১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
জামায়াতের সংবাদ সম্মেলনে গোলাম পরওয়ার

ভারতের সাথে দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে

জামায়াতে ইসলামীর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন মিয়া গোলাম পরওয়ার : নয়া দিগন্ত -


জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতকে একতরফা সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্যেই ভারতের সাথে চুক্তি ও সমঝোতাস্মারক সম্পন্ন করা হয়েছে। এ চুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্যই করা হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ অনির্বাচিত সরকারের এ জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব সমঝোতাস্মারক, ঘোষণা ও চুক্তি প্রত্যাখ্যান করছে। বর্তমান অবৈধ সরকারের বেআইনি, অগণতান্ত্রিক ও দেশের স্বার্থবিরোধী এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমরা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
গতকাল রাজধানীর একটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে গত ২২ জুন ভারতের সাথে ১০ দফা সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর ও তিস্তায় ভারতীয় কারিগরি টিম পাঠানোসহ ১৩টি ঘোষণা প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দের সঞ্চালনায় এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ ও মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মো: সেলিম উদ্দিন প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে গোলাম পরওয়ার বলেন, গত ২১ ও ২২ জুন ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বাংলাদেশের উপর দিয়ে রেল সংযোগ বৃদ্ধিসহ ১০ দফা সমঝোতাস্মারক সই করেছেন এবং তিস্তায় ভারতীয় কারিগরি টিম পাঠানোসহ ১৩ দফা ঘোষণা প্রদান করেছেন। এ ১০টি সমঝোতাস্মারকের মধ্যে সাতটি নতুন ও তিনটি পুরনো। এগুলোর মধ্যে আছে- রাজনীতি, নিরাপত্তা, বাণিজ্য, সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, জ্বালানি ও শক্তি এবং আঞ্চলিক সাহায্য সহযোগিতা প্রদান। চুক্তি ও সমঝোতাস্মারক এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ও গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়েছে- মূলত বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতকে একতরফা সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ চুক্তি করা হয়েছে। এ চুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্যই করা হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের মানুষ আশা করেছিল, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সুরমা-কুশিয়ারাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির বাংলাদেশের প্রাপ্য ন্যায্য হিস্যাসহ বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে বিরাজমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, ট্রানজিট-করিডোরসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে দেশে ফিরবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের পরিবর্তে ভারতের কাছে নতজানু হয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ভারতের কাছে বিকিয়ে দিয়ে এসেছেন। ভারতকে তিনি মনপ্রাণ উজাড় করে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। তিনি ভারতকে শুধু দিয়েই আসেন, কিছুই আনতে পারেন না। তার এ ধরনের ভূমিকায় বাংলাদেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ ও মর্মাহত।
গোলাম পরওয়ার বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদী তথা গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সুরমা-কুশিয়ারা এগুলো সবই আন্তর্জাতিক নদী। এসব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার বাংলাদেশের অধিকার আন্তর্জাতিক নদী আইন দ্বারা স্বীকৃত। বাংলাদেশকে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। ভারতের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার অধিকারও আছে; কিন্তু নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার যেমন সাহস পাচ্ছে না, তেমনি ভারতের সাথে দরকষাকষিতে বাংলাদেশ সরকার বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতেও পারছে না। এর কারণ হলো বাংলাদেশের বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে বর্তমান সরকার বিনা ভোটে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে আছে। সে কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে বহুবার স্বীকার করেছেন। তিনি আরো বলেন, ভারতের সাথে বর্তমান সরকারের সই করা সমঝোতাস্মারকে বলা হয়েছে ‘তিস্তা নদীর পানির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে যাবে ভারতীয় কারিগরি দল।’ বাংলাদেশের তিস্তার পানি সংরক্ষণের জন্য ভারতীয় করিগরি দল পাঠানোর প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর।

জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, ভারত গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে না দিয়ে বরং তারা ওই সব নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে বাংলাদেশকে শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে শুকিয়ে মারছে এবং বর্ষা মৌসুমে ডুবিয়ে মারছে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। উঠতি ফসল ধান, পাটসহ বিভিন্ন ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এভাবে প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ভারতের পানি আগ্রাসনে প্রতি বছরই অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। ভারতের এ পানি আগ্রাসনের মোকাবেলা করার জন্য গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সব অভিন্ন নদীর উপর ভারতের ভাটিতে ও বাংলাদেশের উজানে বাঁধনির্মাণ এবং ভরাট হওয়া নদীগুলো খনন করার জন্য বড় ধরনের মেগা প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
গোলাম পরওয়ার বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভারত সফরকালে ভারতকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে রাজশাহী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য সমঝোতাস্মারক সই করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট ও করিডোর দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মংলা সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও চট্টগ্রামের মিরসরাইতে ইপিজেড নির্মাণের চুক্তি সই করা হয়েছে। দেশের জনগণ মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর এসব পদক্ষেপের ফলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে পড়েছে। সরকার বলছে, পরীক্ষামূলকভাবে রাজশাহী পর্যন্ত রেল চলাচলের চুক্তি করা হয়েছে। আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৭৫ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মাত্র ৪৫ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর অনুমতি নিয়েছিলেন; কিন্তু ভারতের সেই ৪৫ দিনের মেয়াদ আজও শেষ হয়নি। কাজেই রাজশাহী পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে রেল যোগাযোগ চালুর যে কথা বলছে সে ব্যাপারে দেশবাসী মনে করে, পরীক্ষামূলকভাবে রাজশাহী পর্যন্ত রেল চালুর কথাটা একটি ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। হয়তো তাদের এ পরীক্ষামূলক রেল যোগাযোগের মেয়াদও কখনো শেষ হবে না। তাই বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সরকারের ওই সমঝোতাস্মারক মানতে রাজী নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের উপর দিয়ে যে রেল চলবে তাতে কী জিনিস বহন করা হবে তা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। সেটি যাত্রীবাহী না মালবাহী ট্রেন তা উল্লেখ করা হয়নি। ওই ট্রেনে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সামরিক সরঞ্জাম বহন করা হবে কি না তাও পরিষ্কার করে বলা হয়নি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ভারতের সাতটি রাজ্যের ওপারে জনগণকে ধ্বংস করার জন্য, গণহত্যা চালানোর জন্য যদি বাংলাদেশের উপর দিয়ে সামরিক সরঞ্জামসহ ভারতীয় সামরিক বাহিনী ওই সাতটি রাজ্যে সামরিক অভিযান চালায়, তা হবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাতে ভারতীয় ট্রেনে ভারতের সাতটি রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের সামরিক হামলার শিকার হয়ে বাংলাদেশ রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করেছেন, ভারতকে ট্রানজিট ও করিডোর দিলে ক্ষতি কী? আমরা তার কাছে পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই, ভারতকে ট্রানজিট ও করিডোর দিলে বাংলাদেশের লাভ কী? বাংলাদেশের কোনো লাভের কথাই তিনি প্রমাণ করতে পারবেন না। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যকার ট্রানজিট ও করিডোরের কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারে ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ মোটেই প্রযোজ্য নয়। ওই সব দেশের অধিবাসীদের অন্য দেশের বর্ডার গার্ড পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে না। কোনো দেশের বর্ডারে কাঁটা তারের বেড়াও নেই। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলাদা আলাদা মুদ্রা চালু, দু’দেশের মানুষের ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ভাষা আলাদা। মুদ্রার মানের মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবধান। দুই দেশের মধ্যে কাঁটা তারের বেড়া রয়েছে। ভারতীয় বিএসএফ বাংলাদেশী মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে। বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিবাদ ও প্রতিকার করছে না। বাংলাদেশের বিজিবি কখনো ভারতীয়দের হত্যা করে না। ভারতেও নরেন্দ্র মোদির উগ্র হিন্দুত্ববাদী ইসলামবিদ্বেষী শাসন চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে ট্রানজিট ও করিডোর দিয়ে তার সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনা করতে গিয়ে মূলত বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখানোর অপচেষ্টা চালিয়েছেন।
জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে ভারতের কাছ থেকে উন্নতমানের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য চুক্তি করেছে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের তিন দিক দিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ড বাংলাদেশকে বেষ্টন করে আছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিভিন্ন সমস্যা বিরাজমান। বাংলাদেশের উপর যদি কোনো দেশ থেকে আঘাত আসে, তাহলে তা ভারতের দিক থেকেই আসার আশঙ্কা রয়েছে। সেই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশের প্রশিক্ষণ গ্রহণ কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী না অনুকূল সে বিষয়টি অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণকে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত ও রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় করার কথাও বলেছেন। সরকারের এ ধরনের রহস্যজনক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের জনগণ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।

 


আরো সংবাদ



premium cement