১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইরানে ভয়াবহ পানি সঙ্কট, কেন এই হাহাকার?

ইরানে ভয়াবহ পানি সঙ্কট, কেন এই হাহাকার? - ছবি : সংগৃহীত

ইরানে পানি ও বিদ্যুতের তীব্র সঙ্কট নিয়ে সম্প্রতি বেশ কিছু অসন্তোষ ও প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি গত মাসের শেষের দিকের এই বিক্ষোভে সাধারণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগও রয়েছে। এ ঘটনায় চালানো গুলিতে একজন বিক্ষোভকারী নিহতও হয়েছে।

এই সঙ্কটের জেরে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির বিভিন্ন শহরে।

বিশেষজ্ঞরা ইরানের পানি পরিস্থিতি নিয়ে বহু বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। তাহলে পরিস্থিতি এই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছল কেন ও কিভাবে?

অতি শুষ্ক বছর
এপ্রিল মাসে ইরানের আবহাওয়া দফতর ‘নজিরবিহীন খরা’ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয় এবং জানায় যে দীর্ঘ মেয়াদে গড়পড়তা বৃষ্টিপাতের হারের থেকে বৃষ্টি হয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম।

খুজেস্তান প্রদেশ, যেটি তেল উৎপাদনকারী এলাকা, সেখানকার বাসিন্দারা পানির সঙ্কট নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পথে নামে। অন্যান্য শহরগুলোতে বিক্ষোভ হয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তৈরি বিদ্যুতের সরবরাহ হ্রাসের বিরুদ্ধে।

সরকার সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়া এলাকাগুলোয় জরুরি সহায়তা পাঠায়।

ইরান এখন অতিরিক্ত তাপমাত্রা, দূষণ, বন্যা এবং হ্রদ নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়ার মতো বিশাল পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। রয়েছে আরো নানা চ্যালেঞ্জ।

কিভাবে শুকিয়ে গেছে উরমিয়া হ্রদ তার ছবি

১৯৯৪ থেকে ২০২০-এর মধ্যে হ্রদের পানি যেভাবে শুকিয়ে গেছে

দেশটির জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশটির প্রধান নদী অববাহিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে ২০২০-এর সেপ্টেম্বর আর চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা ছিল গত বছর একই সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম।

ইরানে বৃষ্টিপাতের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত সরকারি সূত্র থেকে বিবিসি পায়নি, তবে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা উপগ্রহ চিত্র থেকে বৃষ্টিপাতের উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।

এই তথ্যউপাত্ত থেকে গত ৪০ বছরের গড় বৃষ্টিপাতের হারের বিপরীতে গত মার্চ পর্যন্ত দেশটিতে বৃষ্টিপাতের হারের তুলনা করা হয়েছে - যা তুলে ধরা হয়েছে নিচের গ্রাফে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আরভিনের সেন্টার ফর হাইড্রোমেটেরিওলজি বিভাগের এই তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ইরানে বৃষ্টিপাত হয়েছে গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় অনেক কম।

ইরানে কী পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে মিলিমিটারে তার হিসাব

সূত্র : সেন্টার ফর হাইড্রোমেটেরিওলজি, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আরভিন

ইরানে ৪০ বছরের গত বৃষ্টিপাতের তুলনায় ২০২০ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের হার ১৯৮৩ সালের পর জানুয়ারি ছিল সবচেয়ে শুষ্ক মাস মার্চ মাস ছিল সবচেয়ে শুকনো মাসগুলোর একটি নভেম্বর মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, তবে অক্টোবর ছিল গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শুষ্ক মাস জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ইরানে যেসব গমের ক্ষেতের ফলন খুবই মূল্যবান, তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ অনাবৃষ্টিতে সেচের সমস্যায় পড়বে। যার জন্য ইরানে কৃষি কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে পারে।

‘আমি তৃষ্ণার্ত’
খুজেস্তান প্রদেশে চলছে তীব্র খরা। খরায় বিপর্যস্ত স্থানীয় মানুষ পথে নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে- অনেকের কণ্ঠে স্লোগান ছিল ‘আমি তৃষ্ণার্ত!’

এই অঞ্চলে আগে পানির কোনো অভাব ছিল না। ওই প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কারুন নদীতে প্রচুর পানি ছিল। এখন সেই নদী বেশিরভাগ সময়ই শুকনো।

উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, এই নদীর পানি গত বছর ক্রমান্বয়ে কমেছে। জার্মানির স্টুটগার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগৃহীত তথ্য উপাত্তে খুজেস্তানের খরার এই চিত্র দেখা গেছে।

সেখানে নদীপ্রবাহে ২০১৯ সালে একটা স্ফীতি দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তার কারণ ছিল ব্যাপক বন্যা।

খুজেস্তান প্রদেশের এই সরকারি মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালের জুলাই মাসে এলাকার বাঁধগুলোতে পানির মাত্রা কতটা। হালকা নীল রং-এ আঁকা রেখা পানির মাত্রা কোথায় তা ইঙ্গিত করছে।

বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ বাঁধে বর্তমানে পানির স্তর খুবই নিচে নেমে গেছে। এই বাঁধগুলোর নিচের এলাকায় ধান চাষ ও গবাদি পশুর জন্য সংরক্ষিত পানি ছেড়ে দেয়ার জন্য দাবি ক্রমেই বাড়ছে।

সরকারি মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে খুজেস্তান প্রদেশের বাঁধগুলোতে পানির মাত্রা

 

পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে গেল কিভাবে?
কেউ কেউ বলছে এর জন্য দায়ী তেল উৎপাদন শিল্প। তাদের যুক্তি পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাহত হয়েছে তেল উৎপাদন শিল্পের জন্য।

অনেকে বলছে বর্তমানের খরা পীড়িত এই এলাকাগুলো থেকে দেশটির মধ্যাঞ্চলে মরু এলাকায় পানি টেনে নেয়ার কারণে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে।

ইরানের পরিবেশ দফতরের সাবেক উপ-প্রধান কাভে মাদানি। বর্তমানে তিনি কাজ করেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তন এবং খরা এই পরিস্থিতির প্রধান অনুঘটক। তবে সমস্যার শিকড় আরো অনেক গভীরে। কয়েক দশক ধরে অপরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা ও দূরদৃষ্টির অভাব এবং এরকম একটা পরিস্থিতি যে হতে পারে তার জন্য কোনোরকম আগাম প্রস্তুতি না রাখা এখন পরিস্থিতিকে এরকম ভয়াবহ করে তুলেছে।

পানি সঙ্কট আরো গুরুতর হয়ে উঠছে
ইরানে পানি সরবরাহের স্বল্পতা ক্রমশই গুরুতর হচ্ছে, যা দেশটির জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।

ইরানে প্রায়ই খরা হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন দেশটির আবহাওয়ায় চরম পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়ায় অতিমাত্রায় বদল ঘটছে।

আবহাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ ও শুষ্ক হয়ে ওঠায় জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর এর বড়ধরনের প্রভাব পড়ছে।

এ বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ইরানে তীব্র বিদ্যুৎ সঙ্কট দেখা গেছে। অনেক সময় শহরগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকারে ডুবে থেকেছে।

গত মাসের শুরুতেই তেহরান, শিরাজ এবং ইরানের অন্যান্য শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে মানুষকে চিৎকার করে বলতে শোনা গেছে ‘স্বৈরশাসকের মৃত্যু চাই’ এবং ‘খামেনির মৃত্যু চাই’।

সরকার বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য তীব্র খরা ও উচ্চ চাহিদার দোহাই দিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছে।

সেসময় প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি টেলিভিশনে বলেছেন, খরার কারণে দেশের বেশিরভাগ জলবিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রগুলো কাজ করছে না।

প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে এয়ারকন্ডিশনিং-এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর বাড়তি চাপ জ্বালানি সরবরাহ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।

দীর্ঘ মেয়াদী পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা
খরার কারণে ইরানে পরিবেশগত বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইরানের পানি সঙ্কটের পেছনে অন্য কারণও রয়েছে।

একজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ২০১৫ সালে সতর্ক করে দিয়েছিলেন ইরান যদি তার পানি সঙ্কট সমাধান না করে, তাহলে লাখ লাখ ইরানি গণহারে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে।

ইরানের পরিবেশ বিভাগের প্রধান মাসুমে এবতেকার পানি সমস্যা সমাধান করতে ‘কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লবের’ আহ্বান জানিয়েছেন।

লবণাক্ততা ও শহর বসে যাওয়ার সমস্যা
ভূপৃষ্ঠের নিচে শিলাস্তরে পানি জমা থাকে। ইরানে পানির একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস এই সঞ্চিত জলাধার।

কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে এই সঞ্চিত পানির স্তর বিপদজনকভাবে নেমে গেছে। বিশ্বের যেসব দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে গেছে তার মধ্যে ইরান ছাড়াও রয়েছে ভারত, আমেরিকা, সৌদি আরব আর চীন।

জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যে স্বয়ংনির্ভরতার জন্য কৃষকরা ভূগর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণে ব্যবহার করছে।

ভূগর্ভস্থ পানি পাম্প করে বের করে নেয়া হচ্ছে বেশি মাত্রায়- সেটা আবার ভর্তি হওয়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন তার তুলনায় বেশি পানি তুলে নেয়া হচ্ছে। ফলে মাটি লবণাক্ত হয়ে পড়ছে বেশি। এর কারণে অনেক এলাকায় জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে।

ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এর ফলে বহু এলাকায় সেচের পানিতে ‘লবণাক্ততার উচ্চ ঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নেমে যাওয়ায় পানির জন্য মাটির আরো গভীরে খনন চালানোয় শহরগুলো বসে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

হ্রদ নিশ্চিহ্ণ আর বিপদজনক ধূলি ঝড়
এছাড়াও ইরানে আরেকটা বড় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দেশটির জলাভূমি এবং নদীনালা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে। এর ফলে দেশটিতে বিপদজনক ধুলা ঝড় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

উরমিয়া হ্রদ একসময় ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নোনাপানির হ্রদ। এটি এখন বিশাল পরিবেশগত ঝুঁকির একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। এক সময় এই হ্রদের আয়তন ছিল ১ হাজার ৯৩০ বর্গমাইল। ২০১৫ সাল নাগাদ এই হ্রদের এক দশমাংশ পানি শুকিয়ে গেছে।

এলাকায় কৃষিকাজের যে ব্যাপক ও দ্রুত বিস্তার ঘটেছে তা সামাল দিতে এবং ১৯৯০-এর দশকের খরার কারণে কৃষকরা তাদের চাষের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাপক পরিমাণে তুলে নিয়েছে। এছাড়াও এলাকায় তৈরি হয়েছে অসংখ্য বাঁধ।

এই হ্রদ রক্ষার জন্য জনগণের বিক্ষোভের কারণে প্রেসিডেন্ট এই হ্রদটি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেচের কাজেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, ফলে এদিকে কিছুটা অগ্রগতি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

তবে হ্রদের আপাতদৃষ্টিতে সামান্য উন্নতি সংস্কারের কারণে নাকি ২০১৯-এর আকস্মিক বন্যার কারণে - তা এখনো স্পষ্ট নয়।

আবার প্রলম্বিত খরা দেখা দিলে এই হ্রদের ভবিষ্যত আবার যে ঝুঁকির মুখে পড়বে না, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement