দুষ্টচক্র-জঞ্জাল না হটালে বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন অসম্ভব
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১১ জুন ২০২৪, ০০:১৫
আমাদের দেশে যে দু’একটি আর্থিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল সেগুলো কোনো কাজ করছে না। অন্যদেশে এসব পদক্ষেপ কাজ করে আমাদের দেশে করে না, কেন? কারণ আপনারা যাকে বলেন সিন্ডিকেট, আমি বলি দুষ্টচক্র। এই দুষ্টচক্রগুলোতে যারা আছে তারা সঠিক পদক্ষেপগুলোকেও বাস্তবায়ন করতে দেয় না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে দুষ্টচক্র প্রায় সবজায়গাতেই রয়েছে। দুষ্টচক্র আছে আলুর বাজারে, পান-সুপারির বাজারে, ডলারের বাজারে। বিদেশের শ্রমবাজারেও দুষ্টচক্র রয়েছে। যার প্রমাণ কয়েক দিন আগেই দেখা গেল। তিনি বলেন, দুষ্টচক্রগুলো যেখানে আছে সেখানে যত ভালো পদক্ষেপই নেয়া হোক না কেন যতক্ষণ পর্যন্ত দুষ্টচক্রের লম্বা হাতগুলো হ্রাস করা না হয়, টেনে ধরা না যাবে ততক্ষণ তা বাস্তবায়ন হবে না। আমরা অগ্রগতি অনেক করেছি আর এই অগ্রগতিগুলো ধরে রাখতে ও ত্বরান্বিত করতে হলে এই দুষ্টচক্রগুলোকে দমন করতে হবে।
রাজধানীতে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), ডরপ ও হেলভেটাস বাংলাদেশ আয়োজিত জলবায়ু, পানি ও স্যানিটেশনবিষয়ক বাজেট প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক আলোচনায় গতকাল প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা’র সভাপতিত্বে সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন ডরপ’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনালঅ্যান্ড স্ট্র্র্র্যাটেজিক স্টাডিজ-বিআইআইএসএস’র গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির। ইআরএফ কার্যনির্বাহী সদস্য সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় সমাপনী বক্তব্য দেন ডরপ’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও এএইচএম নোমান।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, প্রতি বছরই নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাজেট আসবে, কোথাও বরাদ্দ বাড়বে আবার কোথাও কমবে। কিন্তু বাজেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাস্তবায়ন কিভাবে হচ্ছে ও কোথায় হচ্ছে সেটা। তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়ন বাজেটের প্রথম তিন মাসে হয় ৩ শতাংশ, পরের তিন মাসে হয় ৯ শতাংশ এবং শেষ ৯ মাসে সেটা হয়ে যায় ২৭/২৮ শতাংশ। তারপর থাকে তিন মাস, সেই তিন মাসে বাজেটের আকার কিছুটা কমানো হয়। বাজেট বাস্তবায়ন হয়ে যায় ৮০ শতাংশ। এটার ম্যাজিকটা কি আমি জানি না। তিনি বলেন, ওই সময় বাজেটের টাকা ব্যয় করতে হবে তাই করা হয়, এবং তাড়াহুড়া করে কাজের মান খারাপ হয়ে যায়। আরেকটা দিক হচ্ছে এই রকম ব্যয় করার হিড়িক যখন পড়ে তখন নয়-ছয় করার সুযোগ হয়, অনেকের পকেট ভারি হয়।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি বলেন, অনেকে বলেন, এই খাতে বরাদ্দ বাড়েনি ওই খাতে কম হয়েছে। কিন্তু আমি বলি বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে কি হবে যদি খরচ না হয়। তারপর খরচ কোথায় হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়, কতটা মানসম্পন্ন হচ্ছে সেটাও আরেকটা বিষয়। তিনি বলেন, আমাদের নীতি তৈরি করায় কোনো সমস্যা নেই, সার্বিক দিক নির্দেশনায় কোনো ঘাটতি নেই। টেকসই, উন্নয়ন ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের কথা বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছেন তেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, সমস্যা হয় বাস্তবায়নে। তিনি বলেন, আইএমএফ বলছে ব্যাংক খাতে সুশাসন বাড়াতে হবে, কর জিডিপি বাড়াতে হবে, বিদ্যুতের দাম ও গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। আইএমএফ’র যেসব শর্ত মানলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সুসংগঠিত হতে পারত সেগুলো বাস্তবায়ন হলো না। এর মধ্যে কোনটা বাড়ছে যেটা সাধারণ মানুষের উপর পড়ে সেটা, যেমন বিদ্যুতের দাম। কারণ সাধরণ মানুষ খুব একটা প্রতিবাদ করতে পারবে না। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি, কর জিডিপিও বাড়ছে না।
বাজেট আলোচনায় এনে অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান বলেন, এবার যে বাজেটে আমাদের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হলো ৬.৫ শতাংশ ও প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশ। এটা কিভাবে হবে? বাজেটেও এ বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে কিছু বলাও নেই। চলতি বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ এটা সারা বছরে কমে তো নাই বরং বেড়েছে, বাজেট দেয়ার পর আরো বেড়েছে, এখন ১০ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ মূল্যস্ফীতি শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতিও আমাদের চেয়ে কম। তাদের যেটুকু বেড়েছিল তারা তা নিয়ন্ত্রণ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের যদি এগিয়ে যেতে হয় তাহলে দুর্নীতির ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীল হতে হবে। এবার দুজন রাঘব বোয়ালকে বিচারের মুখোমুখি করার প্রক্রিয়া চলছে। আমি আশা করব শেষ পর্যন্ত বিচার হবে।
বাস্তবায়ন নিয়ে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আরো বলেন, যারা বাস্তাবায়ন করেন তারা সঠিকভাবে কাজ করেন না। এ ক্ষেত্রে দিক-নির্দেশনার সমস্যা নেই আমি আগেই বলেছি। যারা বাস্তাবায়ন করেন তারা অনেক সময় দিক নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কাজ করেন, নিজের মতো করে করেন। তারা একচোখা সিদ্ধান্ত নেন, ঘুম থেকে ওঠেই মনে হলো এটা করব করে ফেলেন। উদাহরণ হলো ডলারের মূল্য হঠাৎ ১১০ টাকা থেকে একদিনেই ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা। এটা আস্তে আস্তে বাড়াতে পারত। তারা এটা চিন্তা করল না এটাতে মূল্যস্ফীতি কতটা বেড়ে যাবে, আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, অথচ মনোযোগ দেয়া দরকার কর জিডিপিতে। কারণ আমরা যে বাজেটই দেই না কেন তা বাস্তবায়নে সরকারের সামর্থ বাড়াতে হবে। এজন্য কর জিডিপি বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে কর জিডিপির হার ৩৪ শতাংশের উপরে। সেখানে আমরা ৮-৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছি। শ্রীলাঙ্কা ও পাকিস্তানও আমদের চেয়ে বেশি রয়েছি। তিনি বলেন, এই পিছিয়ে থাকার কারণ হলো যাদের আছে তারা কর দিচ্ছে না, আর সাধারণ মানুষকেই হয়রানি করা হচ্ছে। যারা দিচ্ছে না তারা বহালতবিয়তেই আছে। যারা নজরদারি করেন তাদের যোগশাজসে পার পেয়ে যাচ্ছেন।
জলবায়ু প্রভাব মোকাবেলার জন্য তিনটি পদক্ষেপের কথা তিনি বলেন। তিনি বলেন, বাজেটের অর্থ বা সম্পদ যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হয় ব্যবহার হয়। যেখানে ব্যয় করার জরুরি সেখানে আগে ব্যয় করতে হবে। বিশেষ করে উপকুল ও চরাঞ্চলে যেখানে সাধারণ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না, উন্নত স্যানিটেশনের সমস্যার মধ্যে রয়েছে এবং লোনাপানির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ুর ক্ষতিপ্রতিরোধ ও তার প্রভাব মোকাবেলায় যেসব প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয় জড়িত তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় আনতে হবে। দেশে জলবায়ু নিয়ে ২৬টি নীতি ও পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে সমন্বয় নেই। অনেকে হয়তো সেই নীতিগুলোও জানেনও না।
ড. মাহফুজ কবির তার মূল আলোচনায় বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ রয়েছে তার ২১.৩১ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ওয়াটার, স্যানিটেশন ও হাউজিন (ওয়াশ) খাতে। যার পরিমাণ ৯৬৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বড় শহরগুলোতে ওয়াসার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাকিটা চরাঞ্চল, উপকূল, পাহাড়ি অঞ্চলসহ পুরো দেশে কাজ হবে। ওয়াসার জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৪৬৩ টাকা এবং সেই অনুপাতে সারাদেশের সাধারন মানুষের সুপেয় পানির, উন্নত স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থার জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫৫৫ টাকা খুবই অপ্রতুল। ন্যায্যতার ভিত্তিতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। অনেক অঞ্চলের মানুষকে এখনো বহু মাইল দূর থেকে সুপেয় পানি এনে জীবন বাঁচাতে হয়। উপকূলে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই।
মুক্ত আলোচনায় বক্তারা দেশের মানুষের উন্নত পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার জন্য মেঘা প্রকল্পের দাবি জানান। তারা বলেন, দেশের লোনাপানির মাধ্যমে ক্ষতি করে যে পরিমাণ আয় হচ্ছে তা এই ক্ষতি পোষানোর জন্য যথেষ্ট কি না তা চিন্তা করতে হবে।
ডরপ এর উপ-নির্বাহী পরিচালক বিবিএসের জরিপ তুলে ধরে বলেন, দেশে প্রতি বছর নিরাপদ পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে প্রতি লাখে ১৬৭ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। তাই এ খাতের বরাদ্দ ও বাস্তাবায়নে অগ্রাধিকার দিয়ে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।