২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যেভাবে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের তথ্য চুরি করে ইসরাইলি গোয়েন্দারা

ইরানের একটি ইউরোনিয়াম কনভার্সন কেন্দ্রে কাজ করছেন এক কর্মকর্তা - ছবি : সংগ্রহ

মোসাদের এজেন্টরা আগে থেকেই জানতো তাদের কী কী করতে হবে এবং এসব কাজে কতক্ষণ সময় লাগবে। পারমাণবিক তথ্য কেন্দ্রটির অ্যালার্ম সিস্টেমগুলো অকেজো করা, অন্তত দুটি বড় দরজা ভাঙা, কয়েক ডজন বড় বড় ভল্টের দরজা ভাঙা এবং অন্তত আধা টন গোপন তথ্য নিয়ে শহর থেকে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া- এই ছিলো তাদের অভিযানের মূল কাজ। আগে থেকেই তাদের এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পুরো এই অভিযানে তাদের সময় লেগেছে ছয় ঘণ্টা ২৯ মিনিট।

ওই পারমাণবিক কেন্দ্রটিতে সকালের শিফটের ইরানি গার্ডরা ডিউটিতে আসে স্থানীয় সময় সকাল সাতটায়। এক বছর ধরে জায়গাটির ওপর কঠোর নজরদারি করে ইসরাইলি গোয়েন্দারা বিষয়টি জানতে পারে। তাই অপারেশনে অংশ নেয়া এজেন্টদের বলা হয় ভোটর পাঁচটার আগেই তার কাজ সেড়ে বেড় হয়ে যেতে হবে, যা তাদের জন্য ছিলো অনেক সময়। ইরানি গার্ডরা আসলেই টের পাবে যে কেউ তাদের গোপন ও মহাগুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক অস্ত্রের তথ্য চুরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কয়েক বছরের কাজের নথি, পারমাণবিক অস্ত্রের ডিজাইন ও উৎপাদনের পরিকল্পনা।

গত ৩১ জানুয়ারি রাতে মোসাদের এজেন্টরা প্রবেশ করে ইরানের ওই পারমাণবিক কেন্দ্রটিতে। তাদের হাতে ছিলে অত্যধিক তাপ উৎপাদনকারী টর্চ লাইট, যা থেকে তিন হাজার ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপযুক্ত আলো বেড় হয়। দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা নজরদারির পর তাদের জানানো হয়েছে যে, অন্তত ৩২টি ভল্ট তাদের ভাঙতে হবে। আর এই কাজের জন্য তাদের ব্যবহৃত টর্চলাইটগুলো ছিলো অত্যন্ত কার্যকরী। টর্চের আলো ফেলেই তারা গলিয়ে ফেলতে পারবে ভল্টের তালা

তবে এতগুলো ভল্টের মধ্যে অনেকগুলোই শেষ পর্যন্ত তাদের ধরতে হয়নি। কালো ফাইলে ভরা এমন একটি ভল্ট খুঁজেছে তারা, যেটির নকশা ও সিকিউরিটি ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত জটিল। নির্ধারিত সময়ের আগে তারা যখন কাজ শেষ করে সীমান্তের দিকে চলে যায় নির্বিঘ্নে, তখন তাদের হাতে ছিলো ৫০ হাজার পৃষ্ঠার নথি, ১৬৩টি সিডিতে ভরা নকশা, ভিডিও ও বিভিন্ন তথ্য।

গত এপ্রিলে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু যখন তাদের এজেন্টদের এই তথ্য চুরির কথা প্রকাশ করেন, তার আগে তিনি বিষয় হোয়াইট হাউজে ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। তিনি মনে করেন মোসাদের কাছ থেকে এই তথ্য জানার পরই ট্রাম্প ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সড়ে আসার বিষয়ে আরো কঠোর হন।

ইরান আবারো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায়, এমন দাবি ইসরাইল তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এরপরই ট্রাম্প ঘোষণা দেন চুক্তি বাতিলের। যদিও ইউরোপসহ পুরো বিশ্বই চেষ্টা করছে চুক্তিটি টিকিয়ে রাখতে। ২০১৫ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় দীর্ঘ কূটনৈতিক তৎপরতা শেষে ছয় বিশ্ব শক্তির সাথে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিলো ইরানের। চুক্তি অনুযায়ী ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বন্ধ করবে ও বিনিময়ে তাদের ওপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।

গত সপ্তাহে তিনজন বিদেশী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ করে ইসরাইল সেই তথ্যগুলো দেখায়। তার মধ্যে একজন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টামইসের, একজন ওয়াশিংটন পোস্টের ও আরেকজন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্টার। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক পরিদর্শক ও পরমাণু বিজ্ঞানী রবার্ট কেলি ইরান থেকে চুরি করা নথিগুলো দেখে ভিয়েনায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘তথ্যগুলো বেশ সমৃদ্ধ। নথিগুলো দেখে মনে হচ্ছে তারা আবার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিষয়ে কাজ করছে’।

যদিও নিরপেক্ষভাবে তথ্যগুলো যাচাই করে দেখার কোন সুযোগ পায়নি মিডিয়া। ইসরাইল যা তাদের দেখিয়েছে, সেগুলোই তারা দেখতে পেয়েছে। বেশিরভাগ তথ্যই অন্তত ১৫ বছরে আগের যখন ইরান আমাদ নামে নতুন প্রকল্প শুরু করে। আমাদ প্রকল্প বাতিল করার পর গোপনে অনেক কাজ অগ্রসর হয়। ইসরাইল বলছে, তারা কিছু তথ্য প্রদর্শন করেনি কারণ এইসব তথ্য দেখলে পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে এমন কোন দেশ সেটি কাজে লাগাতে পারে।

ইরানী কতৃপক্ষ বলছে, এইসব ঘটনা পুরোটাই প্রতারণাপূর্ণ। ইসরাইল এই ঘটনা সাজিয়ে আবার তেহরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনতে চায়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের গোয়েন্দারা তথ্যগুলো পর্যালোচনা করেছে। ইতোপূর্বে তাদের নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের সাথে মিলিয়ে তারা বলেছে, ইসরাইল যে তথ্য চুরি করেছে তা যথাযথ।

তথ্যগুলো নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া কথা বলেছে বিশেষজ্ঞদের সাথে। তারা বলছেন, ২০০৩ সালে ইরানের আমাদ পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে তাদের পদক্ষেপ তার চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত, গোপনীয় ও সু-সংগঠিত। নথিগুলোতে ইরানের শাহাব-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য এমন পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরির চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বলা হয়েছে। একটি নথিতে মাটির নিচে পারমাণবিক পরীক্ষার সম্ভাব্য সাইটগুলোর প্রস্তাব করা এবং পাঁচটি অস্ত্রের একটি অতিরিক্তি ব্যাচ প্রস্তুতের কথা বলা হয়েছে। তবে ধরার পড়ারা ভয়ে কোন অস্ত্রই তৈরি করা হয়নি।

ইসরাইলের দাবি রাশিয়ার নাকচ, হতাশ নেতানিয়াহু
অধিকৃত গোলান মালভূমি থেকে ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের দূরে রাখার ব্যাপারে ইসরাইলের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি ইসরাইলের ওয়াইনেট নিউজ ওয়েবসাইট এ খবর দিয়েছে।  

ইসরাইল দাবি করেছিল, ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদেরকে গোলান মালভূমির ৮০ কিলোমিটার দূরে থাকতে বাধ্য করতে হবে। গত বুধবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মস্কোয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ব্যক্তিগত বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি ইরানি সামরিক উপদেষ্টাদের নিয়ে এ দাবির কথা তুলে ধরেন। কিন্তু পুতিন তাতে সাড়া দেননি।

অন্যদিকে, ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের উপস্থিতির ব্যাপারে ইসরাইলের যুদ্ধমন্ত্রী এভিগদোর লিবারম্যান বলেছেন, ৪০ কিংবা ৮০ কিলোমিটার কোনো বিষয় নয় বরং সিরিয়ার মাটিতে ইরানি সেনা উপস্থিতি দেখলেই তারা ব্যবস্থা নেবেন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা ড. আলী আকবর বেলায়েতি বলেছেন, সিরিয়ার সরকার না বলা পর্যন্ত ইরানি সামরিক উপদেষ্টারা সে দেশ থেকে চলে যাবে না। নেতানিয়াহুর সফরের পরদিনই আলী আকবর বেলায়েতি তিনদিনের জন্য রাশিয়া সফরে যান। এ সফরে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনী ও প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির দুটি বার্তা পৌঁছে দেন।

ব্যর্থ নেতানিয়াহু, আতঙ্কে ইসরাইল
ডয়চেভেলে ও রয়টার্স

ইরান চুক্তি বাতিলে ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি জার্মানি সফর করেছেন। কিন্তু পরমাণু চুক্তি বাতিল নিয়ে তিনি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সোমবার নেতানিয়াহু মার্কেলের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে মার্কেল তাকে জানিয়ে দেন ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তিতে থাকছে জার্মানি। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি করে ইরান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত মাসে চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মঙ্গলবার ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করার জন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন যে, তেহরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি হুমকিস্বরূপ। ইরান এখনো ইসরাইলকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছে। 

নেতানিয়াহু প্যারিসে পৌঁছে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাকরনের সঙ্গে দেখা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি চুক্তি স্বাক্ষরিত দেশগুলোকে ওয়াশিংটনের নীতি অনুসরণ করতে আহ্বান জানান। তিনি ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ওয়াশিংটনের সঙ্গে তেহরানের চুক্তি বাতিলের কথা বলেন।

ইরানের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি চুক্তি অনুযায়ী তা বন্ধ করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তিন ইউরোপীয় রাষ্ট্র। এখনই সময় তেহরানের পারমাণবিক বোমা তৈরি বন্ধ করতে।

কিন্তু ইসরাইল বলছে, যে ইরান পশ্চিমা দেশকে ঘৃণা করে এবং ইরান তার পরমাণু পরিকল্পনা ফেরার আগেই আর্থিক রিজার্ভ ফিরে পেতে নিষেধাজ্ঞা বিরতি ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে।

নেতানিয়াহু টুইটারের ভিডিও দেখিয়ে বলেন, ইরানের নেতা আয়াতুল্লা খামেনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার ইচ্ছা ইসরাইলকে ধ্বংস করা। সে কীভাবে ধ্বংস করবে তার বর্ণনা বলেছে, ইউরেনিয়ামের আর্সেনাল দ্বারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করে করবে। আমরা বিস্মিত নই, আমরা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে সমর্থন করি না।

রোবাবার খামেনির পুরাতন টুইটবার্তা টেনে বলেন, ইসরাইল একটি মারাত্মক ক্যানসার টিউমার। এটাকে উপড়ে ফেলতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement