২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নে কী ব্যাখ্যা আছে আইনে

- ছবি : সংগৃহীত ও প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন সময় ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’র অভিযোগে মামলা হলেও এ বিষয়টি এখনো সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়, বা এর তেমন কোনো আইনগত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলোর কোনো নিষ্পত্তি হয় না। তাদের মতে, ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’র বিষয়টির আইনি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকার কারণে এটি আসলে বিভিন্ন সময় হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও স্বীকার করেছেন যে অনেক সময় হয়রানির উদ্দেশে কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীনে মামলার শিকার হয়ে থাকে। তবে সরকার এই অভিযোগে কোনো মামলা গ্রহণ করলে সেটি হয়রানিমূলক নয় বলেও জানান মন্ত্রী।

বাংলাদেশে সর্বশেষ প্রথম আলোর সম্পাদক, পত্রিকাটির সাভারে নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস, সহযোগী একজন ক্যামেরা পারসন ও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

মামলাটির এজাহারে উল্লেখ করা অভিযোগে বলা হয়েছে যে তারা ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিনষ্টের হীন উদ্দেশে’ অনলাইন মাধ্যমে অপপ্রচার করেছেন।

কী আছে আইনে?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ২৫ ধারার এক উপধারার (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার বা তদুদ্দেশে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন- তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

তবে এ আইনে যেসব বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’র বিষয়টি নেই। অর্থাৎ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বলতে কী বুঝানো হয় বা কী কী কাজ করলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।

এর আগে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল সংসদে উত্থাপনের পর মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে এ আইন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিল যে, ‘নতুন আইনটি অনেকগুলো নতুন অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছে, নিশ্চিতভাবে যেগুলো ভবিষ্যতে দেশটির অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকৃত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।’

সেন্টার ফর গর্ভনেন্স স্ট্রাডিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এর আগের ১১ মাসে প্রতি মাসে অন্তত ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং প্রতি মাসে অন্তত ৬৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’র ব্যাখ্যা
বাংলাদেশে শুধুমাত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’র বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। দেশে প্রচলিত আর কোনো আইনে এর উল্লেখ নেই বলে জানান আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, বড়দাগে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার বিষয়টি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো আজ থেকে এক শ’ বা দেড় শ’ বছর আগে। পরে এ বিষয়টির ব্যাপক অপব্যবহার শুরু হলে সব দেশের আইন থেকেই এ শব্দগুলো বাদ দেয়া হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগে আমাদের দেশের কোনো আইনেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি ছিল না বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘এটি এখন আমাদের আইনে এসেছে এবং ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে।’

ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘সংবিধানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত ছিল। কিন্তু ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টি নেই।’

তার মতে, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টির সাথে সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি আইনটি হলো মানহানির আইন। তবে এটির সাথেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টিকে সরাসরি জড়িত করা যায় না। কারণ মানহানির আইন অনুযায়ী, কোনো পাবলিক পারসন বা নির্বাচিত ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব পালনের জন্য সমালোচনা করলে সেটা মানহানি হতো না।

তিনি মনে করেন, তবে বর্তমানে এই বিষয়গুলোও এখন মানহানির অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে। আর এ কারণেই এই আইনের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ সময়েই এগুলো হয়রানিমূলক উদ্দেশে ব্যবহার করা হয়।

একই ধরনের মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীনও। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার মতো শব্দগুলোর ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্ট না করাটা যে কোনো আইনেই খুব বিপদজনক। কারণ এ আইন তখন অপব্যবহারের একটা সুযোগ তৈরি হয়।

আইনের ক্ষেত্রে যেকোনো শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা খুব সুনির্দিষ্ট হওয়াটা জরুরি। তা না হলে তখনই আইনটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেটির সংশোধনের দরকার হয়।

তার মতে, কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছের ব্যাখ্যা না থাকলে সেটি দেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থার হাতে বড় ক্ষমতা তুলে দেয়ার মতোই কাজ করে।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’র বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির ব্যাখ্যা দেয়া হয় এমন অনেক বিচার বা মামলা পাকিস্তান আমল থেকে রয়েছে। যখন একটি মিথ্যা সংবাদ যা দেশের সুনামের উপর প্রভাব ফেলে তখনই এটার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এটাকেই ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’র কথা বলা হচ্ছে।

মন্ত্রী বলেন, দেশের সম্পর্কে যে তথ্য সত্য নয়, এমন একটা খবর প্রকাশ করে দেশকে হেয় করা হয়, মানে হচ্ছে সারা পৃথিবীতে বা জনগণের কাছে দেশটার যা পজিশন (অবস্থান) তার থেকে যদি আরো নিচের দিকে দেখানো হয়।’

উদাহরণ হিসেবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ধরেন, একটা দেশ গরীব নয়। তাকে বলা হলো গরীব বা দুর্দশাপূর্ণ- এই মিথ্যা তথ্যে এই খবরটা দেয়াকেই দেশকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এবং সেটাই বলছি যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।’

ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে হয়রানিমূলক মামলা হয় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, অনেক ব্যক্তি হয়ত হয়রানিমূলক মামলায় পড়তে পারেন। তবে এই মামলাগুলো শুধু হয়রানিমূলক হয় বললে সেটা ঠিক হবে না, আবার হয়রানিমূলক নয়, সেটা বলাটাও ঠিক হবে না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দেখা গেছে যে, সরকার যখন এই সব ব্যাপারে মামলা গ্রহণ করে তখন সেগুলো হয়রানিমূলক হয় না।

বিচার কতটা হয়?
বাংলাদেশের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গর্ভনেন্স স্টাডিজের ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে এক হাজার ৫০০টি মামলা হয়েছে।

এর মধ্যে মাত্র দু’টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। এই দু’টি মামলার মধ্যে একটি আনা হয়েছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে দু’টি মামলাতেই অভিযুক্তদের খালাস দেয়া হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মামলায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই রাজনীতিবিদ। আর তাদের পরেই রয়েছে সাংবাদিক। আর যারা এসব মামলা দায়ের করেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে মূল ক্ষতিগ্রস্ত নন। এদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট।

বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের’ অভিযোগে যে মামলাগুলো হয়, এখনো পর্যন্ত এমন কোনো মামলার বিচার শেষ হওয়ার নজীর নেই। বরং এসব মামলা নিম্ন আদালতের গণ্ডি কখনোই পেরোয় না। শুনানি পর্যন্তই এগুলো আটকে থাকে।

তিনি বলেন, ‘ফাইল (মামলা) হচ্ছে শুনি, কিন্তু ডিসপোজাল (নিষ্পত্তি) হচ্ছে বলে জানি না। এগুলো পড়ে থাকছে, অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।’

সাবেক এই বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অবশ্যই জরুরি। কিন্তু বাক স্বাধীনতার বিষয়টিও মাথায় রেখে একটা সমীকরণ রাখতে হবে যে, কী করলে সেটা ভাবমূর্তি নষ্টের দিকে যাবে না। এটা সামঞ্জস্য করার জন্যই আইন তৈরি করা হয়।

কিন্তু এই আইন যখন অপব্যবহার করা হয় তখন মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয় যা সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত। আর মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তা পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বলে মনে করেন সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল মতিন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান

সকল