২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাবা হত্যাকাণ্ডের অর্ধযুগ : স্বামী-সন্তানহারা এক নারীর দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা

মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তাণ্ডবের একটি ছবি। ইনসেটে সানা আবদুল জাওয়াদ এবং তার মেয়ে আসমা বেলতাগি - ছবি : সংগৃহীত

চারদিক থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যখন অগ্রসর হচ্ছিল তখন সানা আবদুল জাওয়াদ এবং তার মেয়ে আসমা বেলতাগি রাবা চত্বরের মূল মঞ্চের সামনে ছিলেন। গোটা এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। ফলে সানা এবং আসমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
সানা বলেন, ‘আমি তোয়ালে দিয়ে তার মুখ মুছছিলাম এবং তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। সেও আমার সাথে একই কাজ করছিল’। নিজের জীবদ্দশায় ছয় বছর আগে রাষ্ট্র কর্তৃক নিকৃষ্টতম গণহত্যা ও রক্তপাতের কথা স্মরণ করে সেই দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন সানা। 

সানা এখনো সেই রক্তের গন্ধ পান যখন তার চোখের সামনে ট্যাংক এবং বুলডোজার বিক্ষোভকারীদের শিবিরগুলোকে পিষ্ট করছিল এবং বিক্ষোভকারীরা ভেতরে থাকা অবস্থাতেই নিরাপত্তাবাহিনী তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। চারদিক থেকে অবিরাম গুলি চালানো হচ্ছিল। সানা বলেন, ‘প্রতিবাদকারীদের লাশগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ধোঁয়া এতটাই ছেয়ে গিয়েছিল যে আমরা কোনোমতে লাশগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। এমন বিভীষিকাময় মুহূর্তে আহতদের সাহায্যে মাঠের হাসপাতালে যেতে মায়ের অনুমতি চায় আসমা। সানা সে মুহূর্তের স্মৃতি চারণ করে বলেন, ‘আমি তার আবদার অস্বীকার করলাম’ ‘আমি তীব্র গোলাগুলির মধ্যে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার বারণ শোনেনি, ‘একরকম জোর করেই আহতদের সাহায্যে ছুটে চলে গিয়েছিল। আহতদের সাহায্য না করে তাদের করুণ অবস্থা সহ্য করতে পারছিল না সে।’

কয়েক মিনিট সময় পেরিয়ে গেল, তারপর সানা তার মেয়েকে ফোন দিলেন সে ঠিক আছে কিনা জানতে। কিন্তু ততক্ষণে কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে মেয়ের সাথে যোগযোগ করতে পারেননি সানা।
এর কিছুক্ষণ পর সানার ছেলে, আসমার ছোট ভাই এসে ভয়াবহ দুঃসংবাদ দেয় যে, ‘আসমা গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’ রাবা চত্বরের উপরে টহল হেলিকপ্টার থেকে চালানো একটি স্নাইপার থেকে গুলিটি এসে তাকে বিদ্ধ করে।

মূলত আসমা তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাঠের হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেনি। পথে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় বিক্ষোভকারীরাই তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। এখানে সকাল থেকেই আহত বিক্ষোভকারীরা আসছিল এবং বিকেল ৩টার মধ্যেই ওষুধ প্রায় শেষ হয়ে আসে।
সন্ধ্যা ৫টা, তখনো বন্দুকধারীদের গুলিবর্ষণ থামেনি। আসমার তিন ভাই সিদ্ধান্ত নিল যে, বোনের দেহটি চত্বরের বাইরে নিয়ে আসা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
কর্তৃপক্ষ অপরাধ ঢাকতে পড়ে থাকা আহতদের এবং লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা ছিল। এরই মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং যারাই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা সবাই মৃত অথবা জীবিত পুড়ে মারা গিয়েছিল।

আসমার ভাইয়েরা তাকে কম্বলে জড়িয়ে হাসপাতালের পেছন থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। তবে সাথে সাথে একটি সাঁজোয়া গাড়ি থেকে গুলি চালানো হয় তাদের ওপর। তারা পিছু হটে। আবার ফিরে গেলে লুকিয়ে থাকা স্নাইপাররা তার বোনের শরীরে গুলি করে এবং সে তাদের হাত থেকে পড়ে যায়। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা একটি ট্যাংক আসমার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয় এতে তার খুলি গুঁড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আসমার দেহ সরিয়ে আনতে সক্ষম হয় তার ভাইয়েরা। পরে তারা অন্তত ১৫টি বিভিন্ন হাসপাতালে চেষ্টা করলেও প্রত্যেকে আসমাকে তাদের মর্গে নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
সানা স্মরণ করে বলেন, ‘তাদের কোনো আহত ব্যক্তি বা লাশ গ্রহণ না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।

চত্বরের আশপাশের হাসপাতালগুলো আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হলেও কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছিল এবং ফার্মেসিগুলোকে ওষুধ সরবরাহ না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ‘অবশেষে অনেক অনুরোধের পর আসমাকে বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মর্গে নেয়া হয় যেখানে তার বাবা কাজ করতেন।’
আসমার বাবা মোহাম্মদ বেলতাগি সেদিনের হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। তিনি একজন চিকিৎসক এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সেক্রেটারি জেনারেল।
এই হত্যাকাণ্ডের পর গণগ্রেফতারের মধ্যে বেলতাগি আত্মগোপনে চলে গেলেও দুই সপ্তাহ পর গিজায় ধরা পড়েন এবং তার বিরুদ্ধে সহিংসতায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। ২০১৮ সালে এক গণবিচারে তাকে ৭৩৯ জনের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

বেলতাগি গ্রেফতার হওয়ার চার মাস পরে তার বড় ছেলে আনাসকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তার পরে কনিষ্ঠ পুত্র খালেদকে, যার বয়স মাত্র ১৬ বছর ছিল। পরে খালেদকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল এবং সাড়ে চার বছর পর আনাসকে দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। তবে আনাসকে মুক্তি দেয়ার পরিবর্তে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়।
এরপর কর্তৃপক্ষ সানার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে এবং স্বামী এবং দুই ছেলের সাথে সাক্ষাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 
অবশেষে, সানা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সুরক্ষার কথা ভেবে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং তুরস্কে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি ছোট ছেলে খালেদের সাথে থাকেন।

সানা বলেন, ‘মিসরের সেনাবাহিনী হত্যা বা গ্রেফতারের মাধ্যমে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আমার পরিবার কী করেছিল যে এমন নির্যাতনের শিকার হতে হলো?’ জানতে চান সানা। ‘আমরা ভালোবাসা ও সম্প্রীতিতে সমৃদ্ধ একটি সুন্দর ও সুখী পরিবার ছিলাম। তারা আমাদের পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে এবং একে একে বিছিন্ন করে ফেলেছে।’

সানা রাবা হত্যাযজ্ঞের আগে তার জীবনকে ‘আনন্দ পূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাবা-মা এবং শিশুরা প্রত্যেকেই তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার চেষ্টা করেছিল। তার শিশুরা পিতামাতাকে সন্তুষ্ট করতে এবং তাদের দেশের প্রতি অবদান রাখতে চেয়েছিল।
সানা এখন নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন একজন গৃহকর্মী হয়ে। যে কি না ছেলে এবং স্বামী থেকে অনেক দূরে এবং নিজের মেয়ের কবরেও যেতে পারেন না। কর্তৃপক্ষ পরিবারের সব সম্পত্তি দখল করেছে এবং তার স্বামীর স্থাপন করা ব্যক্তিগত ক্লিনিকও ধ্বংস করেছে। এখন তার জীবন বিষাদ ও দুঃখভরাক্রান্ত। ‘আমার স্বামী রাজনৈতিকভাবে সরকারের বিরোধী মতের এবং মিসরের সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি মিসরীয়দের অধিকার রক্ষায় কাজ করছিলেন, যা পূরণ করা হয়নি। কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলেই আজ আমরা এর চরম মূল্য পরিশোধ করছি।’

জীবন দিয়ে আসমা আন্তর্জাতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেন। সানা বলেন, ‘অবশ্যই আমি আমার স্বামী এবং ছেলের পরিণতির বিষয়ে শঙ্কিত, তবে আসমা আমাদের সবাইকে স্বাধীন ইচ্ছা এবং সংকল্পবদ্ধ থাকতে শিখিয়েছে। যতই সময় লাগুক না কেন, আমাদের অবশ্যই অধিকার অর্জন করতে হবে।’
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর


আরো সংবাদ



premium cement