২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পরমাণু চুক্তি সমঝোতায় কি কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

ইরানের আরাক পরমাণু কেন্দ্র - ছবি : সংগৃহীত

গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত একটি পরমাণু চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় ইরান ও বিশ্বের ক্ষমতাধর কয়েকটি শক্তি আগামী ২৯ নভেম্বর ভিয়েনায় আলোচনায় বসছে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

ইরানের পরমাণু স্থাপনার ওপর সম্ভাব্য হামলার জন্য ইসরাইল তার সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে ইতোমধ্যে ১৫০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ সতর্ক করে দিয়ে বলছে যে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যাপারে তেহরানের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে যা তেহরান সবসময় অস্বীকার করে আসছে।

ইরান বলছে, শক্তিধর বিভিন্ন পক্ষের সাথে স্বাক্ষরিত আগের চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা হলে তারা তাকে স্বাগত জানাবে। ওই চুক্তিতে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জবাবে দেশটির পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে কিছু সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল।

ভিয়েনার আলোচনা সফল হলে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হতে পারে এবং একই সাথে ভবিষ্যতে ইরানের সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরমাণু সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে।

আর যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিপজ্জনক পথে মোড় নিতে পারে।

মূল চুক্তিতে কী আছে?
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তিটি হয়েছিল জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ-যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এবং জার্মানির সাথে। এই পক্ষগুলো পরিচিত ‘পি৫ + ১’ হিসেবে।

এই সমঝোতায় ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ ও মজুদ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। চুক্তি অনুসারে তেহরান তাদের কিছু পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করে দিতে অথবা পরিবর্তন করতে সম্মত হয়। এছাড়াও ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের অনুমতিও দেয়া হয়।

অন্যদিকে ইরানের ওপর আরোপিত অনেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

পি৫+১ বিশ্বাস করেছিল যে এই চুক্তি পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা থেকে ইরানকে প্রতিহত করবে। ইরান এ ধরনের চেষ্টার কথা সবসময় অস্বীকার করেছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা ইরানের বিরুদ্ধে এ ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখার অভিযোগ এনেছে।

ইরান আশা করেছিল যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে তাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

এই সমঝোতার ব্যাপারে দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক আলোচনার পর চুক্তিটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে কার্যকর হয়।

চুক্তিটি কেন ধসে পড়ল?
খুব ছোট্ট করে এর উত্তর হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প।

চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে, কিন্তু নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউজে আসার অনেক আগেই ট্রাম্প পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে তিনি মনে করেন, ‘এটি তার দেখা সবচেয়ে খারাপ চুক্তি।’

তিনি বারবারই এই সমঝোতাকে ‘বীভৎস’ এবং ‘হাস্যকর’ বলে উল্লেখ করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা খুবই দুর্বল। তার মতে এই চুক্তিতে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপরেও বিধি-নিষেধ আরোপ করা উচিত ছিল।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

এর জবাবে ইরান চুক্তিতে বেঁধে দেয়া সীমার চেয়েও অধিক মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে শুরু করে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের সাথে তাদের সহযোগিতা কমিয়ে দেয়।

চুক্তিটি কারা পুনরুজ্জীবিত করতে চায়?
আপাত দৃষ্টিতে চুক্তিটি যারা সই করেছে তাদের প্রত্যেকে এটি ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী।

ইরান কখনো চায়নি এই সমঝোতা বাতিল করা হোক। চায়নি ‘পি৫+১’-এর দেশগুলোও।

একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তারা এই চুক্তিটি বাতিল করতে চেয়েছে।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারাক ওবামার শাসনামলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় চুক্তিটি সমর্থন করেছিলেন।

এছাড়াও ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে চুক্তিটি হওয়ার ব্যাপারে যারা সাহায্য করেছিলেন তাদের বেশিরভাগই এখন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইরান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।

আলোচনা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি? কিছু বাধা বিপত্তি রয়েছে।

চুক্তিটি ভেঙে পড়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্রুদ্ধ ইরান। তারা দেশটিকে একটি ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করছে।

ইরানের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে তাদের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিষয়টি। কিন্তু ওয়াশিংটন চায় ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ বন্ধ করুক।

দুটো দেশই চায় অপরপক্ষ যেন আগে তাদের কাজটি করে। একারণে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইরানের সাথে সরাসরি আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে না।

এছাড়াও ইরান জুন মাসে ইব্রাহিম রাইসিকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সরকারকে আগের সরকারের তুলনায় কট্টরপন্থী বলে মনে করা হয়।

প্রেসিডেন্ট রাইসি বলেছেন যে, তিনি ভিয়েনার আলোচনাকে প্রলম্বিত হতে দেবেন না।

একই সাথে তিনি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও তাদের আঞ্চলিক নীতির ব্যাপারে যেকোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দিয়েছেন। এই নীতির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি ইরানের সমর্থন।

এসব কারণে চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করার কাজ কিছুটা কঠিন হতে পারে।

চুক্তিটি ফিরে এলে সবাই কি খুশি হবে?
ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র সৌদি আরব সতর্কতার সাথে পুরনো চুক্তিটিকে সমর্থন করেছিল। তবে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে যাকে মনে করা হয়, যদিও এটি কখনো নিশ্চিত করা হয়নি, সেই ইসরাইল আসল চুক্তিটির বড় সমালোচক।

তারা মনে করে যে ওই চুক্তি সত্ত্বেও ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার দিকে অগ্রসর হতে পারে।

ইসরাইল এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের আরো দুটো দেশের পরমাণু স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে।

ইসরাইল বলছে, ইরানকে তারা কখনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement