১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্গম পাহাড়ি গুহায় ওসামা বিন লাদেনের সাথে এক রাতের অভিজ্ঞতা!

- ছবি- সংগৃহীত

আল কায়দা নেতা ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সন্ত্রাসী হামলার হোতা ওসামা বিন লাদেনকে ২০১১ সালের মে মাসে মার্কিন সৈন্যরা হত্যা করে। বিন লাদেনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল, এই ব্যক্তি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের পেছনে অর্থের যোগান দিচ্ছেন। কিন্তু তখনো লোকজন তার সম্পর্কে খুব কমই জেনেছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার কারণেই সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

হামলার আগে সৌদি বংশোদ্ভূত এই ধনকুবের বছরের পর বছর কাটিয়েছেন আফগানিস্তানে। ওই সময় তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ফিলিস্তিনি এক সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ান।

ওসামা বিন লাদেনের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণেই তার সাথে দেখা করতে লন্ডন থেকে আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি গুহায় ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে লুকিয়ে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন।

সাক্ষাৎকারের আমন্ত্রণ
ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের। সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ান বলছেন, লন্ডনের অফিসে বসে কাজ করছিলেন তিনি। এমন সময় এক ব্যক্তি তার সাথে দেখা করতে আসেন। তখনো তিনি জানতেন না যে লোকটি তার কাছে ওসামা বিন লাদেনের আমন্ত্রণ নিয়ে এসেছেন। তিনি তখন ব্রিটেন-ভিত্তিক প্যান আরব দৈনিক পত্রিকা আল কুদস আল আরাবির প্রধান সম্পাদক।

আবদেল বারি আতওয়ান বলেন, বিশালাকৃতির একজন মানুষ। পরনে ছিল সৌদি পোশাক। মাথায় পাগড়ি। মুখে বড় বড় দাড়ি। বেশ মোটা। তিনি আমার অফিসে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কি ওসামা বিন লাদেনের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান?

ওসামা বিন লাদেনের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে তার পক্ষে ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। তিনি বলেন, এরকম একটি আমন্ত্রণ পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ভাবলাম আমি কি যাবো? সেখানে যাওয়া তো বেশ বিপদজনক হতে পারে। আমার বয়স তখন চল্লিশের ঘরে। আবার যদি তাকে না করে দেই তাহলে মনে হবে যে আমি ভীতু। তখন আমি তাকে হ্যাঁ বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে সেটা ছিল খুব নরমভাবে হ্যাঁ বলা। আমি যে খুব স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে হ্যাঁ বলেছি, ঠিক তা নয়।

এরপর পরই তিনি আফগানিস্তানের যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। ব্যাগের ভেতরে নিলেন কিছু গরম কাপড়। কারণ ওসামা বিন লাদেন যে আফগান-পাকিস্তান সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় থাকতেন তা জানতেন তিনি।

দুর্গম গুহার পথে
পাকিস্তানের যে ব্যক্তির সাথে আবদেল বারি আতওয়ানের যোগাযোগ ছিল তিনি তাকে কিছু আফগান কাপড় দিলেন। চোরা পথে সীমান্ত পার হয়ে তিনি একটি গাড়িতে গিয়ে উঠলেন, যাতে অপরিচিত বেশ কিছু লোক বসেছিল। তাদের হাতে ছিল কালাশনিকভ রাইফেল। এরপর তারা অগ্রসর হতে লাগলেন দক্ষিণের তোরা বোরা পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে গাড়ি যতই ওপরে উঠতে লাগল আবদেল বারি আতওয়ান ততই নার্ভাস হয়ে গেলেন।

তিনি বলেন, আমরা যখন পাহাড়ের ওপরে উঠলাম, মনে হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার মিটার ওপরে। তখন হঠাৎ করেই দেখলাম বড় বড় পাথর পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। তারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেল। শুধু আমি ছিলাম গাড়িতে। তারা রাস্তার ওপর থেকে ভারী ভারী পাথর সরাতে শুরু করল। আমি শুনতে পেলাম তারা বলাবলি করছে যে ওপর থেকে হয়তো আরো পাথর গড়িয়ে পড়তে পারে।

আবদেল বারি আতওয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী, আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম কী হয়েছে? তারা বলল, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমি জানো গত সপ্তাহে আবু ওমর, আবু মোহাম্মদ, আবু হাফস- তারা এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন হঠাৎ করেই ওপর থেকে গড়িয়ে পড়া একটা পাথর এসে তাদের গাড়িতে ধাক্কা মারল, তাদের সবাই মারা গেল।

‘তারা শহীদ হয়েছেন। এখন তারা বেহেশতে। আমাদের জীবনেও যদি এরকম কিছু ঘটে আমরাও খুব খুশি হবো। আমরাও তাদের পথ ধরে বেহেশতে যেতে পারবো। কিন্তু আমি তো তখনো তরুণ। আমার সন্তানদের ফেলে আমি এখনই স্বর্গে যেতে চাই না। যেতে চাই, কিন্তু এখন না। আরো পরে যেতে চাই। আমি তো তাদেরকে আমার মনের কথা বলতে পারিনি। তবে সত্যিই আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই,’ বলেন আতওয়ান।

লম্বা দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি
আবদেল বারি আতওয়ানকে নিয়ে তারা যখন গুহায় গিয়ে পৌঁছাল তখন মাঝ রাত। সেখানে পৌঁছে খুব লম্বা এক ব্যক্তির দেখা পেলেন তিনি। তার মুখে দাড়ি। তিনি ওসামা বিন লাদেন।

‘আরব সংস্কৃতি অনুসারে তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, গুহার ভেতরে যেতে। গুহাটি বেশ গরম ছিল। দু’টি ঘর। একটা বসার। সেখানে ছিল প্রচুর ইসলামি গ্রন্থ, কুরানের ব্যাখ্যা দেয়া বই। লোকজন বসেছিল মেঝের ওপর। ওসামা বিন লাদেনও সেখানে বসলেন। একটা বন্দুক ছিল তার কোলের ওপর। তারা আমাকে খুব মিষ্টি চা খেতে দিল।’

আবদেল বারি আতওয়ান আরো বলেন, হঠাৎ করেই গুহার বাইরে প্রচুর গুলির শব্দ হতে লাগলো- রকেট পড়ার শব্দ, বিমান বিধ্বংসী বন্দুক দিয়ে গুলি করার শব্দ। মনে হচ্ছিল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সবাই তার কালাশনিকভটি ধরল ও গুহার বাইরে চলে গেল। ওসামা বিন লাদেনও তাদের সাথে বাইরে চলে গেলেন। আমি তখন গুহার ভেতরে একা।

প্রায় ২০ মিনিট পর তারা সবাই গুহায় ফিরে এল। ভেতরে প্রচণ্ড নিরবতা। আবদেল বারি আতওয়ান তখন ভয় পেয়ে গেছেন। ওসামা বিন লাদেন তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, আমাদের এটা করতে হয়েছে। কারণ কেউ যদি আপনাকে অনুসরণ করে থাকে। তিনি বললেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের সময়, যখন আপনি তার অংশ ছিলেন, তখনকার দিনগুলো যেরকম ছিল, সেটা আমরা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি।

আবদেল বারি আতওয়ান বলেন, আমি তাকে বললাম, আমি তো কখনো পিএলওর হয়ে যুদ্ধ করিনি। অন্য কোনো ফিলিস্তিনি সংগঠনের সাথেও আমি কখনো জড়িত ছিলাম না। আমি একজন ফাইভ স্টার সাংবাদিক- হিলটন, শেরাটন হোটেলে থেকেছি। আমার মনে হয়, আপনারা একজন ভুল মানুষকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি হাসলেন। তারপর আমরা কিছুক্ষণ গল্প করলাম।

এর ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর আবার একই ঘটনা ঘটল। তখন সবাই গুহা ছেড়ে চলে যেতে চাইল। সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ান তাদেরকে বললেন, কেউ একজন তার সাথে থাকার জন্য। ওসামা বিন লাদেন তখন তার সাথে গুহার ভেতরে থেকে গেলেন।

‘আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু আমার প্রতি তিনি বেশ দয়া প্রদর্শন করেছেন। তিনি বেশ আতিথ্য দেখিয়েছেন। আমি যে একটি সশস্ত্র সংগঠনের খুব নিষ্ঠুর এক নেতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তা তিনি আমাকে একটুও বুঝতে দেননি। তিনি খুব মৃদুভাষী ছিলেন। বেশ বিনয়ী। একেবারে সাধারণ মানুষের মতো,’ বলেন আবদেল বারি আতওয়ান।

রাতের আহারে যা ছিল
এরপর তাদেরকে রাতের খাবার পরিবেশন করা হলো। কিন্তু একজন সৌদি ধনকুবেরের সাথে তিনি কী ধরনের খাবার খেতে পারেন এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না।

আবদেল বারি আতওয়ান বলেন, আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম। খাবার হিসেবে যা দেয়া হলো তার মধ্যে ছিল পচে যাওয়া চিজ, বেশ লবণাক্ত। পচা গন্ধ আসছিল। সাথে ডিম ভাজা। আলু ভাজা। আলুগুলো ছিল নরম। তেল ছিল না। ভেবে দেখুন- লন্ডন থেকে যাওয়া একজন সাংবাদিক, যে তার ব্লাড প্রেশার ও কোলেস্টরেল নিয়ে চিন্তিত তাকে কি না এসব খাবার খেতে দেয়া হয়েছে!

সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু হয় রাত ২টায়। তিনি সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা নিষেধ করল। বলল, রেকর্ড করা যাবে না, লেখা যাবে।

আবদেল বারি আতওয়ান বলেন, আমার জন্য এটা খুব বোরিং ছিল। যেন একটা শিশুকে ক্লাসে কেউ ডিকটেশন দিচ্ছে আর আমি লিখে যাচ্ছি। তিনি যে উত্তর দিচ্ছিলেন সেটাই লিখে রাখছিলাম। আমি তাদের কথা শুনছিলাম। আমি কোনো সমস্যা তৈরি করতে চাইনি। কারণ তারা তো আমার সাথে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারতো।

কেমন ছিল সেই গুহা?
সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষ হলে আবদেল বারি আতওয়ান বিছানায় চলে গেলেন। কিন্তু ঘুমাতে পারলেন না। তার বর্ণনায়, তারা আমাকে একজন অতিথির সম্মান দিচ্ছিল। সেখানে ওসামা বিন লাদেনও ঘুমাচ্ছিলেন। দু’টি বিছানা ছিল। তিনি একটিতে ঘুমাচ্ছিলেন। আমি অন্যটিতে। এটা ঠিক বিছানা ছিল না। ছিল গাছের কিছু ডালপালা দিয়ে বানানো একটি বিছানার মতো। একটি ম্যাট্রেসও ছিল। মনে হচ্ছিল, হাজার হাজার বছর ধরে ওটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যখনই আমি বিছানায় পাশ ফিরছিলাম টের পাচ্ছিলাম যে আমার পিঠে কিছু একটা লাগছে।

তিনি বলেন, কাঠির মতো কিছু একটা। হাত দিয়ে টেনে দেখলাম সেটা একটা বন্দুক। তারপর দেখলাম একটা বক্স। সেটা ভর্তি ছিল হ্যান্ড গ্রেনেড। আমি অস্ত্রশস্ত্রের ওপর শুয়েছিলাম। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। যদি ঘুমিয়েও থাকি, আমি হয়তো আধা ঘণ্টা বা ৪০ মিনিটের মতো ঘুমিয়েছিলাম।

আবদেল বারি আতওয়ান খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেলেন। ফজরের নামাজে ইমামতি করলেন ওসামা বিন লাদেন। সাংবাদিক আবদেল বারি দাঁড়িয়েছিলেন পেছনের একটি কাতারে। এক সময় তার সেখান থেকে চলে আসার সময় হলো। তিনি লন্ডনে ফিরে এলেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো।

এর পাঁচ বছর পর ২০০১ সালের মে ও অক্টোবর মাসে তাকে আবারো ওসামা বিন লাদেনের সাথে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দু'বারই তিনি সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল