লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণীর খাবারের সঙ্কট
- এম এ রকিব শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)
- ২৯ জুন ২০২৪, ০০:০০
- প্রভাবশালীদের দখলে ছোট হচ্ছে পরিধি
- লোকালয়ে দেড় বছরে ৬১ প্রাণী উদ্ধার
মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গলের লোকালয় থেকে গত দেড় বছরে ৬১টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছে বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। উদ্ধার করা প্রাণীদের মধ্যে শুধু অজগর সাপ রয়েছে ২৬টি। এ ছাড়া দারাশ, সবুজ বুড়ান, বেতাস্রা, হলুদ ছাপ ঘরগিন্নি, ধুসর ফনি মনসা, রেড আইক্যাট, শঙ্খিনী সাপ রয়েছে আরো ১২টি। উদ্ধার করা অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে ভুবনচিল ২টি, বন বিড়াল ৬টি, গন্ধগোকুল ৩টি, পেঁচা ২টি, জলমুরগি ১টি, লজ্জাবতী বানর ৯টি। উদ্ধার করা সুস্থ বন্যপ্রাণীদেরকে সাথে সাথেই আর অসুস্থগুলোকে সুস্থ করে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে সেবা ফাউন্ডেশন জানিয়েছে।
সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল নয়া দিগন্তকে জানান, ২০২৩ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৩৮টি বন্যপ্রাণী লোকালয় থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ২০২৪ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে গত ২৫ জুন পর্যন্ত উদ্ধার করা বন্যপ্রাণী রয়েছে ২৩টি। এসব প্রাণী শহর ও শহরতলির বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, বাড়ির আঙ্গিনা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, কৃষিজমি ও সড়কের পাশ থেকে সজল নিজেই তার সহযোগীকে সাথে নিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন সেবা ফাউন্ডেশনে। এরপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কেবল সুস্থ সবল প্রাণীগুলোকে সাথে সাথে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেন। আর লোকালয়ে এসে অসুস্থ হয়ে পড়া প্রাণীগুলোকে চিকিৎসা শেষে হস্তান্তর করেন। তিনি আরো জানান, লাউয়াছড়া বনটিতে এখন আর আগের মতো গভীর বন নেই। এখানের বড় বড় গাছ কেটে পাচার করা হয়েছে। তার দাবি, এসব বন্যপ্রাণী খাবারের সন্ধানেই মূলত লোকালয়ে চলে আসে। এভাবে খাবারের সন্ধান করতে গিয়ে কিছু বন্যপ্রাণীকে মানুষের হাতে আর কিছু সড়কে গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে জীবন দিতে হয়।
লোকালয়ে সবচেয়ে বেশি অজগর সাপ আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অজগর রক্ত-মাংসজাতীয় খাবার খেতে পছন্দ করে। এসব খাবার এখন আর বনে নেই বললেই চলে। তাই তারা লোকালয়ে চলে আসে খাবারের সন্ধানে। সজল বলেন, আমি তো শুধু লাউয়াছড়ার একটা প্রান্তের বন্যপ্রাণীগুলো উদ্ধার করি। ওই এলাকার মানুষজন আমাকে চিনেন জানেন বিধায় তারা খবর দেন তাদের বাড়ি-ঘরে বন্যপ্রাণী আসার। কিন্তু অন্যান্য আরো যে দিকগুলো রয়েছে সেই সব এলাকা থেকে বনের প্রাণীগুলো উদ্ধারের রেকর্ড আমার খাতায় নেই বললেই চলে।
সজল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বনের ভিতরে যেসব উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন তারা এসব বন্যপ্রাণী নিয়মিত খেয়ে থাকেন। তারা বনের শেয়াল থেকে শুরু করে সাপ পর্যন্ত খেয়ে থাকেন। আমাদের শহরের দিকে বা মৌলভীবাজার রোড এলাকায় যেভাবে বন্যপ্রাণীগুলো আসছে অন্যান্য এলাকায় ঠিক সেভাবেই যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। কিন্তু সেইসব এলাকার প্রাণীগুলো কি আবার বনে ফিরে যাচ্ছে, না মানুষের হাতে মারা যাচ্ছে নাকি আদিবাসীদের পেটে যাচ্ছে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তিনি বলেন, লাউয়াছড়া বনকে রক্ষা করতে হলে এবং বনের প্রাণীকুলকে রক্ষা করতে হলে বেশি বেশি করে বনে ফলদ গাছ লাগাতে হবে। শুধু গাছ লাগালেই হবে না এসব গাছকে কয়েক বছর ধরে পরিচর্চা করতে হবে। এ ছাড়া লাউয়াছড়া বনের চারপাশ প্রভাবশালীদের দখলের কারণে ছোট হয়ে আসছে। বনের জমি উদ্ধার করে বনের ভেতর লেক বা পুকুর বানাতে হবে এবং সেই পুকুরে মাছ ছেড়ে দিতে হবে। যাতে বনের প্রাণীদের খাবারের সঙ্কট না হয়। এ ছাড়া গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। উপজাতীয়দের খাবারের তালিকা থেকে বন্যপ্রাণীদের বাদ দিতে হবে বলে তিনি পরামর্শ দেন।
পাহাড় প্রকৃতি সংরক্ষণ উন্নয়ন সংস্থা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, লাউয়াছড়া বন শুধু কাগজ-কলমে আছে, বাস্তবে প্রভাবশালীদের দ্বারা দখল হয়ে গেছে বনটি। পাশাপাশি খাতা-কলমে তিন শতাধিক বন্যপ্রাণী ও জীবচিত্র্য থাকলেও বাস্তবে এই বনে এখন বসবাস করছে মানুষ। আমরা বারবার বলে আসছি বনে একসাথে বন্যপ্রাণী আর মানুষ বসবাস করলে বন্যপ্রাণীগুলো হুমকির মধ্যে থাকে। বনের গাছপালা কেটে উজাড় করা হচ্ছে, কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বন বিভাগ। এতে বন্যপ্রাণীদের প্রকট হচ্ছে খাবারের সঙ্কট। মানুষের অত্যাচারে নিরুপায় হয়ে বন্যপ্রাণীগুলো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে লোকালয়ে চলে আসছে। এ ছাড়া মানুষের ভয়ভীতির কারণে প্রজনন সময়ে বন্যপ্রাণীগুলো দিগি¦দিক চলে যাচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন।
এ দিকে লাউয়াছড়া পুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জি নেতা) ফিলা পতমী বন্যপ্রাণীকে অত্যাচার এবং খাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে নয়া দিগন্তকে বলেন, এটা সম্পূর্ন মিথ্যা, বানোয়াট এবং হাস্যকর বিষয়। বন থেকে সবচেয়ে বেশি লোকালয়ে চলে যাচ্ছে অজগর সাপ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এটা কি আমরা খাই? বনের উপজাতীয়রা খাবারের টেবিলে বন্যপ্রাণী রাখে, এ বিষয়টি কেউ হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলেছে।
মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো: শহিদুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, বন্যপ্রাণীরা খাবারের সঙ্কটে লোকালয়ে যাচ্ছে কি না এটা গবেষণার বিষয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না কেন তারা লোকালয়ে যায়। তবে দলছুট হয়ে অনেক সময় বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বানর এবং হনুমান পথ হারিয়ে ফেলে। আর আমি ২০২১ সালের ২৪ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণের পর একটা গাছও কাটা হয়েছে এরকম কোনো নজির নেই। এ ছাড়া আদিবাসীদের দ্বারা বন্যপ্রাণী আহরণের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। যদি কারো কাছে থেকে থাকে তথ্য প্রমাণসহ আমাকে জানালে ব্যবস্থা নেবো। তা ছাড়া বনের জায়গা দখলের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে থাকতেও পারে, কারণ লাউয়াছড়া আনসার্ভে ল্যান্ড। সার্ভে করার পর যদি পাওয়া যায় কারো দখলে সেটা আমরা উদ্ধার করব।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা