২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মিসরে ৭৫ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড, অনুমোদন দেবেন গ্র্যান্ড মুফতি?

মিসর
মোহাম্মাদ বাদিয়ীকে আদালতের শুনানিতে নিয়ে যাচ্ছেন নিরাপত্তা রক্ষীরা (ফাইল ছবি) - ছবি: সংগৃহীত

মিসরের একটি ফৌজদারি আদালত নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুড নেতৃবৃন্দসহ ৭৫ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য দেশটির গ্র্যান্ড মুফতি শাওকি আলমের কাছে পাঠিয়েছে। শনিবার ওই ৭৫ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়।

২০১৩ সালে সেনা অভ্যুত্থানে তৎকালীন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতিবাদে রাজধানী কায়রোর ‘রাবা’ স্কয়ারে বিক্ষোভে অংশ নেয়ার অভিযোগের তাদের এ শাস্তি দেয়া হয়েছে।

শান্তিপূর্ণ ওই বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনী হামলা চালালে দু’পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় যাতে মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্তত ৬০০ নেতা-কর্মী ও কয়েক ডজন পুলিশ নিহত হয়।

শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে মুরসির রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের আধ্যাত্মিক নেতা মোহাম্মাদ বাদিয়ী রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ওই বিক্ষোভ সৃষ্টির নেপথ্য ভূমিকা পালনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মিসরের আইন অনুযায়ী এসব অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে গ্র্যান্ড মুফতির অনুমোদন নিতে হয়। ইসলামিক আইন কর্তৃপক্ষের প্রধান হিসেবে গ্র্যান্ড মুফতি সাধারণত আদালতের কোনো রায়ের সঙ্গে দ্বিমত করেন না।

তবে ২০১৪ সালে একবার পৃথক মামলায় মোহাম্মদ বাদিয়ীকে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে দিয়েছিলেন গ্র্যান্ড মুফতি শাওকি আলম। পরে তাকে ওই মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

আরো পড়ুন :
সিসির বর্বরতায় মিসর ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
মুহাম্মদ খায়রুল বাশার, ০৮ জুলাই ২০১৫
মিসরের স্বৈরশাসক ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করতে যাচ্ছেন। মিসরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে তিনি ভুল করেছেন এবং এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার উদ্যোগ নিলে সেটা হবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি গত মঙ্গলবার সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চান। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্টের ওই আসন বর্তমানে তিনিই জোরপূর্বক দখল করে রেখেছেন। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তার নেতৃত্বে রাষ্ট্র ও সরকার দমন করতে না পারায় তিনি তার সমালোচনা করেন। অথচ পরিহাসের বিষয় হলো, একসময় তিনিই ওই বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়ে ছিলেন।

সংক্ষিপ্ত বিচার (সামারিজাস্টিস) সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আদালতকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করেন সিসি। তিনি বলেন, ‘বিচারের হাত আইন দ্বারা বাঁধা রয়েছে। আমরা এ জন্য অপেক্ষা করব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিচার সম্পন্ন করতে আমরা আইন সংশোধন করব... এ অবস্থায় কি আদালত কাজ করতে পারে? এসব আইন কী কাজ করছে? তারা সাধারণ জনগণের জন্য কাজ করছে... আর যদি মৃত্যুদণ্ড হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে...।’

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দু’বছর পার হয়ে গেছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের ১৫ জন সিনিয়র নেতাসহ ১০৫ ব্যক্তিত্ব এবং মুরসি মৃত্যুদণ্ডের মুখে রয়েছেন। বিশ্ববাসীর চোখে যে রাষ্ট্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, এমন এক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। সিসির শাসনে মিসর এখন দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শ্রীলঙ্কান স্টাইলে অন্তর্ধান বা গায়েব হয়ে যাওয়াসহ দেশটিতে ব্যাপক নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে। এর সাথে সাথে মিসরে সক্রিয় দেশদ্রোহিতা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। সিসি যদি মুরসির মৃত্যুদণ্ডের হুমকি বাস্তবায়ন করেন, তাহলে মিসরে বিস্ফোরণ ঘটবে। ৯ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটিতে জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দেশটিকে এখন মনে হয় সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ার মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। গত সোমবার মিসরের প্রধান কৌঁসুলি তথা অ্যাটর্নি জেনারেল হিশাম বারাকাতকে গাড়িবোমা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কেউ হত্যাকাণ্ডের এই দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। এই হত্যাকাণ্ড সিসি যে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই সরকারের কর্তৃত্বের ওপর চপেটাঘাত।

১৯৯০ সালে মিসরের পার্লামেন্টের স্পিকার রিফাত আল মাগুবকে গুলি করে হত্যার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটির রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এত বিখ্যাত কোনো কর্মকর্তাকে আর হত্যা করা হয়নি। বিচার বিভাগ নির্যাতন-নিপীড়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকলে বারাকাত হচ্ছেন ওই নির্যাতনের মানবমুখ। কথিত বিচারের মাধ্যমে তিনিও জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। তিনি মিসরের ৪০ হাজার মানুষের গ্রেফতারি পরোয়ানা স্বাক্ষর করেছিলেন। ২০১৩ সালের একটি নির্দিষ্ট দিনে কায়রোর কেন্দ্রস্থলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সেনাসদস্যরা গণহত্যা চালিয়ে সহস্রাধিক প্রতিবাদকারীকে হত্য করার পর ওই গণহত্যাকে আইনগতভাবে বৈধতার সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন এই অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনিই গণহারে মৃত্যুদণ্ডদানকে প্ররোচিত করেন। সিসির অফিসে কথোপকথন সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মুরসিকে ডিটেনশনের তথা আটক রাখার জন্য কর্মকর্তাদের সাথে যেসব মিথ্যা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে তার সহজেই প্রকাশ হয়ে পড়েছে।

মিসরের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী মুরসিকে যেকোনো সেনা ব্যারাকে কিছুতেই আটক রাখা যায় না। কিন্তু বারাকাত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরচালিত একটি কারাগারকে একটি সেনা ব্যারাকে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়ে ন্যায়ভ্রষ্ট বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। নির্ভুলভাবে এই দূর নিয়ন্ত্রিত বোমা হামলার পেছনে কারা রয়েছে সে ব্যাপারে তিনটি প্রধান তত্ত্ব বিবেচনা করা যায়। প্রথমত, সন্দেহভাজনদের মধ্যে রাষ্ট্র নিজেও রয়েছে। মুরসির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই যে মৃত্যুদণ্ড পাস হয়েছে, তা যাতে তাড়াতাড়ি বাস্তবায়ন করা যায় সে জন্য সিসি মৃত্যুদণ্ডের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্যই এটা করতে পারেন। কারণ তিনি দ্রুত মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়ন করতে চান। অথবা নেতৃত্ব পর্যায়ের জেনারেলরা এর মধ্যে রয়েছেন যারা নির্বাসিত আহমদ শফিকদের একই গোষ্ঠীর মতোই প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমর্থন করেন। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অনুযায়ী, প্রথমে যেভাবে মনে করা হয়েছিল এটা সে ধরনের অসভ্য ও বর্বর নয়।

বারাকাতের গাড়িচালক হামলা থেকে বেঁচে গেছেন। বারাকাতের নিজের পক্ষ থেকেও গুজব রটানো হয় যে, তিনি নিজেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন। তাকে সামরিক বাহিনীর চিকিৎসকরা চিকিৎসা করার আগে একটি বেসামরিক হাসপাতালে ভর্তি করার পর তিনি এ কথা বলেন। বোমা হামলায় কতটি মোটর গাড়ি সম্পৃক্ত ছিল সে ব্যাপারে বিভ্রান্তি রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে গত সোমবার কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সিনিয়র নেতা যিনি প্রবাসে থাকেন, তাকে বারাকাতের মৃত্যুর ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে তদন্তের আহ্বান জানানোর জন্য প্ররোচিত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘বারাকাতের মৃত্যু লেবাননের রফিক হারিরির খুন হওয়ার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জন্য একই পর্যায়ের তদন্ত প্রয়োজন। যে তদন্ত হবে সরকার থেকে স্বাধীনভাবে। এই মৃত্যু থেকে সিসি যাতে কিছুতেই কোনো ফায়দা হাসিল করতে না পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্দেহ করা যেতে পারে; কিন্তু সংগঠনটি যখন এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে এবং এর সাথে জড়িত থাকার ব্যাপারে বারবার অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তখন তাদের কিভাবে সন্দেহ করা যায়? এরপর কথা হচ্ছে সরকারের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে যখন এমন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা মুরসির মৃত্যুদণ্ডের জবাব দেয়ার জন্য সরকারি কৌঁসুলিকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন, তখন বিষয়টি কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? তৃতীয়ত, সন্দেহের তালিকায় রয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) অথবা আলকায়েদার সাথে সম্পৃক্ত কেউ অথবা অইসলামি বামপন্থী বিপ্লবী গ্রুপ। ‘রেভিলিউশনারি পানিশমেন্ট’ নামে আখ্যায়িত করা হয় এমন গ্রুপও রয়েছে।

কে এই ঘটনা ঘটাতে পারে? এই হত্যাকাণ্ড বিশেষভাবে সিসির জন্য দুঃসংবাদ। এখন পর্যন্ত তার মিশন যে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে এটা হচ্ছে তার বৃহত্তম ইঙ্গিত। সিসি মিসরের স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ইতোমধ্যে দু’বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি দেশটির কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। এমনকি তিনি তার সরকারের প্রধান ব্যক্তিদেরও রক্ষা করতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তার সরকার ছেড়ে চলে গেছেন। মিসরের সামরিক ত্রাণকর্তা দ্রুত প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। ২০১৩ সালের জুন মাসের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায়, সিসি হয়তো ভেবেছিলেন যে, দ্রুত একটি ধাক্কা দিলে মুরসি শান্তিপূর্ণভাবে পদত্যাগ করতে পারেন এবং ব্রাদারহুড সহজেই তাদের পরিচিত জেলহাজতে গিয়ে আশ্রয় নেবে এবং তারা হয়তো রাষ্ট্রের বৈধতা নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ করবে না। কিন্তু সিসির উর্বর মস্তিষ্কের সেই চিন্তা ঠিক ছিল না। ৩০ জুন মুরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানোর জন্য যারা রাস্তায় নেমে এসেছিল, তাদের আর কখনো মিসরের রাস্তায় দেখা যায়নি। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সারা দেশে যে লাখ লাখ লোক প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল তারা তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে।

সিসি হয়তো নিজেকে এই ভেবে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ১৯৯২-১৯৯৮ সালে আলগামা আল ইসলামিয়ার বিদ্রোহ দমন করার জন্য যে কৌশল নেয়া হয়েছিল, সেই কৌশলেই ব্রাদারহুডকে থামিয়ে দেয়া যাবে। তিনি যদি এভাবে চিন্তা করে থাকেন তাহলে তিনি একটা মারাত্মক ভুল করেছেন। গামা আল ইসলামিয়ার বিদ্রোহের অবসান ঘটেছিল। কারণ ওই গ্রুপটির প্রতি সাধারণ জনগণের কোনো সমর্থন ছিল না। কিন্তু ব্রাদারহুড সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তাদের রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন। মিসরের রাজনৈতিক মতামত পরিমাপের প্রতিটি উদ্যোগ ও পদক্ষেপেই দেখা গেছে, দেশটিতে দলটির ৩০ শতাংশ সমর্থন আছে। এই ৩০ শতাংশ হচ্ছে তাদের ঘোর সমর্থক।

দু’বছর আগে মিসরে ৪০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল থাকলেও এখন ওই দলগুলোর একটি বড় অংশ হারিয়ে গেছে। তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। ব্রাদারহুড হচ্ছে মিসরে সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক আন্দোলন। সিসি এসব লোক এবং তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধ ঘোষণা করতে চান তাহলে তাকে বুঝতে হবে তিনি মিসরের লাখ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন, যাদের মধ্যে একটি অংশ সহিংসতায় মেতে উঠতে পারে। এ ধরনের ঘটনা আমরা আগেও দেখেছি। একজন স্বৈরশাসক একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিবাদকে জোরপূর্বক দমন করার জন্য সহিংসতাকে উসকে দেন। নির্যাতনের মাধ্যমে দমন অভিযান চালিয়ে স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায়। হাফিজ আল আসাদ ওইভাবে দমনাভিযান চালিয়ে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু তার ছেলে বাশার আল আসাদ এই প্রক্রিয়ায় সফল হতে পারেননি। বাশার এখন তার দেশের বেশির ভাগ এলাকার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। সহিংসতা ও দমন অভিযান চালিয়ে সিসিও যে সফল হবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

১৯৯০-এর দশকে মিসর যে বিদ্রোহের মোকাবেলা করেছিল তার সাথে বর্তমানে যা ঘটছে তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আরব বিশ্বের অত্যন্ত জনবহুল দেশ মিসর। এর চতুর্দিকে রয়েছে কয়েকটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এসব ব্যর্থ রাষ্ট্রে সঙ্ঘাত অব্যাহত রয়েছে। পশ্চিমে রয়েছে লিবিয়া, পূর্বে সিনাই উপত্যকা, উত্তরে গাঁজা এবং দক্ষিণে ইয়েমেন। মোয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের জন্য লিবিয়ায় গাজা হয়ে অস্ত্রের চালান এসেছিল। ওই অঞ্চলে রয়েছে কয়েকটি সীমান্ত। এর একটিতে অশান্তি দেখা দিলে অন্যটিতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। এতে সহজেই হস্তক্ষেপ করার মতো পরিস্থিতি ও সুযোগ সৃষ্টি হয়।

এখন পর্যন্ত সিসি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করতে যাচ্ছেন। মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নিলে সেটা হবে সিসির জীবনের বড় ভুল। মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে ১৯৬৬ সালে যখন সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেয়া হয়, তখন সাইয়েদ কুতুব মুসলিম ব্রাদারহুডের বড় কোনো নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ ও লেখক। ১১ বছর পর্যন্ত একজন উদারপন্থী ও নাস্তিক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর তিনি ইসলামি আন্দোলনে এসেছিলেন। সাইয়েদ কুতুবকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার পর তিনি ইসলামি আন্দোলনের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তিনি তার নিজের প্রজন্মের চেয়েও পরবর্তী প্রজন্মের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছেন।

মুরসি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। অপর দিকে সিসি ক্ষমতা দখল করে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের আসনে বসেছেন। লাখ লাখ ভোটারের কাছে সিসির বিপরীতে মুরসি একজন অধিকতর বৈধ প্রেসিডেন্ট। সাজানো বিচারের মাধ্যমে মুরসিকে হত্যা করা হলে তিনি হবেন একজন শহীদ। সাইয়েদ কুতুবের মতোই মুরসিও হবেন একজন মর্যাদাবান শহীদ। মিসরে কী বিপজ্জনক ঘটনা ঘটতে পারে সে ব্যাপারে কেউ কি প্রস্তুত আছে? মিসরে নিযুক্ত ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত জনক্যাসন সম্প্রতি মিসরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাগাদি গাফ্ফারের সাথে বৈঠকের পর এ কথা বলেছেন। তার সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য-মিসর অংশীদারিত্ব জোরদার করার ব্যাপারে আমি মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির সাথে একমত। নিরাপত্তা হচ্ছে আরো অধিকতর নিরাপদসমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক মিসরের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি। আমরা মিসরকে সেভাবেই দেখতে চাই। এর অর্থ হচ্ছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা, চরমপন্থী আদর্শের মোকাবেলা করা এবং অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতি ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক।’

যদি সিসি দায়িত্ব ছেড়ে দেন মিসরের ব্যাপারে তখন পশ্চিমাদের অপর একটি ‘বিস্ময়ের’ জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সেটা হবে আইএসের কাছে মসুলের পতনের চেয়েও বৃহত্তর কিছু।

গত মে মাসে প্রথম মুসরিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো মিসরের গ্র্যান্ড মুফতি নাকি এই মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করেছেন। মুরসির সাথে সাথে ব্রাদারহুডের সুপ্রিম গাইড ড. মুহাম্মদ বাদি এবং আধ্যাত্মিক নেতা কারজাবিসহ পাঁচজন শীর্ষ নেতাকেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। গত দু’মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আইমান নূর, তিউনিশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুন্সেফ মারজুকি, তিউনিশিয়ার আলনাহদা পার্টির প্রধান রশীদ ঘানুচিসহ বিখ্যাত রাজনীতিবিদেরা মিসরে সমঝোতার উদ্যোগ নেন। রশীদ ঘানুচি সৌদি বাদশাহকে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। এসব উদ্যোগের কথা অবশ্য বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি। কিন্তু এসব উদ্যোগ কী কোনো সুফল বয়ে আনবে?

বিশেষত: সম্প্রতি সিসি সরকার একদিনেই ব্রাদার হুডের ১৩ জন সিনিয়ার নেতাকে বন্দী করে পরে তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, সরকার বিরোধীদের ওপর নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। এ জন্য বিচার বিভাগকে তারা ব্যবহার করছে। সিসি প্রহসনের বিচারে দ্রুত মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নির্বিচার মানবাধিকার লঙ্ঘন সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্ব নীরব। কিন্তু কেন তাদের এই নীরবতা! মিসরের চলমান ঘটনার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব কেন? অ্যামেনেস্টি বলেছে, মিসরে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন থামানোর ব্যাপারে পশ্চিমা রাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ বৈঠকগুলোতে কোনো এজেন্ডা নেই। মিসরের চলমান ঘটনার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক বড় দায়িত্ব রয়েছে। সিসি এভাবে একটি দেশে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখবেন আর গোটা বিশ্ব কী তা চেয়ে চেয়ে দেখবে? আমরা সৌদি আরবের নতুন বাদশাহ সালমানসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, মিসরের নব্য ফেরাউনকে থামান; অন্যথায় মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটাবিশ্ব একদিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে।
khairulbashar407@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement