সুশাসন, গণতন্ত্র ও সুস্থ রাজনীতির জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার অশনিসঙ্কেত
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১০ জুন ২০২৪, ০১:০৭
জাতীয়পর্যায়ের মতো স্থানীয় নির্বাচনেও জনস্বার্থ ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত, জনপ্রতিনিধিত্বের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের বিকাশই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদর্শিক ও জনকল্যাণমুখী জনপ্রতিনিধিত্বের কোণঠাসা অবস্থা। দেশের দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো ও সক্ষমতার ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে এবং সুশাসন, গণতন্ত্র ও সুস্থ রাজনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, প্রার্থীদের ৭.১৩ শতাংশ বা ৩৯০ জনের কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। পাঁচ বছরে প্রায় তিন গুণের বেশি হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা। নির্বাচিতদের ১৫০ জন বা ১২.৩৭ শতাংশ এবং নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ১৩২ জন বা ৩০.৪১ শতাংশ কোটিপতি।
রাজধানীর ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০২৪-এর প্রার্থী ও বিজয়ীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এমন মন্তব্য করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ও গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বক্তব্য রাখেন ও বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখিয়েছে, গত পাঁচ বছরে একজন জনপ্রতিনিধির আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩১ হাজার ৯০০ শতাংশ। এ সময়ে জনপ্রতিনিধিদের স্ত্রী/স্বামী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে একজন চেয়ারম্যানের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। আবার ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একজন বিজয়ীর গত পাঁচ বছরে আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৮৬৬.৬৭ শতাংশ এবং অস্থাবর সম্পদ সর্বোচ্চ বেড়েছে ২৩ হাজার ৯৩৭.৬৫ শতাংশ। তা ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সাথে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতাও স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে বিশ্লেষণে।
বিশ্লেষণে টিআইবি দেখিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭.৩৬ শতাংশ। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮.১৬ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৮ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের হার পাঁচ বছরে বেড়েছে ৬.৫ শতাংশ; চেয়ারম্যানদের প্রায় ৭৯ শতাংশই ব্যবসায়ী। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫০.৯৬ শতাংশ নিজেকে গৃহিণী/গৃহস্থালি কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। গৃহিণী/গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের ১৫.৬৮ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে। আবার ১৫.৭৯ শতাংশ প্রার্থীর কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে এ হার ২০ শতাংশ।
হলফনামা বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আয়বৈষম্য লক্ষ করা গেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩ শতাংশ-এর আয় সাড়ে ষোল লাখ টাকার ওপরে, অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ হার ৩.০৩ শতাংশ। বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ২৮০। নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ৫১ শতাংশ বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন। বছরে এক কোটি টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর ৪০ জন, এর মধ্যে দু’জন ভাইস চেয়ারম্যান আর বাকি সবাই চেয়ারম্যান। আবার আইনি সীমা ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমি আছে ২৫ জন প্রার্থীর এবং তাদের সাতজন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। আইনি সীমার বাইরে প্রার্থীদের সর্বমোট জমির পরিমাণ ৮৭৪ একর।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনস্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও, বাস্তবে জনপ্রতিনিধিত্বের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারকেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিকাশ ঘটছে। হলফনামার তথ্যের বিশ্লেষণ এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতার উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করছে। ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বিকাশের অবারিত সুযোগ তৈরি হয় এবং কোনো জবাবদিহির মুখে পড়তে হয় না। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিত্বের অবস্থানকে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ও বিভিন্ন যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ ও সম্পদ বৃদ্ধির লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ফলে দলীয় নির্দেশনা বা শৃঙ্খলা উপেক্ষা করে মুনাফাকেন্দ্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে জনপ্রতিনিধিত্বের অবস্থান দখল করা হচ্ছে। অন্য দিকে যারা জনকল্যাণমুখী আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন, এমন পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের কোণঠাসা ভাবছেন। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ এমন ব্যাপকভাবে তৈরি করে দিচ্ছে যে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই ভূমিকা রাখতে হবে। আর সে জন্য টিআইবি প্রণীত হলফনামার বিশ্লেষণ বিশাল গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য।
ড. জামান বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও আমরা প্রার্থীদের আইনবহির্ভূত জমির মালিকানা, অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয় ও সম্পদের বৃদ্ধির চিত্র দেখছি। হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের পর্যাপ্ততা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কারণ আমরা দেখছি প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রার্থীর হলফনামায় তথ্যের সাথে আয়কর বিবরণীর তথ্যের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। আবার ৪০ শতাংশ প্রার্থীর প্রদত্ত তথ্যমতে তাদের করযোগ্য আয় নেই, যা অবিশ্বাস্য মনে হওয়া অযৌক্তিক নয়। এই অসামঞ্জস্যগুলো, বিশেষ করে আয় ও সম্পদের বিকাশ বৈধ আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো সংস্থার। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব সংস্থার সদিচ্ছা ও সক্ষমতা প্রমাণের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না। জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও ক্রমবর্ধমান অকার্যকরতা আমাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসঙ্কেত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা