২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ওয়াশিংটন-তেহরান আলোচনায় পরমাণু কেন্দ্রে নাশকতার ঘটনার কালো ছায়া

আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে ভিয়েনায় আলোচনা শুরু হয়েছে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে - ছবি : সংগৃহীত

ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে ২০১৫ সালের চুক্তিতে আমেরিকা ও ইরানকে আবার ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বুধবার যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শুরু হয়েছে, তার ওপর এখন কালো ছায়া বিস্তার করে রেখেছে ইরান আর ইসরাইলের মধ্যে চলা প্রচ্ছন্ন যুদ্ধ।

ইরানে নাতাঞ্জের কাছে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু কেন্দ্রে নাশকতামূলক হামলার ঘটনার তিন দিন পর এই আলোচনা শুরু হলো। ওই কেন্দ্রে একটি বিস্ফোরণে গোটা কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

হামলার ফলে অজ্ঞাত সংখ্যক অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সেন্ট্রিফিউজগুলো খুবই আধুনিক ও উন্নতমানের যন্ত্র যেগুলো দিয়ে ইউরেনিয়াম পরিশোধন করে তা পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। এই ঘটনায় কেন্দ্রটি বর্তমানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

ঘটনার এক দিন আগে, প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ওই কেন্দ্রে একটি সেন্ট্রিফিউজ তৈরির কারখানার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এটির উদ্দেশ্য ছিল খুব দ্রুত কাজ করতে সক্ষম এমন সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্র তৈরি করা। পুরনো সেন্ট্রিফিউজ কারখানাটি গত বছর জুলাই মাসে অজ্ঞাত ‘শত্রুরা’ রহস্যজনকভাবে উড়িয়ে দিয়েছিল।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে ফিরে গেলে সেটা তার দেশের জন্য অস্তিত্বের সঙ্কট হয়ে দাঁড়াবে।

ইরান ইসরাইলকে তার চির শত্রু বলে মনে করে।

গত সপ্তাহে ইহুদি হত্যার বার্ষিকী উপলক্ষে হলোকস্ট স্মরণ দিবসের প্রাক্কালে এক ভাষণে নেতানিয়াহু বলেন, ইসরাইল তার নিজের ক্ষমতা দিয়ে তার দেশকে রক্ষা করবে।

ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে সর্ব-সাম্প্রতিক নাশকতার হামলাকে ইরান ‘পারমাণিক সন্ত্রাস’ বলে বর্ণনা করেছে এবং এর জন্য দায়ী করেছে ইসরাইলকে।

ভিয়েনার বৈঠকে এই ঘটনা সব পক্ষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি এবং এই আলোচনার ফলাফল যেটাই হোক, তাতে শুধু ইরান সন্তুষ্ট হলেই হবে না, আমেরিকা, বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর দেশকেও সন্তুষ্ট হতে হবে। আর সেইসাথে ইসরাইল এবং ইরানের প্রতিবেশী দেশগুলোকেও পাশে পেতে হবে।

ইরান এই আলোচনায় দর কষাকষির একটা হাতিয়ার হিসাবে তাদের পরমাণু কর্মসূচি দ্রুত প্রসারিত করার যে কৌশল নিয়ে এগোচ্ছিল নাতাঞ্জের এই হামলা তাতে একটা ধাক্কা মেরেছে।

নাতাঞ্জের নাশকতার ঘটনার পর ইরান ঘোষণা করেছে যে তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেবে।

তারা ইউরেনিয়াম পরিশোধন করে তার বিশুদ্ধতা ৬০% শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করবে, যা পরিশোধনের খুবই চড়া মাত্রা। পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে হলে ইউরেনিয়ামকে ৯০% বিশুদ্ধ করতে হয়।

এই প্রক্রিয়ায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তার আরো কাছাকাছি পৌঁছালেও ইরান বলেছে তারা সেটা করতে চাইছে না।

কিন্তু ইরানের এই ঘোষণায় ভিয়েনার আলোচনা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কারণ ইরান সেটা করলে পারমাণবিক কার্যক্রম বিস্তারের বড় রকমের ঝুঁকি তৈরি হবে, যেটা এমনকী ইরানের মিত্র দেশ চীন এবং রাশিয়াও মেনে নেবে না।

ভিয়েনার বৈঠকের লক্ষ্য হলো ২০১৫ সালের চুক্তির শর্তগুলো মানতে ইরান এবং আমেরিকাকে আবার রাজি করানো।

ওই চুক্তি অনুযায়ী ইরানকে তার পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়ানোর কর্মসূচি বন্ধ করতে হবে এবং আমেরিকাকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে, যার কারণে ইরানের অর্থনীতির চাকা থেমে গেছে।

ইরানের প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ এই স্থবির অর্থনীতির চাপে কঠিন অবস্থার মুখে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি
আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে পরোক্ষভাবে। ইইউর সভাপতিত্বে এই বৈঠক হচ্ছে এবং এই আলোচনায় আছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া এবং চীন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কঠোর নির্দেশ আছে আমেরিকার সাথে মুখোমুখি বৈঠক করা যাবে না।

ইরান ও আমেরিকার প্রতিনিধিরা আছেন একই রাস্তার ওপরে দুটি আলাদা হোটেলে। তাদের হোটেলের দূরত্ব প্রায় ১০০ মিটার। ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপ-প্রধান দুই পক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা চালাচালি করছেন।

আমেরিকান কর্মকর্তারা বলছেন, এক পক্ষের বার্তা আরেক পক্ষের কাছে এভাবে পৌঁছে দেয়ার কারণে মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। আমেরিকা মুখোমুখি আলোচনার পক্ষে।

মূল সমস্যা
গত সপ্তাহে সব পক্ষই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দুটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে রাজি হয়, যে কমিটি ঠিক করবে ২০১৫ সালে সম্পাদিত চুক্তি মেনে চলতে সম্মত হবার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানকে ঠিক কী কী করতে হবে।

সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন এবং এর পর থেকে ইরান এই চুক্তির বিভিন্ন শর্ত লংঘন শুরু করে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বলেছে, তারা এই চুক্তিতে ফিরতে আগ্রহী এবং এই চুক্তির আওতায় ইরানকে তার পরমাণু কার্যকলাপ সীমিত করার ব্যাপারে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিল, ইরান সেগুলো পুরোপুরি মানতে শুরু করলে এ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাগুলো আমেরিকা তুলে নেবে।

কিন্তু ইরানের বক্তব্য হলো (যেটা বলেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা), আমেরিকা সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে সেটা সত্যায়িত করার পরই তারা এই চুক্তির শর্তগুলো মানতে রাজি হবে।

নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুই পক্ষ
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে সরে আসার পর ইরানের ওপর দেড় হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই পারমাণবিক কার্যক্রম সংক্রান্ত।

ইরান জোর দিয়ে বলছে বিভিন্ন শিরোনামে আমেরিকা এসব নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও এর অধিকাংশই তাদের পরমাণু কর্মসূচির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং সেগুলো বাতিল করতে হবে।

ইরান চুক্তির শর্ত লংঘন করছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সে সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, এগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো সময়ই লাগবে না।

তিনি বলেছেন, এগুলো ঠিক করতে কিছু স্ক্রু একটু ঢিলা করতে হবে, কিছু স্ক্রু আরেকটু শক্ত করতে হবে!

তবে বিষয়টা যে এর থেকে অনেকটাই বেশি জটিল, সেটা স্পষ্ট। ইরানের অ্যাটমিক এনার্জি অরগানাইজেশনের প্রধান আলি আকবর সালেহি বলেছেন, প্রক্রিয়াকে শর্ত মোতাবেক করতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।

‘চূড়ান্ত সময়সীমা’ ফুরিয়ে আসছে?
এর পরে রয়েছে ২০১৫ সালে এই চুক্তি সই করার ছয় বছর পর এখনো তা আগের মতোই সার্বিকভাবে কার্যকর রয়েছে কিনা। জাতিসঙ্ঘ আণবিক শক্তি সংস্থা- আইএইএ বলছে, গত ছয় বছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে।

‘আমার মনে হয় না তারা বলবে- ঠিক আছে আগের চুক্তিতে ফেরা যাক। কারণ আগের পরিস্থিতি বদলেছে,’ বলছেন আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি।

গত দুই বছরে ইরান উন্নত মানের নতুন সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্র তৈরি করেছে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে এবং সেগুলো কেন্দ্রে বসিয়েছে। ২০১৫ সালের চুক্তিতে যেসব সীমাবদ্ধতার শর্ত বেঁধে দেয়া হয়েছিল, এর ফলে সেই অঙ্ক এখন বদলে গেছে।

তেহরান এবং ওয়াশিংটনে মনে করা হচ্ছে ইরানে নতুন যে সরকার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে তার সাথে এই পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে সমাধান আরো অনেক বেশি কঠিন হবে।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি যেভাবে দ্রুততার সাথে ভিয়েনার আলোচনায় ইরানের অংশগ্রহণে উৎসাহ দেখিয়েছেন তাতে উদ্বিগ্ন তেহরানের কট্টরপন্থীরা। তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট রুহানি ইরানের পারমাণবিক অর্জনকে আবার বিক্রি করে দিতে চলেছেন।

তবে ভিয়েনার এই আলোচনা প্রক্রিয়া শুরুর আগে প্রেসিডেন্ট রুহানি স্পষ্ট বলেছেন, তার দেশের ওপর আমেরিকার জারি করা নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেয়াকে আগামী চার মাসে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবেন।

তার সরকার ক্ষমতায় আছে আরো চার মাস। ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ১৮ জুন অনুষ্ঠিত হবার কথা এবং নতুন সরকারের হাতে প্রেসিডেন্ট রুহানি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন ৫ আগস্ট নাগাদ।

ফলে এই আলোচনাকে ফলপ্রসূ করার জন্য একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়ছে।

আসন্ন নির্বাচনে কট্টরপন্থী একজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসবেন এমন লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ঠিক ২০১৫ সালের মতই রেভুল্যশনারি গার্ডের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ সাবেক বা বর্তমান কোনো প্রার্থী ইরানের আগামী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

ইরান পারমাণবিক সঙ্কট : মূল বিষয়গুলো
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো ইরানকে বিশ্বাস করে না : কিছু দেশ মনে করে ইরান পরমাণু শক্তি অর্জন করতে চায় কারণ তারা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে আগ্রহী। ইরান সেটা অস্বীকার করে।

ফলে একটা চুক্তি হয় : ২০১৫ সালে ইরান এবং ছয়টি দেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে সম্মত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইরান তাদের কিছু পরমাণু কার্যক্রম বন্ধ করবে। তার পরিবর্তে ইরানের ওপর চাপানো কড়া শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। এসব নিষেধাজ্ঞা দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস করছিল।

এখন সমস্যা কোথায়? আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর ইরান নিষিদ্ধ এসব পারমাণবিক কার্যক্রম আবার চালু করে এবং ইরানের ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই চুক্তিতে আবার ফিরে আসতে চান, কিন্তু দুই পক্ষই চাইছে, অন্য পক্ষকে আগে এগোতে হবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement