১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শিগগির নতুন রূপ নেবে

-

- ৩ দেশের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা ইসরাইলের
- যুদ্ধবিরতির অস্পষ্ট প্রস্তাবে রাশিয়ার ‘না’
- ফিলিস্তিনিদের রাফাহ ছাড়ার নির্দেশ

আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই গাজার রাফাহে অভিযান সমাপ্ত করার বিষয়ে ভাবছে ইসরাইল। এ ছাড়া গাজায় চলমান ইসরাইলের আক্রমণ বা চলমান যুদ্ধ নতুন কৌশলে ও নতুন রূপে পরিচালিত হবে। এমনটাই উঠে এসেছে ইসরাইলি সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল-১৩-এর খবরে। ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যম আল-কুদস বিষয়টি জানিয়েছে।
গত রোববার চ্যানেল-১৩-এর খবরে বলা হয়, গাজার উত্তরাঞ্চলের শহর রাফাহে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই অভিযান বন্ধ করবে ইসরাইল এবং গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের নতুন ধাপ শুরু হবে। বিষয়টি এমন এক সময়ে সামনে এলো, যখন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হেরজি হালেভি, দেশটির সেনাবাহিনী দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার এবং অন্য শীর্ষ সমরবিদের সাথে বিশেষ বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ জেনারেলের বরাত দিয়ে চ্যানেল-১৩-এর খবরে বলা হয়েছে, ‘আগামী দিনগুলোতে ইসরাইল রাফাহ অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করবে। এ ছাড়া বর্তমানে যে কৌশলে যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে, তার সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসরাইলের জেনারেল চ্যানেল-১৩কে বলেছেন, ‘ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বর্তমানে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে রাফাহ অভিযানের সমাপ্তি ও পরিস্থিতির (প্রত্যাশিত) নাটকীয় পরিবর্তন, বিশেষ করে যুদ্ধের ধরন পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন।’ চ্যানেলটির খবরে আরো বলা হয়েছে, এই পরিবর্তনের অর্থ হলো আরো ফোকাসড ও নির্দিষ্ট অভিযান, বিমান হামলার সাথে সাথে বড় আকারে হামলা না চালিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে অভিযান চালানো হবে। উল্লেখ্য, নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে চ্যানেল-১৪কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত বলেছিলেন, বর্তমানে ইসরাইলি বাহিনী যে ধরনের অভিযান রাফাহ শহরে চালাচ্ছে, তা প্রায় সমাপ্ত। নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘হামাসের বিরুদ্ধে তীব্র সহিংস যুদ্ধ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এর অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পথে। তবে রাফাহে যে সহিংস যুদ্ধ চলছে, তা শেষ হওয়ার পথে।’ এর আগে গত বছরের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পরপরই নেতানিয়াহু জানিয়েছিলেন, ‘সহিংস যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই আমরা আমাদের কিছু সেনাকে আবার উত্তর দিকে পুনরায় মোতায়েন করব।’

৩ দেশের বিরুদ্ধে মামলা
ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা প্রদানের অভিযোগে তিন দেশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের ফেডারেল আদালতে। দেশ তিনটি হলো- ইরান, সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়া। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইসরাইলপন্থী সংস্থা অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগ (এডিএল) সোমবার বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে হামাসকে আর্থিক, সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা দিয়ে আসছে এই তিন দেশ। মামলা করার পর এক বিবৃতিতে এডিএলের শীর্ষ নির্বাহী জোনাথন গ্রিনব্লাট এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইহুদিবিদ্বেষ এবং সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ইরান। দেশটির সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ছড়ানো বিশ্বজুড়ে হচ্ছে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণামূলক মনোভাব এবং সন্ত্রাস; আর এ ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো ইরানের পাশে রয়েছে সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার পর থেকে এ পর্যন্ত ইহুদিদের লক্ষ্য করে যত হামলা হয়েছে, প্রতিটির পেছনে এই তিন দেশের মদদ ছিল।’ মামলায় এই তিন দেশের কাছে মোট ৪০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে এডিএল। মামলার পর এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে ইরান, সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স, কিন্তু কেউই মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যুদ্ধবিরতির অস্পষ্ট প্রস্তাবে রাশিয়ার ‘না’
জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি সোমবার গাজায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত তিন-ধাপের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলেছেন, এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্তারিত বিষয়ের অভাব রয়েছে। তুরস্কের সংবাদসংস্থা আনাদোলু এজেন্সি এ খবর জানিয়েছে। জুলাই মাসে রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া এক সংবাদ সম্মেলন করেন। ১০ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সমর্থনকারী প্রস্তাবে রাশিয়া ভোটদান থেকে বিরত থাকে। এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন নিয়ে আনাদোলুর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এই সমালোচনা করেন।
নেবেনজিয়া জোর দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রথমে ‘স্পষ্ট, তাৎক্ষণিক এবং যাচাইযোগ্য যুদ্ধবিরতি’ দাবি করা উচিত। তিনি বলেন, মার্কিন প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেন, প্রস্তাবে উল্লিখিত প্রস্তাবনাটি ‘অস্পষ্ট’ এবং প্রয়োজনীয় বিশদ বিবরণের অভাব রয়েছে। নেবেনজিয়া বলেন, রাশিয়া ভোটদান থেকে বিরত থাকার কারণ হলো, তারা এমন একটি প্রস্তাবে স্বাক্ষর করতে চায়নি যার বাস্তবায়ন, উদ্দেশ্য এবং সময়সীমা স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সহকর্মীদের কাছে একটি ফাঁকা দলিল দিতে চাইনি যা বাস্তবে বাস্তবায়নের ভান করে, যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়াটিকে তারা ধ্বংস করবে, যা আমরা ঘটতে দেখছি।’ রাশিয়ার এই কর্মকর্তা বলেন, সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাস সত্ত্বেও ইসরাইলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরপরই বিবৃতি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এটি সত্য নয়। তিনি আরো বলেন, ‘এখন তারা হামাসকে দোষারোপ করছে যেন ইসরাইল রাজি হয়েছে, যা সত্য নয় - এই পিং পং খেলা চলছে, কিন্তু কিছুই ঘটছে না। বাস্তবে কিছুই ঘটছে না।’
এর আগে নিরাপত্তা পরিষদ বাইডেনের ঘোষিত গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সমর্থন করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবে মিসর, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের নেতৃত্বে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে এবং ৩১ মে উপস্থাপিত তিন-ধাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল প্রায় ৩৮,০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এই ঘটনায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগে বিচার চলছে।

ফিলিস্তিনিদের রাফাহ ছাড়ার নির্দেশ
এ দিকে ডয়চে ভেলে ও আল জাজিরা জানায়, দক্ষিণ গাজায় শুরু হয়েছে রকেট আক্রমণ। তার আগে রাফাহ ও খান ইউনুস ছাড়ার নির্দেশ দিলো ইসরাইলের সেনা। এত দিন দক্ষিণ গাজাতেই আশ্রয় নিচ্ছিলেন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। উত্তর ও মধ্য গাজা থেকে তারা দক্ষিণ গাজায় এসেছিলেন কারণ, ওই দুই জায়গা ফাঁকা করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসরাইল। দক্ষিণ গাজায় মিসরের সীমান্তের কাছে রাফাহয় বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই রাফাহর পথ দিয়েই গাজায় ঢুকছে আন্তর্জাতিক সাহায্য। এবার সেই রাফাহই খালি করার নির্দেশ দিলো ইসরাইল। এর অর্থ, লাখ লাখ মানুষকে নতুন করে আশ্রয় শিবির খুঁজতে হবে। ইসরাইল জানিয়েছে, রাফাহ ও খান ইউনুসে রকেট আক্রমণ শুরু হয়েছে। আপাতত এই আক্রমণ চলবে। সে কারণেই সাধারণ মানুষকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দিকে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে ইসরাইল। রাফাহ ও খান ইউনুস খালি করার নির্দেশ ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের প্রধান অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টেফান দুজারিক বলেছেন, ‘আরো একবার প্রমাণিত হলো যে গাজায় কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়। সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ অন্তত ১০ লাখ মানুষ দক্ষিণ গাজায় মিসর সীমান্তে আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছেন। নতুন করে কোথায় গিয়ে তারা আশ্রয় নেবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement