ডেপুটি জেলারসহ আরো ২ জন সাসপেন্ড
- আবুল কালাম আজাদ বগুড়া অফিস
- ২৯ জুন ২০২৪, ০০:০০
বগুড়া জেলা কারাগারের ছাদ ফুটো করে কনডেম সেল থেকে চার আসামি পালানোর ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছেন কারা অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে কর্মকর্তারা দেখছেন জেলার ও জেল সুপারের দায়িত্বে অবহেলা। তাই তদন্তের শুরুতেই দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ একজন ডেপুটি জেলারসহ আরো ২ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত, ৩ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও ২ জনকে কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ডেপুটি জেলার হোসেনুজ্জামান ও প্রধান কারারক্ষীসহ মোট ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া অপর ৩ কারারক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। জেল সুপার আনোয়ার হোসেন এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার থেকেই তদন্ত শুরু করেছে জেলা প্রশাসন ও কারা অধিদফতর গঠিত তদন্ত কমিটি। কারা অধিদফতরের কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান বগুড়া কারাগার চত্বর পরিদর্শন করে তদন্ত কাজ শুরু করেন তিনি। শুরুতেই প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে অবহেলার কারণে এই আটজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। সাময়িক বরখাস্তকৃতদের মধ্যে ডেপুটি জেলার ছাড়াও সর্ব প্রধান কারারক্ষী ফরিদ উদ্দিন, প্রধান দুই কারারক্ষী দুলাল মিয়া ও আব্দুল মতিন এবং কারারক্ষী আরিফুল ইসলাম রয়েছেন। এ ছাড়া বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে প্রধান কারারি আমিনুল ইসলাম, সহকারী প্রধান কারারি সাইদুর রহমান ও কারারি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বগুড়া কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এ কারণে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, জঙ্গি মামলায় অভিযুক্ত জেএমবির আসামিদের অন্য কারাগারে সরিয়ে নেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজশাহী বিভাগীয় কারাগারসহ পাশের জেলার বিভিন্ন কারাগারে আসামি সরানোর কাজ চলে।
বগুড়া কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। নিরাপত্তাব্যবস্থার ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে এবং জেল সুপার ও জেলারের দায়িত্ব অবহেলার কারণে কারাগারের ‘কনডেম’ সেলের ছাদ কেটে পালিয়ে যায় চার দুর্ধর্ষ ফাঁসির আসামি। বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না জেল সুপার ও জেলার। এই ঘটনা নজিরবিহীন। তাই দায়িত্ব অবহেলার কারণে আটজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাবেক আইজি (প্রিজন) লিয়াকত আলী খান সাংবাদিকদের বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার দুর্ধর্ষ আসামির পালিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ দায়ভার জেলার ও জেল সুপারের। এটা তাদের চরম ব্যর্থতা। কারাবিধি অনুসরণ করে বন্দী পরিচালনা করা হলে ওই আসামিরা পালিয়ে যেতে পারত না। তিনি বলেন, একজন কারারি সার্বক্ষণিক কনডেম সেল নজরদারি করবেন। তার আর কোনো দায়িত্ব নাই। কনডেম সেলের আসামিকে নজরদারি করাই তার দায়িত্ব। কিন্তু কারারি তার দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেননি। সেইসাথে কারাবিধি অনুযায়ী কনডেম সেলগুলোতে সন্ধ্যার আগে আসামি লক আপে উঠবে। এ সময় জেলার নিজে প্রতিদিন সেলগুলোতে এসে আসামির খোঁজ নিবেন আসামির হিসাব ঠিক আছে কিনা। এটা জেলারের দায়িত্ব। কিন্তু জেলার তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। এ ছাড়া জেল কোড অনুযায়ী জেল সুপারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার করার কথা। কিন্তু তিনিও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। যদি জেল কোড অনুযায়ী কারারি, জেলার ও জেল সুপার দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে ওই আসামিরা পালিয়ে যেতে পারত না। তাদের ব্যর্থতার কারণেই আসামি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি কনডেম সেলে কারাবিধি অনুযায়ী বেজোড় সংখ্যার যেমন ১ বা ৩ জন আসামি থাকার কথা। কিন্তু সেখানে চারজন আসামি একত্র থাকল কিভাবে। এই ৪ জনের মধ্যে আবার একই হত্যা মামলার দুইজন আসামি ছিল। এই সুযোগে তারা ওই কনডেম সেলে একত্র হয়ে পালানোর পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনায় তারা সফল হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বগুড়া কারাগার স্থাপিত হয়েছে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ শাসন আমলে। কারাভবন ও কনডেম সেলগুলো সেই আমলের। তখন ভবন নির্মাণে লোহার রড ব্যবহার করা হত না। ছাদ নির্মাণে চুন ও সুড়কি ব্যবহার করা হতো। বগুড়া কারাগারের চারটি কনডেম সেলের ছাদ চুন ও সুড়কির মাধ্যমে নির্মিত। ১৯১ বছর পুরনো সেই কনডেম সেলগুলোর কার্যক্ষমতা কমে গেছে। তাই আসামিরা ছাদগুলো সুরঙ্গ করে কেটে ফেলতে পেরেছে। তবে প্রশ্ন হলো, এই ছাদ কাটতে যন্ত্রপাতি কিভাবে পেল? কে দিলো ছাদ কাটার যন্ত্রপাতি? এই রহস্য দানা বাঁধছে। যদিও পুলিশ বলছে, গ্রেফতার ফাঁসির আসামিদের কাছ থেকে একটি ৪ দশমিক তিন ইঞ্চি লম্বা স্টিলের পাত, একটি প্যাঁচানো প্লাস্টিকের রশি, একটি ৭ ইঞ্চি লম্বা স্ক্রু ড্রাইভার জব্দ করা হয়েছে। এই স্টিলের পাত ও স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে কৌশলে এক মাস ধরে একটু একটু করে ছাদ কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করে পালিয়ে যায়। তবে এসব দিয়ে সেলের ছাদ কেটে পালানো সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ দিকে বগুড়া কারাগারে হাজতি ও কয়েদিসহ রয়েছে তিনগুণ বন্দী। কারাগারের ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৭০০ জন। আর গতকাল পর্যন্ত বন্দী ছিল ২ হাজার ২০০ জন। হাজতি ও কয়েদিদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে কারাগার থেকে আর কোনো আসামি যাতে পালাতে না পারে সেজন্য নিরাপত্তা বাড়ানোসহ সার্বিক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বগুড়া কারাগার থেকে চার ফাঁসির আসামির পলায়ন ও গ্রেফতারের পর বগুড়া কারাগারের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কারা সূত্র জানায়, বগুড়া কারাগারের চারটি সেন্ট্রিপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। জনবল বাড়নো হয়েছে ২৮ জন। সেইসাথে কারাগারের দেয়ালের বাইরে ২৪ ঘণ্টা ১২ জন কারারি দায়ত্ব পালন করছেন।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে সেলের ছাদ ফুটো করে বিভিন্ন চাদরকে রশি হিসেবে ব্যবহার করে ফাঁসির চার আসামি পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ রাতে ৪টা ১০ মিনিটের দিকে কিছুটা দূরে চেলোপাড়া চাষিবাজার এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার কয়েদি হলো- কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকার নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু, নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকার আমির হোসেন, বগুড়ার কাহালু পৌরসভার মেয়র আবদুল মান্নানের ছেলে মো: জাকারিয়া এবং বগুড়া সদরের কুটুরবাড়ি পশ্চিমপাড়া এলাকার ফরিদ শেখ। এ ঘটনায় বুধবার (২৬ জুন) বগুড়া জেলা প্রশাসকের গঠিত ছয় সদস্যের এবং অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক শেখ সুজাউর রহমান সুজার নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় জেলার ফরিদুল ইসলাম রুবেল বুধবার ওই চার কয়েদির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাদের আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠায়। এদের মধ্যে কুড়িগ্রামের নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ও নরসিংদীর আমির হামজা ফোর মার্ডার মামলার ফাঁসির আসামি। এ ছাড়া বগুড়ার কাহালু উপজেলার জাকারিয়া ২০১২ সালে কাহালু উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র নাইমুর ইসলাম নাইমের হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রধান আসামি।