসরাইল এবং ইউএই'র মধ্যে বাণিজ্য আগামী পাঁচ বছরে দশ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

'এই চুক্তি হয়েছিল ২০২০ সালে এবং এরই মধ্যে এটি ইসরাইল এবং ইউএই'র মধ্যে বাণিজ্য অনেক বাড়িয়েছে', বলছেন তিনি।

কেতকি শর্মা জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলছেন, ২০২০ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইসরাইল থেকে ইউএই'তে রফতানি ৭৪ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩৮৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ইউএই থেকে ইসরাইলে রফতানি ১১৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩২ মিলিয়ন ডলারে।

শর্মা বলেন, দুদেশের মধ্যে যেসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার মধ্যে আছে কৃষি, পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি, সাইবার নিরাপত্তা এবং স্মার্ট নগরীর মতো বিষয়।

'এ বছরের শুরুতে দুদেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও সই হয়েছে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে যেসব পণ্যের বাণিজ্য হয় সেগুলোর ৯৬ শতাংশের ওপর থেকে শুল্ক উঠে গেছে।'

আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরাইল অস্ত্র বিক্রির নতুন রেকর্ড করেছে, এমন কথাও শোনা যায়। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে তাদের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ১১৩০ কোটি ডলারে পৌঁছায়, আর এর ৭ শতাংশই ছিল ইউএই ও বাহরাইনে।

ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে ইয়ালোন (২০১৩-২০১৬) বিবিসিকে বলেন, এর কারণ দুই দেশই তাদের অঞ্চলে একই নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে আছে। বিশেষ করে ইরানের কথা উল্লেখ করছেন তিনি।

তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের তীব্র নিন্দা করেছে। তারা অভিযোগ করছে, আরব দেশগুলো ফিলিস্তিন ইস্যুতে আসলে ইসরাইলের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।

উপসাগরীয় অঞ্চলের বাইরে আরেকটি দেশ মরক্কো ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একই ধরণের চুক্তি করে। চুক্তি করেছে সুদানও, তবে তাদের চুক্তির অগ্রগতি থমকে আছে।

ইয়ালোন এখন আবুধাবিভিত্তিক একটি ইসরাইলি কোম্পানি সাইনাপটেকের চেয়ারম্যান। তিনি মনে করেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে এই নতুন সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। তবে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে তিনি এর বিস্তারিত জানাতে রাজি নন। তিনি কেবল এটুকুই বললেন, 'নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতার একটা উপায় আমরা খুঁজে পেয়েছি।'

ইয়ালোন বলছেন, এরকম আরো অনেক সহযোগিতার জায়গা আছে।

উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতারা উপলব্ধি করেছেন যে তাদের তেলের চাইতে আরো বেশি কিছু দরকার, বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তি, মরুভূমিতে করার উপযোগী কৃষি, পানি আহরণ ইত্যাদি। ইসরাইলে আমরা বেশ সৌভাগ্যবান, কারণ এসব প্রযুক্তি আমরা অর্জন করেছি। কাজেই আমাদের অনেক অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে।

জ্বালানি খাতেও ইসরাইল এবং ইউএই'র মধ্যে অনেক চুক্তি সই হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলি কোম্পানি নিউমেড এনার্জি (তখন নাম ছিল ডেলেক ড্রিলিং) ঘোষণা করলো যে তারা ইসরাইলি উপকুলের তামার গ্যাস ক্ষেত্রের ২২ শতাংশ শেয়ার ইউএই'র কোম্পানি মুবাদালা এনার্জির কাছে একশো কোটি ডলারে বিক্রি করে দেবে।

নিউমেড এনার্জির এমন এক ক্রেতা খুঁজে পাওয়া দরকার ছিল, যারা সরকারের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

'মুবাদালার সাথে যে চুক্তি সই হয় সেটি আমাদের আঞ্চলিক ব্যবসাকে আরো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করার যে লক্ষ্য নিয়েছি, এটি তারই অংশ,' বলছেন নিউমেড এর প্রধান নির্বাহী ইউসি আবু।

মাস ওয়াতাদ একজন ফিলিস্তিনি, তবে ইসরাইলি নাগরিক। তিনি আরবি ভাষার একটি ডায়েটিং অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ডসাটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট।

তিনি তার ব্যবসায়িক অংশীদার টালি জিঙ্গারের সাথে মিলে তাদের ব্যবসা উপসাগরীয় অঞ্চলে সম্প্রসারণ করেছেন, আর এটি সম্ভব হয়েছে আব্রাহাম চুক্তির কারণে।

তিনি দাবি করছেন, এই চুক্তিটি পরিস্থিতি একদম বদলে দিয়েছে, কারণ এখন তিনি এবং তার টিম নিয়মিত ইসরাইল এবং ইউএই'র মধ্যে ভ্রমণ করতে পারেন। ওয়াতাদ তার পরিবারকে এখন আবু ধাবিতে নিয়ে এসে সেখানেই বসবাস করছেন।

ইউএই চায় বেশ কিছু বিষয়ে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে থাকতে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা একটি, বলছেন তিনি। আব্রাহাম চুক্তির কারণে তার কোম্পানি এখন পুরো আরব বিশ্বে তার প্রভাব রাখতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।

কেতকি শর্মা বলেন, তিনি আশা করেন উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশও এখন ইসরাইলের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাইবে, কারণ তারা ইউএই'র অভিজ্ঞতা থেকে অনেক অনুকূল ফল দেখতে পাচ্ছেন।

'এটা শুরু মাত্র,' বলছেন তিনি। 'আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ আশাবাদী।'
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement